
ছবি: সংগৃহীত
ইত্যাদি বাংলাদেশের একটি জনপ্রিয় টেলিভিশন ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান। ইত্যাদি প্রথম প্রচার হয় ১৯৮৯ সালে। বাংলাদেশ টেলিভিশনে তিন মাস পর পর প্রচারিত এই কৌতুকাশ্রয়ী ব্যাঙ্গাত্মক অনুষ্ঠানটির উপস্থাপক হানিফ সংকেত। ১৯৯০-এর দশকে শুরু হওয়া এই অনুষ্ঠানটি বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় অনুষ্ঠান হিসাবে স্থান করে নিয়েছে। অনুষ্ঠানটি প্রায় ৩৫ বছর ধরে প্রচারিত হচ্ছে। বিটিভির প্যাকেজ যুগের প্রথম প্যাকেজ ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ইত্যাদি।
বাংলাদেশের টিভিতে কত ধরনের অনুষ্ঠান এলো-গেল, কত কিছুর বদল হলো। বিটিভি দর্শক হারাল, স্যাটেলাইট যুগ এলো, এলো ইউটিউব-ওটিটির যুগ কিন্তু ইত্যাদি ঠিকই রয়ে গেল। মুঠোফোনের কল্যাণে হাতের মুঠোয় বিনোদন দুনিয়া নিয়ে বসে আছে দর্শক, তবু ইত্যাদির আবেদন এতটুকু কমেনি তাদের কাছে।
এর প্রধান আকর্ষণীয় দিক হলো সমাজের নানা অসংগতিকে বিদ্রুপ ও রসময় করে উপস্থাপন করা। তবে বর্তমানে এটি তিন মাস অন্তর অন্তর বাংলাদেশ টেলিভিশনে সম্প্রচার করা হয়। সাধারণত একটি নতুন ইত্যাদি মাসের পঞ্চম শুক্রবার রাত ৮ টার বাংলা সংবাদের পর এবং সংকলিত ইত্যাদি প্রতি মাসের প্রথম রবিবার রাত ১০ টার ইংরেজি সংবাদের পর সম্প্রচার করা হয়। এছাড়া প্রতি বছর ঈদ-উল-ফিতর এর পরদিন রাত ১০ টার ইংরেজি সংবাদের পরেও অনুষ্ঠানটি সম্প্রচারিত হয়।
‘এই মিলনায়তন ও এই মিলনায়তনের বাইরে যে যেখানে বসে এই অনুষ্ঠান দেখছেন আপনাদের সবাইকে জানাই সাদর সম্ভাষণ’- চিরচেনা এই শব্দমালা নিয়ে ইত্যাদিতে নিয়মিত দর্শকদের সম্ভাষণ জানিয়ে আসছেন হানিফ সংকেত। বহুল জনপ্রিয় ইত্যাদি ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশের আপামর জনগণের কাছে পৌঁছে গেছেন। আমরা কালের বিবর্তনে পরিবর্তন হয়ে গেলেও ইত্যাদি আছে আগের মতোই, আছেন হানিফ সংকেত এবং হানিফ সংকেতের ছন্দময় সব সংলাপ, আইডিয়া, গানের কথা, ভয়েস ওভার। দর্শক যতক্ষণ ইত্যাদি দেখে, ততক্ষণ তারা হানিফ সংকেতকেই দেখেন। এ কারণেই ইত্যাদি আর হানিফ সংকেত একে অন্যের পরিপূরক।
ফজলে লোহানীর ‘যদি কিছু মনে না করেন’ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে প্রথম দেখা যায় হানিফ সংকেতকে। ফজলে লোহানীই তার উপস্থাপনার গুরু। পরবর্তী সফল ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ও সফল উপস্থাপক হিসাবে ইত্যাদিতে আগমন ঘটে হানিফ সংকেতের। ইত্যাদি শুধু বিনোদনে নয় মানবিক বিষয় উপস্থাপন, সামাজিক বাস্তবতা তুলে ধরা, মানুষের কল্যাণে অবদান রাখা, প্রতিভা অন্বেষণ ও প্রতিষ্ঠিত করা এসবের জন্য একটি আদর্শ অনুষ্ঠান। নব্বই দশকের প্রজন্মের কাছে এ অনুষ্ঠান জনপ্রিয়তার কোন উচ্চতায় ছিল সেটি নতুন করে বলবার দরকার নেই।
