ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ১৯ মে ২০২৫, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

মালয়েশিয়া কেন রোল মডেল

ড. ইউসুফ খান

প্রকাশিত: ২০:৫২, ১৮ জানুয়ারি ২০২৪

মালয়েশিয়া কেন রোল মডেল

মালয়েশিয়া দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম অধ্যুষিত একটি দেশ

মালয়েশিয়া দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম অধ্যুষিত একটি দেশ। পাহাড়ে ঘেরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ম-িত বহুজাতিক ও বহু ধর্মের অনুসারী শান্তিপ্রিয় দেশ। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি উন্নত ও ধনী দেশ হিসেবেও এর সুখ্যাতি রয়েছে। সিঙ্গাপুর ও ব্রুনাইয়ের পরই মালয়েশিয়ার অবস্থান। মাথাপিছু আয় ২৭ হাজার ৫০০ মার্কিন ডলার। অনেক দেশই মাথাপিছু আয়ের দিক থেকে উন্নত হলেও জনগণের ব্যক্তি জীবনে প্রকৃত আয় ও জীবনযাত্রার মান তেমন ভালো নয়। কিন্তু মালয়েশিয়া তার ব্যতিক্রম। ধনী-দরিদ্রের মধ্যে আয়ের পার্থক্য থাকলেও সব নাগরিকই সচ্ছল। বলতে গেলে বিশ্বের অপরাপর উন্নত দেশগুলোর মতো মালয়েশিয়াতেও সবার গাড়ি-বাড়ি ও প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র আছে। সবাই চিকিৎসাসেবা ও শিক্ষার সুযোগ সুবিধা পাচ্ছে।
মালয়েশিয়া বাংলাদেশের চেয়ে আয়তনে প্রায় আড়াইগুণ বড়। ১৩টি রাজ্য এবং ৩টি প্রদেশ নিয়ে গঠিত। জনসংখ্যা ৩ কোটি ৩৫ লাখ ৭০ হাজার। তার মধ্যে ৬০ শতাংশ মুসলিম, যাদের ভূমিপুত্র বলা হয়। কারণ, তারাই এই ভূমির আদিবাসী। ৩০ শতাংশ চাইনিজ ও ১০ শতাংশ ইন্ডিয়ান তথা হিন্দু, শিখ ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বী। রাজধানী শহর কুয়ালালামপুর। সরকারি ভাষা মালয়। মুদ্রা রিংগিত। দেশটিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম মালয়রা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী হলেও অর্থনৈতিক দিক থেকে চীনা বংশোদ্ভূত সংখ্যালঘু গোষ্ঠী প্রভাব বিস্তার করে আছে। তবে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিরাজমান। 
দেশটি কৃষিনির্ভর হওয়াতে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছিল। মাহাথির মোহাম্মদ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর পরই দেশটিতে অর্থনৈতিক বিপ্লব ঘটে। সারা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে মাত্র ২০ বছরের মধ্যে গরিব দেশ থেকে উন্নয়নশীল ও উন্নত দেশের দিকে অগ্রসর হয় দেশটি। তার কথা হলো পশ্চিম নয়, পূর্বই আমাদের আদর্শ। অর্থাৎ জাপান ও চীনকে অনুসরণ করা শুরু করলেন। কৃষিনির্ভরতা থেকে শিল্পায়নে জোর দিলেন। বিশ্বের বড় বড় কোম্পানিকে সুযোগ-সুবিধা দিয়ে দেশে বিনিয়োগ করার আহ্বান জানালেন। কল-কারখানা প্রতিষ্ঠা করার সঙ্গে সঙ্গে দেশীয় শ্রমিকের অভাব দেখা দিল। আর তখন বিদেশ থেকে বিশেষ করে বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া থেকে লাখ লাখ সস্তা শ্রমিক আমদানি করে কল-কারখানা চালু রাখলেন। এভাবে এক সময় তারা বিশ্ব বাজার দখল করে নেয়।
শিক্ষা খাতেও প্রচুর বিনিয়োগ করলেন। ’৭০-এর দশকে একসঙ্গে দেশের প্রায় দেড় লাখ ছাত্রছাত্রীক লন্ডনের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারি খরচে উন্নত শিক্ষার জন্য পাঠিয়ে দিলেন। যাদের বেশিরভাগই ছিল মালয়ী মুসলিম। ডিগ্রি শেষ করে প্রত্যেক ছাত্রছাত্রী নিজ দেশে ফিরে এসে শিক্ষকতা, বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, অফিস-আদালতে ও বিভিন্ন সেক্টরে কাজে মনোনিবেশ করলেন। অথচ অনেক মেধাবী ছাত্রছাত্রীকে ব্রিটিশ সরকার সে দেশে থাকা ও নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। একজন ছাত্রছাত্রীও সে প্রস্তাব গ্রহণ না করে নিজ দেশে গিয়ে উন্নয়নে শরিক হয়।
দেশটিতে ’৮০-এর দশকে উন্নয়নের প্রতীক ছিল পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের নমুনায় টুইন টাওয়ার বানিয়ে সারা দুনিয়াকে জানান দেয় যে, তারাও উন্নত দেশের সমপর্যায়ে পৌঁছার পথে। পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি বড় নিদর্শন। সর্বমোট ৯৩টি ফ্লোর, যা একসময়ে পৃথিবীর সর্বোচ্চ উঁচু বিল্ডিং ছিল। গ্রাউন্ড ফ্লোরে বিশাল শপিং মল। রাতে লাইট, পানির ফোয়ারা ও সংগীতের মূর্ছনায় সে এক অদ্ভুত অনুভূতি।

