ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

ঐতিহাসিক রক্তঝরা মার্চ

তোফায়েল আহমেদ

প্রকাশিত: ২১:৪২, ২ মার্চ ২০২৪

ঐতিহাসিক রক্তঝরা মার্চ

ঐতিহাসিক রক্তঝরা মার্চ

১৯৭১-এর মার্চ বাঙালি জাতির জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফেব্রুয়ারি যেমন আমাদের ভাষার মাস, মার্চ তেমনি আমাদের স্বাধীনতার মাস। ’৫২-এর একুশে ফেব্রুয়ারি থেকে ’৭১-এর ছাব্বিশে মার্চ পর্যন্ত জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের প্রতিটি দিনই ছিল সংগ্রামমুখর। ’৭১-এর মার্চ মাসের প্রতিটি ক্ষণ, প্রতিটি মুহূর্ত ছিল বৈপ্লবিক। প্রতিবছর মার্চ মাস এলেই মননে-চেতনায় ভেসে ওঠে উত্তাল সেই দিনগুলোর কথা।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দূরদর্শী প্রজ্ঞা আর জাতীয় চার নেতার সম্মিলিত সিদ্ধান্ত এবং তাঁদের নির্দেশ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে সকল ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে, বিচ্ছিন্নতাবাদের দায় এড়িয়ে, কী করে আমরা এক সাগর রক্তের বিনিময়ে মুক্ত করেছিলাম প্রিয় মাতৃভূমিকে। সেসব ঐতিহাসিক ঘটনার স্মৃতি চারণে আজও মনে পড়ে রক্তঝরা ’৭১-এর মার্চের দিনগুলোর কথা।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ঢাকায় এসে ১২ ও ১৩ জানুয়ারি এই দুইদিন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দু’দফা আলোচনায় মিলিত হন। আলোচনার ফল সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকদের জানান, ‘আলোচনা সন্তোষজনক হয়েছে এবং প্রেসিডেন্ট খুব শীঘ্রই ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বানে সম্মত হয়েছেন।’ অপরদিকে ঢাকা ত্যাগের প্রাক্কালে তেজগাঁও বিমানবন্দরে জেনারেল ইয়াহিয়া সাংবাদিকদের বলেন, ‘দেশের ভাবী প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব তাঁর সঙ্গে আলোচনা সম্পর্কে যেসব কথা বলেছেন তা পুরোপুরি সঠিক।’

ঢাকা থেকে ফিরে ইয়াহিয়া খান লারকানায় ভুট্টোর বাসভবনে যান এবং সেখানে জেনারেলদের সঙ্গে এক গোপন বৈঠকে মিলিত হন। মূলত লারকানা বৈঠকেই নির্বাচনী ফল বানচালের নীল নকশা প্রণীত হয়। অতঃপর জানুয়ারির শেষদিকে ভুট্টো তার দলবলসহ ঢাকায় আসেন এবং জানুয়ারির ২৭ ও ২৮ তারিখে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান এবং শাসনতন্ত্র ৬ দফা ভিত্তিক হবে বলে জানান।

ভুট্টো বলেন, ‘আরো আলোচনার প্রয়োজন’ এবং তিনি ফেব্রুয়ারির শেষদিকের আগে পরিষদের অধিবেশন আহ্বানের বিরোধিতা করেন। এর পর ফেব্রুয়ারির ১৩ তারিখে এক সরকারি ঘোষণায় জানানো হয় যে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকায় প্রাদেশিক পরিষদ ভবনে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র রচনার জন্য ৩ মার্চ বুধবার ৯টায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেছেন। এদিকে ১৪ ও ১৫ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনার বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরেন।

ওয়ার্কিং কমিটি আলোচনা অনুমোদন করে এবং বঙ্গবন্ধুকে ‘জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা ও অধিকার আদায়ের জন্য যেকোনো পন্থা গ্রহণের পূর্ণ অধিকার প্রদান করে।’ ১৫ ফেব্রুয়ারি ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু চক্রান্তকারীদের এই মর্মে হুঁশিয়ার করে দেন যে, ‘ফ্যাসিস্ট পন্থা পরিহার করে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সংখ্যাগুরুর শাসন মেনে নিয়ে দেশের ঐক্য ও সংহতি বজায় রাখুন।

