ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৪ অক্টোবর ২০২৪, ৯ কার্তিক ১৪৩১

বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা ॥ ছিনতাইয়ের ষড়যন্ত্র

আবদুল খালেক

প্রকাশিত: ২০:৪৫, ২৫ মার্চ ২০২৪

বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা ॥ ছিনতাইয়ের ষড়যন্ত্র

বঙ্গবন্ধুই বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক

মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭৩ সালে জেনারেল জিয়াউর রহমান যখন ছিলেন ডেপুটি চিফ অব আর্মি তখন ক্যাপ্টেন সিনহা ছিলেন তাঁর এডিসি। জনাব মুসা সাদিক সেই সময় ঢাকা আর্মি এইচ কিউতে জেনারেল জিয়ার ইন্টারভিউ নিয়েছিলেন। তিনি তাঁকে স্পষ্টভাবে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে, তিনি কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে দু’বার মুক্তিযুদ্ধের স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন সেটা কি তিনি নিজের নামে দিয়েছিলেন না বঙ্গবন্ধুর নামে? তিনি খুব দৃঢ়কণ্ঠে বলেছিলেন- ‘আমি Father of the nation বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলাম এবং দু’বার দিয়েছিলাম এবং দু’বারই উনার নামে দিয়েছিলাম।’

শুধু বাংলাদেশ নয়, সমগ্র বিশ্ব জানে বঙ্গবন্ধুই বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তারিখে বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর পরিবারের প্রায় সকল সদস্যকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যার পর বাংলাদেশে শুরু হয় সামরিক ব্যক্তিদের আধিপত্য বিস্তারের লড়াই। সে লড়াইয়ে জেনারেল জিয়া সফলতা লাভ করেন। কৌশলগতভাবে অতি অল্প সময়ের জন্য জেনারেল জিয়া বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি পদে বসিয়ে রাখেন বিশ্বাসঘাতক খন্দকার মোশতাককে।

প্রয়োজন ফুরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে খোন্দকার মোশতাককে রাষ্ট্রপতি পদ থেকে বিদায় করে দিয়ে জেনারেল জিয়া নিজেই রাষ্ট্রপতি পদ দখল করে বসেন। দেশে শুরু হয় পাকাপাকি সামরিক শাসন। সামরিক শাসনের শুরুতেই বঙ্গবন্ধুর দেওয়া ১৯৭২ সালের সংবিধানকে পাল্টে ফেলা হয়। জেনারেল জিয়া বিএনপি নামের একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা এবং বাংলাদেশের ইতিহাস বিকৃত করার লক্ষ্যে শুরু হয় গভীর ষড়যন্ত্র। ইতিহাস বিকৃতির ঘটনা বিএনপি কোন্ পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল, তার কিছু উদাহরণ এখানে তুলে ধরা যেতে পারে।

বিএনপি তথা চারদলীয় জোট সরকারের আমলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার খাতা দেখতে গিয়ে আমরা লক্ষ্য করেছি, ৬ দফা সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তরে কিছু কিছু পরীক্ষার্থী লিখেছে, ‘১৯৬৬ সালে জিয়াউর রহমান ঐতিহাসিক ৬ দফা ঘোষণা করেন’। অথবা, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে পরীক্ষার্থীরা নাম লিখেছে জেনারেল জিয়াউর রহমানের। এ জন্য কোমলমতি শিক্ষার্থীদের দোষ দিয়ে লাভ নেই।

চারদলীয় জোট সরকার শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবইয়ে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম পাল্টে দিয়ে জেনারেল জিয়াউর রহমানের নাম বসিয়ে দিয়েছিল। জোট সরকারের এই পদক্ষেপকে রাষ্ট্রীয় ছিনতাই হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। এ ধরনের রাষ্ট্রীয় ছিনতাইয়ের ঘটনা পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে খুঁজে পাওয়া যাবে না। ইতিহাসের এ এক নজিরবিহীন বিকৃতি। প্রসঙ্গক্রমে আমরা স্বাধীনতা ঘোষণার প্রকৃত ইতিহাসের দিকে একবার দৃষ্টি দিতে পারি। 
স্বাধীনতা ঘোষণার ইতিহাস পর্যালোচনা করতে বসলে চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রের বিষয়টি এসে যায়। যে বেতার কেন্দ্রের একটি ঘোষণা এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, সেই বেতার কেন্দ্র স্থাপনার ক্ষেত্রে যাঁরা সম্পৃক্ত ছিলেন, ইতিহাসে তাঁদের গুরুত্ব কম হওয়ার কথা নয়।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যখন বাংলাদেশে ব্যাপক গণহত্যার মাধ্যমে যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটায়, তখন চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র নিয়ে কি ঘটনা ঘটেছিল, একজন প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিকের লেখা থেকে আমরা বিষয়টি স্পষ্ট করে নিতে পারি। সাংবাদিকের নাম ‘মুসা সাদিক।’