মালয়েশিয়া প্রথম দর্শনেই ভালো লেগে যাওয়ার মতো একটি দেশ। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ছিমছাম।  রাস্তার পাশে  ভিখারি তো দূরের কথা, পথচারীর দেখা পাওয়াও বিরল ব্যাপার। নেই  কোনো হৈচৈ বা কোলাহল। রাস্তাঘাটে একবারের জন্য হলেও গাড়ির হর্ন শুনিনি। দেওয়ালে কোনো পোস্টার চোখে পড়েনি। মিছিল-সমাবেশও দেখিনি। এর মানে এই নয় যে, সেখানে রাজনীতি নেই। 
মালয়েশিয়া যেহেতু একটি বহুজাতিক দেশ, তাই তাদের খাওয়া-দাওয়া, চাল-চলন ও পোশাক-পরিচ্ছদে রয়েছে বিস্তর ফারাক। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের মধ্যে যথেষ্ট সহনশীলতা দেখা গেলেও চাইনিজ কমিউনিটি অনেকটাই ফাস্ট লাইফ লিড করছে বলে মনে হয়েছে। মেয়েরা স্কার্ট আর স্লিভলেস শার্ট পরে যে ভাবে রাস্তাঘাটে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করে তা যেন পশ্চিমা দেশগুলোকেও হার মানায়। অথচ মুসলিম ছেলেমেয়েরা তাদের ধর্মীয় অনুশাসন ও শালীনতা বজায় রেখেই সর্বত্র চলাফেরা করছে এবং হোটেল-রেস্টুরেন্ট, দোকানপাট ও অফিস-আদালতে কাজকর্ম করছে। সবাই যার যার মতো ব্যস্ত। কে মুসলমান আর কে অমুসলমান এসব অপ্রয়োজনীয় প্রশ্ন তুলে অকারণে হৈচৈ বা বিতর্ক সৃষ্টি করার মতো পরিবেশ-পরিস্থিতি সেদেশে  নেই। এ জন্যই তারা এত উন্নতি করতে পেরেছে। 
মালয়েশিয়ার আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস ট্যুরিজম। কুয়ালালামপুরকে ট্যুরিস্টদের জন্য উন্মুক্ত রাখার লক্ষ্যে পুত্রজায়াতে তাদের প্রশাসনিক রাজধানী সরিয়ে নেওয়া হয়। এটি কুয়ালালামপুর থেকে প্রায় ২৯ মাইল দূরে অবস্থিত। প্রধানমন্ত্রীর অফিসসহ সব সরকারি অফিস স্থানান্তর করা হয়। পুত্রজায়া শহরটি দেখতে ছবির মতো। অনেকে এটিকে স্বপ্নের শহর মনে করেন।
মাহাথির মোহাম্মদ একটানা ২২ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকার পেছনে রয়েছে তার অসাধারণ নেতৃত্ব। এ জন্য শুধু নিজ দেশেই নয়, বিশ্বের বহু দেশেই একজন জনপ্রিয় নেতা হিসেবে পরিচিত ছিলেন তিনি। বাংলাদেশেও তিনি ছিলেন ব্যাপক জনপ্রিয়। মাহাথির স্বেচ্ছায় ক্ষমতা থেকে সরে না দাঁড়ালে হয়তো আরও দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকতে পারতেন। তিনি কখনো পশ্চিমা চাপের কাছে মাথা নত করেননি। একসময়ে গোটা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া যখন অর্থনৈতিক সংকটে পতিত হয়, সে সময়েও তিনি অন্যান্য দেশের মতো বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের ফর্মুলা অনুযায়ী অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের পথে হাঁটেননি। বিশ্বব্যাংকের ঋণ নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। মালয়েশিয়ায় কী দুর্নীতি নেই? মাহাথিরের ভাষায়, অবশ্যই আছে। তবে তা ন্যূনতম পর্যায়ে, টেবিলের নিচে। 
ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্রের উন্নতির সঙ্গে আমরা কখনো বাংলাদেশের তুলনা করব না। কারণ তারা কয়েকশ’ বছর ধরে উন্নয়ন পক্রিয়ায় রয়েছে। আর বাংলাদেশ স্বাধীনতা পেয়েছে ৫২ বছর আগে। এশিয়ার অনেক দেশ আছে যারা আমাদের কিছুটা আগে বা পরে স্বাধীনতা  লাভ করলেও আমাদের চেয়ে অনেক বেশি এগিয়ে আছে। মডেল হিসেবে আমরা যদি থাইল্যান্ড বা মালয়েশিয়ার কথা ধরি, তা হলে দেখি গত দুই দশকে তারা অবিশ্বাস্য উন্নতি করেছে।