জনগণের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর ব্যবস্থা বানচাল করার যেকোনো উদ্দেশে তৎপর গণতান্ত্রিক রায় নস্যাৎকারীগণ আগুন নিয়ে খেলবেন না।’ তিনি আরো বলেন, ‘দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের দেওয়া অধিকারবলে আমরা ৬ দফার ভিত্তিতেই শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করব। সাত কোটি বাঙালির বুকে মেশিনগান বসিয়েও কেউ ঠেকাতে পারবা না।’ 
অন্যদিকে ১৫ ফেব্রুয়ারি ভুট্টো এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘আওয়ামী লীগের ৬ দফার ব্যাপারে আপোস বা পুনর্বিন্যাসের আশ্বাস পাওয়া না গেলে তার দল জাতীয় পরিষদের আসন্ন ঢাকা অধিবেশনে যোগদান করতে পারবে না।’ ১৭ ফেব্রুয়ারি ভুট্টো তার পার্টি অফিসে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের যে অধিবেশন শুরু হচ্ছে, বর্তমান পরিস্থিতিতে পিপল্স পার্টির জন্য তাতে যোগদান করা একেবারেই অর্থহীন।’

এর পর ১৮ ফেব্রুয়ারি ভুট্টো তার সহকর্মীদের উদ্দেশে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ, পিপলস পার্টি ও সেনাবাহিনীÑদেশে এই তিনটি শক্তিই আছে, আমরা কোনো চতুর্থ শক্তির কথা স্বীকার করি না।’ জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদান করতে অস্বীকার জ্ঞাপন করলে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় বিষয়াদি নিয়ে আলোচনার জন্য ভুট্টোকে আমন্ত্রণ জানান। ১৯ ফেব্রুয়ারি ভুট্টো ও ইয়াহিয়া খানের মধ্যে ৫ ঘণ্টাব্যাপী আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়।

সম্ভবত ১৭ জানুয়ারি লারকানা বৈঠক এবং ১৯ ফেব্রুয়ারি রাওয়ালপিন্ডি বৈঠকেই বাঙালি হত্যার চক্রান্ত ও নীল নকশা চূড়ান্ত রূপ লাভ করে। পিন্ডি থেকে করাচি ফিরে গিয়ে ভুট্টো স্পষ্ট জানিয়ে দেন, ‘জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদান না করার সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের কোনো ইচ্ছা তার নেই।’ ক্রমেই এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, পাকিস্তানের সামরিক চক্র ’৭০-এর নির্বাচনে বাঙালির অকুণ্ঠ রায়কে বানচাল করার জন্যে ভুট্টোকে ক্রীড়নক হিসেবে ব্যবহার করছে এবং ভুট্টো নিজেও সানন্দে ব্যবহৃত হচ্ছেন। 
ঘটনার ধারাবাহিকতায় দেখা যায়, ’৭০-এর নির্বাচনের ঐতিহাসিক রায় বানচালের ষড়যন্ত্র যতই স্পষ্ট হয়ে উঠছিল, বঙ্গবন্ধু ততই কঠোর-কঠিন সিদ্ধান্তের দিকে এগোচ্ছিলেন। ফেব্রুয়ারির ২২ তারিখে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান তার মন্ত্রিসভা বাতিল করে দেন এবং পিন্ডিতে গভর্নর সামরিক প্রশাসকদের নিয়ে এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করেন। ঐ বৈঠকে লারকানা ও রাওয়ালপিন্ডি বৈঠকের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ব্যবস্থাদি চূড়ান্ত করা হয়।