‘স্বাধীনতা ঘোষণার ইতিহাস’ শীর্ষক প্রবন্ধে তিনি উল্লেখ করেছেন- ‘ইতিহাসের সেই সন্ধিক্ষণে ২৬ মার্চের সকাল ন’টা/দশটার মধ্যে চট্টগ্রাম শহরে অবস্থিত চট্টগ্রাম রেডিওর ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ শাকেরসহ অন্য প্রকৌশলী এবং চট্টগ্রাম বেতারের স্ক্রিপ্ট রাইটার বেলাল মোহাম্মদ এবং চট্টগ্রাম সরকারি কলেজের সাবেক ভিপি আমার বন্ধু আবুল কাশেম সন্দ্বীপ প্রমুখদের আওয়ামী লীগ নেতারা গাড়ি করে কালুরঘাট সম্প্রচার কেন্দ্রে পৌঁছে দেন, কালুরঘাট থেকে বেতার চালু করে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা প্রচারের মাধ্যমে দেশ-বিদেশের সকলকে জানাবার জন্য।

২৬ মার্চ দুপুর আনুমানিক সাড়ে এগারোটার দিকে স্বাধীন বাংলা বেতারের কণ্ঠস্বর ইথারে প্রথম ভেসে ওঠে। ‘স্বাধীন বাংলা বেতারের’ জন্ম ঘোষণা করে আবুল কাশেম সন্দ্বীপের কণ্ঠস্বরে চট্টগ্রামবাসী প্রথমে শোনেন ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে বলছি, স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে বলছি।’  
মুসা সাদিকের লেখা থেকে একটি বিষয় অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ার পর স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের সর্বাত্মক প্রচেষ্টায় কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রটি চালু হয়। বেতার কেন্দ্রটি চালু করার মূল লক্ষ্য ছিল বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার। কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে ২৬ মার্চের প্রথম প্রচারটি ছিল এ রকম- ‘গতকাল রাতে গণহত্যাকারী টিক্কা খানের পাকবাহিনী রাজারবাগের বাঙালি পুলিশ বাহিনী ও পিলখানার বাঙালি সিপাহীদের ওপর বর্বর হামলা চালিয়েছে।

ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গতকাল রাতে ঢাকা থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। সেই ঘোষণায় বঙ্গবন্ধু বলেছেন- ‘বাংলাদেশ এখন স্বাধীন দেশ’। বাংলাদেশের যে যেখানে আছেন, পাক হানাদার বাহিনীকে রুখে দাঁড়ান। একজন বাঙালি বেঁচে থাকা পর্যন্ত পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে শেষ লড়াই আমরা চালিয়ে যাব।

বাংলাদেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত পাঞ্জাবী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই চলতেই থাকবে। জয় বাংলা, স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে বলছি।’ উক্ত ঘোষণা প্রচারের ঘণ্টাখানেক পর কালুরঘাট স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে পৌঁছান আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নান। তিনি ঢাকা থেকে ঘোষিত বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা ২৬ মার্চ দুপুরে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচার করেন।

বেতার কেন্দ্র পরিচালনার জন্য বেলাল মোহাম্মদ, ইঞ্জিনিয়ার আবদুস শাকের এবং আবুল কাশেম সন্দ্বীপ প্রমুখকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে আসেন। হান্নান সাহেব স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বারবার ‘বিপ্লবী’ শব্দটি কেন উচ্চারিত হচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন এবং শব্দটি প্রত্যাহার করে নিতে বলেন। 
কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে অন্যতম কর্মকর্তা বেলাল মোহাম্মদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে মেজর জিয়াউর রহমান ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে উক্ত স্বাধীনতার ঘোষণা পুনঃপ্রচার করেন। তিনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে আসছেন এবং বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা পুনঃপ্রচার করছেন, তার সবই চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ নেতাদের অনুমোদন ও অবগতিতে করা হয়েছিল।