আগের থাইল্যান্ড-মালয়েশিয়া আর এখনকার থাইল্যান্ড-মালয়েশিয়ায় যেন আকাশ পাতাল পার্থক্য। যুক্তরাষ্ট্র-জাপান এসে হাতে ধরে তাদের উন্নতি করে দেয়নি। মধ্যপ্রাচ্যের মতো তেলের টাকা দিয়েও এই উন্নতি কেনা হয়নি। একটু একটু করে হয়েছে এই উন্নতি। সরকারের সল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় উন্নতি এসেছে। বলিষ্ঠ নেতৃত্বের ফসল এই উন্নতি। 
মালয়েশিয়ার বড় বড় রাস্তার পাশে সাইনবোর্ডে লেখা দুটি  শব্দের ওপর চোখ আটকে যায়Ñ ‘গধষধুংরধ ইড়ষবয.’ মালয়েশিয়া বোলেহ কথাটার অর্থ ‘মালয়েশিয়াও পারে।’ এটি মাহাথির মোহাম্মদের চালু করা একটি স্লোগান। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মালয়েশিয়ার সম্মান ও মর্যাদা সুউচ্চে তুলে ধরার লক্ষ্যে দেশটিকে সবদিক থেকে একটি স্বনির্ভর রাষ্ট্রে পরিণত করার অভিপ্রায় নিয়ে স্লোগানটি চালু করা হয়েছিল। আজ ‘মালয়েশিয়া বোলেহ’ শুধু একটি স্লোগান নয়, এটি একটি স্পিরিট বা চেতনা, যা দেশটিকে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মর্যাদাপূর্ণ একটি আসনে নিয়ে গেছে। বিশ্বের কাছে কবে মালয়েশিয়ার মতো বড় গলায় আমরাও কবে বলতে পারব, ‘বাংলাদেশ বোলেহ’ অর্থাৎ বাংলাদেশও পারে। 

লেখক : চেয়ারম্যান
ব্যুরো বাংলাদেশ

×