সামরিক চক্রের সঙ্গে মিলে ভুট্টো যে ভূমিকায় লিপ্ত তাতে এটা স্পষ্ট যে, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী কোনোভাবেই বাঙালিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না এবং ১ মার্চ ভুট্টোর সঙ্গে যোগসাজশে ইয়াহিয়া খান পূর্ব প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন। তাৎক্ষণিক ক্ষেভে-বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে  ঢাকা নগরী। ’৭০-এর নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করবে, শাসনতন্ত্র তৈরি করার জন্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে মিলিত হবে, জনমনে কাক্সিক্ষত এ রকম একটি অভিপ্রায়কে সমাধিস্থ করে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করার ঘোষণায় দাবানলের মতো জ্বলে উঠে বাংলার মানুষ, তারা ক্ষোভে-বিক্ষোভে ফেটে পড়ে।

এদিন পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো বলেন, ‘যদি তার পিপলস পার্টিকে বাদ দিয়ে ৩ মার্চ অধিবেশন বসে, তাহলে পেশোয়ার থেকে করাচি পর্যন্ত জীবনযাত্রা নীরব-নিথর করে দেওয়া হবে।’ এর পর পরই ষড়যন্ত্রকারীদের নীল নকশা অনুযায়ী বাংলার মানুষকে ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করার জন্য ’৭১-এর ১ মার্চ দুপুর ১টা ৫ মিনিটে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এক বেতার ভাষণে ৩ মার্চ তারিখে ঢাকায় আহূত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন।

ইয়াহিয়া খান তার ভাষণে বলেন, ‘আমি আমাদের জাতীয় পরিষদের উদ্বোধনী অধিবেশনের তারিখ ৩ মার্চ নির্ধারণের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছিলাম। বিগত কয়েক সপ্তাহে অবশ্য আমাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে কয়েকটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্ত ‘ আমাকে দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে যে, ঐকমত্যে পৌঁছবার পরিবর্তে আমাদের কোনো কোনো নেতা অনমনীয় মনোভাব প্রদর্শন করেছেন। ...সংক্ষেপে বলতে গেলে পরিস্থিতি এই দাঁড়িয়েছে যে, পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল, অর্থাৎ পাকিস্তান পিপল্স পার্টি এবং আরো কয়েকটি রাজনৈতিক দল ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদান না করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে।

এছাড়া ভারত কর্তৃক সৃষ্ট সাধারণ উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি সার্বিক অবস্থাকে আরো জটিল করে তুলেছে। অতএব আমি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান পরবর্তী কোনো তারিখের জন্য স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’ সংখ্যাগরিষ্ঠ আওয়ামী লীগ দলীয় প্রধান বঙ্গবন্ধু মুজিবের সঙ্গে কোনোরূপ আলোচনা ব্যতিরেকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া কর্তৃক একতরফাভাবে ঘোষিত এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিকভাবে বাংলার মানুষ ক্ষোভে-বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ঢাকা যেন আগ্নেয়গিরির মতো জ্বলে ওঠে।

বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ থেকে ছাত্ররা বের হয়ে আসে। ঘর থেকে জনতা ছুটে আসে রাজপথে, পল্টন ময়দান যেন জনসমুদ্র। হোটেল পূর্বাণীর চারদিকে জনস্রোত। ঢাকা শহরে স্লোগান আর স্লোগান। সংগ্রামী বাংলা সেদিন ছিল অগ্নিগর্ভ, দুর্বিনীত। কারও চাপিয়ে দেওয়া অন্যায় প্রভুত্ব মেনে নেওয়ার জন্য, কারও কলোনি বা করদরাজ্য হিসেবে থাকার জন্য বাংলার মানুষের জন্ম হয়নি।