মুসা সাদিকের লেখা থেকে জানা যায়, ২৬ মার্চ কালুরঘাট স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে একটি ‘বিপ্লবী’ শব্দ আবুল কাশেম সন্দ্বীপ প্রচার করায় আওয়ামী লীগ নেতাদের ধমকে উক্ত ‘বিপ্লবী’ শব্দটি বিলীন হয়ে গিয়েছিল। এই যখন অবস্থা তখন সেই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে কোনো ক্যাপ্টেন বা মেজর নিজ নামে স্বাধীনতা ঘোষণা জাতীয় একটি বিবৃতি প্রচার করার মতো ক্ষমতা রাখতেন কিনা, তা দেশবাসীকে বুঝে নিতে হবে। 
২৬ মার্চ জিয়াউর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন বলে যে দাবি করা হয়, বিএনপির মতলববাজ নেতাদের এ যে কত বড় মিথ্যাচার, জিয়াউর রহমান ঘোষিত মূল বাণীবদ্ধ রেকর্ডটি জনসম্মুখে উপস্থাপন করলেই তার প্রমাণ মিলবে। ২৭ মার্চ শনিবার সন্ধ্যা ০৭.০৪ মিনিটে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত জিয়ার স্বকণ্ঠে বাণীবদ্ধকৃত টেপ থেকে নেওয়া (রেফারেন্স টেপ : ট্রান্সক্রিপশন রেডিও বাংলাদেশ, ঢাকা)।

সেই ভাষণের কয়েকটি বাক্য এখানে তুলে দেওয়া হলো- The Government of the sovereign state of Bangladesh on behalf of our Great Leader, the supreme Commander of Bangladesh Sheikh Mujibur Rahman. We hereby proclaim the independence of Bangladesh, and that the government headed by Sheikh Mujibur Rahman has already been formed.
সাংবাদিক মুসা সাদিকের স্বাধীনতার ঘোষণার ইতিহাস থেকে জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭৩ সালে জেনারেল জিয়াউর রহমান যখন ছিলেন ডেপুটি চিফ অব আর্মি তখন ক্যাপ্টেন সিনহা ছিলেন তাঁর এডিসি। জনাব মুসা সাদিক সেই সময় ঢাকা আর্মি এইচ কিউতে জেনারেল জিয়ার ইন্টারভিউ নিয়েছিলেন।

তিনি তাঁকে স্পষ্টভাবে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে, তিনি কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে দু’বার মুক্তিযুদ্ধের স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন সেটা কি তিনি নিজের নামে দিয়েছিলেন না বঙ্গবন্ধুর নামে? তিনি খুব দৃঢ়কণ্ঠে বলেছিলেন- ‘আমি Father of the nation বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলাম এবং দু’বার দিয়েছিলাম এবং দু’বারই উনার নামে দিয়েছিলাম।’ এ প্রসঙ্গে আরও একটি তথ্য এখানে সংযোজন করা যেতে পারে।

১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ জিয়াউর রহমান ‘একটি জাতির জন্ম’ শিরোনামে দৈনিক বাংলা এবং দৈনিক গণবাংলায় স্বনামে তাঁর ’৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকথা লেখেন। উক্ত স্মৃতিকথায়ও তিনি ছত্রে ছত্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘জাতির পিতা’ ও ‘বঙ্গবন্ধু’ বলে পরম শ্রদ্ধাভরে উল্লেখ করেছেন।   
বর্তমানে বিএনপি দীর্ঘ সময় ধরে রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে থাকলেও বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা ছিনতাইয়ের ষড়যন্ত্র এখনো তারা অব্যাহত রেখেছে। রাষ্ট্রপরিচালনার সুযোগ পেলেই পুনরায় তা কাজে লাগাতে চাইবে। তবে তাদের মনে রাখতে হবে যে, ইতিহাস খুব নিষ্ঠুর। ইতিহাস কখনো কোনো মিথ্যাচারকে প্রশ্রয় দেয় না।


লেখক : অধ্যাপক, সাবেক উপাচার্য
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

×