বাংলার অপরাজেয় গণশক্তি সেদিন সার্বিক জাতীয় মুক্তি অর্জনের ইস্পাত কঠিন শপথের দীপ্তিতে ভাস্বর প্রিয় নেতাকে যেন দুর্লঙ্ঘ প্রাচীর ভেঙ্গে ফেলার নির্দেশ প্রদান করে উচ্চকণ্ঠ হয়েছিল এই স্লোগানে, ‘জাগো জাগো, বাঙালি জাগো’; ‘পদ্মা-মেঘনা-যমুনা, তোমার আমার ঠিকানা’; ‘তোমার নেতা আমার নেতা, শেখ মুজিব শেখ মুজিব’; ‘বঙ্গবন্ধু এগিয়ে চলো, আমরা আছি তোমার সাথে’; ‘তুমি কে আমি কে, বাঙালি বাঙালি’; ‘তোমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ’; ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, সোনার বাংলা মুক্ত করো’; ‘পিন্ডি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা’; ‘পাঞ্জাব না বাংলা, বাংলা বাংলা’; ‘ভুট্টোর মুখে লাথি মারো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’; ‘স্বাধীন করো স্বাধীন করো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’। ইয়াহিয়ার ঘোষণায় জনতার রুদ্র রোষে ঢাকা হয়ে পড়ে বিক্ষুব্ধ মিছিলের নগরী।

সেদিন হোটেল পূর্বাণীতে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির সভায় ৬ দফা ভিত্তিক শাসনতন্ত্রের খসড়া প্রণয়নের কাজ চলছিল। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণায় বিক্ষুব্ধ মানুষ হোটেল পূর্বাণীর সামনে এসে সমবেত হয়ে স্লোগানে স্লোগানে চারদিক প্রকম্পিত করে তুলেছিল। তখন বঙ্গবন্ধু হোটেলের সামনে এসে সবাইকে শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাবার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘অধিবেশন বন্ধ করার ঘোষণায় সারাদেশের জনগণ ক্ষুব্ধ। আমি মর্মাহত।

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া তার ওয়াদা ভঙ্গ করেছেন। আমি সংগ্রাম করে এ পর্যন্ত এসেছি। সংগ্রাম করেই মুক্তি আনবো। আপনারা ঐক্যবদ্ধ থাকুন।’ হোটেল পূর্বাণীতে দেশ-বিদেশের অগণিত সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুর মুখোমুখি হওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন। বৈঠক শেষে বঙ্গবন্ধু স্বভাবসুলভ দৃঢ়তা নিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ‘বিনা চ্যালেঞ্জে আমি কোনো কিছুই ছাড়ব না। ছয় দফার প্রশ্নে আপোস করব না। দুই থেকে পাঁচ তারিখ পর্যন্ত প্রতিদিন বেলা ২টা পর্যন্ত হরতাল চলবে।

সাতই মার্চ রেসকোর্স ময়দান থেকে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।’ পরে এক সংবাদ সম্মেলনে অসহযোগ আন্দোলনের প্রাথমিক কর্মসূচি ঘোষণা করেন তিনি এবং বলেন, ৬ মার্চ পর্যন্ত সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত হরতাল আর ৭ মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করবেন। বিকেল ৩ টায় ছাত্রলীগের উদ্যোগে পল্টন ময়দানে প্রতিবাদ সভা হবে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে পল্টন ময়দানের স্বতঃস্ফূর্ত জনসভায় যোগদান করি।

সেখানে আমি বক্তৃতায় বলি, ‘আর ৬ দফা ও ১১ দফা নয়। এবার বাংলার মানুষ ১ দফার সংগ্রাম শুরু করবে। আর এই ১ দফা হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। আজ আমরাও শপথ নিলামÑ বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধ সুশৃঙ্খল সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে।’ শতসহস্র মিছিলে জনসমুদ্রে পরিণত হলো পল্টন ময়দান। প্রতিবাদ সভায় আমরা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ও নির্দেশ মতো আন্দোলন-সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানাই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ছাত্র নেতৃবৃন্দকে ডেকে ‘স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠনের নির্দেশ দেন।

নেতার নির্দেশ পেয়ে ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ নূরে আলম সিদ্দিকী, শাজাহান সিরাজ, আ স ম আব্দুর রব, আব্দুল কুদ্দুস মাখন এক বৈঠকে বিকেলে ছাত্রলীগ ও ডাকসুর সমন্বয়ে ‘স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করেন। একমাত্র ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দই সবধরনের ঝুঁকির মধ্যে এ সিদ্ধান্ত নেয়। 
২ মার্চ, বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল পালিত হয়। তাঁর নির্দেশে সকাল ১১টায় ঢাকা বিশ্ববিদালয়ের কলাভবন প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভায় স্বাধীন বাংলার মানচিত্র খচিত পতাকা উত্তোলিত হয়। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে এ পতাকা উত্তোলন অনুষ্ঠানে নেতৃত্ব প্রদান করেন ছাত্রলীগ সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী, সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ, ডাকসু সহ-সভাপতি আ স ম আব্দুর রব এবং সাধারণ সম্পাদক আব্দুল কুদ্দুস মাখন।

পরে এ পতাকা নিয়ে আন্দোলিত রাজপথ মুখর হয়ে ওঠে স্লোগানে স্লোগানে, ‘জাগো জাগো, বাঙালি জাগো’; ‘পদ্মা-মেঘনা-যমুনা, তোমার আমার ঠিকানা’; ‘স্বাধীন বাংলার জাতির পিতা, শেখ মুজিব শেখ মুজিব’; ‘বঙ্গবন্ধু এগিয়ে চলো, আমরা আছি তোমার সাথে’; ‘তুমি কে আমি কে, বাঙালি বাঙালি’; ‘তোমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ’; ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, সোনার বাংলা মুক্ত করো’; ‘পিন্ডি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা’; ‘পাঞ্জাব না বাংলা, বাংলা বাংলা’; ‘ভুট্টোর মুখে লাথি মারো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’; ‘স্বাধীন করো স্বাধীন করো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’।

স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে ছাত্র নেতৃবৃন্দের বিশাল একটি মিছিল বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে সমবেত হয়। এদিন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গুলিতে ২ জন নাগরিক প্রাণ হারানোর সংবাদে বঙ্গবন্ধু এ ঘটনায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে বিবৃতি প্রদান করেন। ৩ মার্চ থেকে ৬ মার্চ পর্যন্ত সারাদেশে অর্ধদিবস হরতালের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। সামরিক কর্তৃপক্ষ সান্ধ্য আইন জারি করলে জনতা তা অমান্য করে ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর কুশপুত্তলিকা দাহ করে রাজপথে বিক্ষোভ মিছিল বের করে এবং সেনাবাহিনী বিনা উস্কানিতে গুলিবর্ষণ করলে নগরীর বিভিন্ন স্থানে মিছিল সহিংস হয়ে ওঠে।

৩ মার্চ আমাদের জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ দিন। এদিন বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ ও উপস্থিতিতে স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে পল্টন ময়দানে স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ, জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও জাতীয় সংগীত পরিবেশিত হয়। ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ সভায় সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ ‘স্বাধীনতার ইশতেহার’ পাঠ করেন।

ইশতেহারে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের সর্বাধিনায়ক হিসেবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম ঘোষণা করা হয়। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটিকে জাতীয় সংগীত নির্বাচিত করা হয়। লাখ লাখ মানুষের উপস্থিতিতে স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ অনুষ্ঠানটি ছিল আমাদের জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য দিন। এদিনের জনসভায় বঙ্গবন্ধু অহিংস-অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়ে তাঁর বক্তৃতায় অবিলম্বে সামরিক আইন প্রত্যাহার, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং সেনাবাহিনী ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়ার দাবি করেন।

জনতার উদ্দেশে অফিস-আদালত বন্ধ রেখে, খাজনা-ট্যাক্স না দেওয়ার নির্দেশ প্রদান করে অসহযোগ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। এদিনের ঐতিহাসিক সভায় আমার বক্তৃতায়ও বঙ্গবন্ধুর নির্দেশের প্রতিধ্বনি করে কর্মসূচি সফল করতে দেশবাসীর প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানাই। এদিন বাংলার মাটি শহীদদের রক্তে রঞ্জিত হয়। চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহত হয় ৭১ জন। সারাদেশ অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। বাংলার মানুষ ঐতিহাসিক সাতই মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কি নির্দেশ দেবেন, সে বিষয়ে অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থাকে।

লেখক : সদস্য, উপদেষ্টা পরিষদ, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ; সংসদ সদস্য
বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ 

[email protected]

×