হানিফ সংকেত একমাত্র উপস্থাপক যিনি কোনো জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে নিয়মিতভাবে দর্শকদের গাছ উপহার দিয়েছেন। তার ভাষায় গাছ হলো ‘পরিবেশবন্ধু'। তিনিই একমাত্র উপস্থাপক যিনি ইত্যাদির পাশাপাশি মেরিল প্রথম আলো পুরস্কার অনুষ্ঠানে দর্শক চাহিদায় সেরা উপস্থাপক। টিভি ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানের প্রযোজনাশিল্পে তিনি অন্যতম সেরা পথ প্রদর্শক। তার প্রযোজনায় অন্যান্য ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান যেমন ‘ঝলক, ঈদ আনন্দমেলা, কথার কথা’ এগুলো প্রচার হতো।
ইত্যাদিতে নিয়মিত পর্বগুলোর মধ্যে বিষয়ভিত্তিক কৌতুক, নানা-নাতি, চিঠিপত্র, দর্শক পর্ব, বিদেশি পর্ব, মামা-ভাগ্নে, স্যাটায়ার (যেমন কাশেম টিভি রিপোর্ট) উল্লেখযোগ্য। নানা-নাতির নানা চরিত্রের অভিনেতা অমল বোস স্বর্গলোকপ্রাপ্তি হলে নানা-নাতি পর্বটি নানী-নাতি পর্বে পরিবর্তিত হয়। এই পর্বে অধিকাংশ সময়ই নাতির সাথে নানার কিংবা নানির সম্পর্ক মধুরতায় শুরু হয় এবং নাতির অতিসচেতনতায় তিক্ততায় গিয়ে সমাপ্ত হয়। মামা-ভাগ্নে পর্বে দেখা যায় ভাগনে খুব ব্যবসা-প্রবণ এবং ব্যবসায়ের নতুন নতুন ফন্দি সে খুঁজতে থাকে। কিন্তু সব ফন্দির মধ্যেই জনস্বার্থকে হেয় করার বিষয়টা খুব বেশি চোখে পড়ে বলে বিদেশ ফেরত মামা সব সময়ই ভাগ্নের ব্যবসায়ে বাধা সৃষ্টি করেন এবং পর্বের শেষাংশে নৈতিকতার বিষয়টি ধরিয়ে দিয়ে ইতি টানেন। ইত্যাদির পুরোনো পর্বগুলোতে বিদেশি বিভিন্ন কমেডি সিরিজের দৃশ্যকে ব্যাঙ্গাত্মক বাংলা করে উপস্থাপন করা হতো। পর্বগুলোতে কণ্ঠ দিতেন স্বয়ং হানিফ সংকেত এবং সহশিল্পীবৃন্দ। পরবর্তীতে তাঁর জনপ্রিয়তা দেখে অনেক ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানই এই ধারণায় অনুবাদের চেষ্টা শুরু করে।
অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত দর্শকদের মধ্য থেকে প্রয়োজনীয় সংখ্যক দর্শক নির্বাচনের ক্ষেত্রে অভিনব সব কৌশল ব্যবহার করে দর্শকদের মুগ্ধ করেন হানিফ সংকেত। কখনওবা সব দর্শকের হাতে বেলুন দিয়ে তার মধ্যে ব্যতিক্রম বেলুনওয়ালাদের মঞ্চে আহ্বান করেন, কখনও সবাইকে দেশীয় বাদ্যযন্ত্রের ক্ষুদ্রাকৃতি দিয়ে তার মধ্যে নির্দিষ্ট কিছু ধরনের বাদ্যযন্ত্রধারীদের মঞ্চে আহ্বান করেন।
এছাড়া অনুষ্ঠানস্থলে বিভিন্ন পন্থায় উপস্থিত দর্শকদের থেকে দুজন বা চারজন নির্বাচন করেন। দর্শক নির্বাচনে অধিকাংশক্ষেত্রে থাকে দেশভিত্তিক সাধারণ জ্ঞানের প্রশ্ন। নির্বাচিত দর্শকদের করতালির মাধ্যমে মঞ্চে আহ্বানের পর তাদের জন্য থাকে বিভিন্ন রকম পরীক্ষা। কখনও বাংলাদেশের বিভিন্ন ধারার সঙ্গীতকারদের গান ও বাদ্য বাজিয়ে দর্শকদের তার ধরন শনাক্ত করতে দেয়া হয়, কখনও কোনো এলাকার ঐতিহ্য নিয়ে গান তৈরি করে গানের মধ্য থেকে অধিকাংশ সংখ্যক ঐতিহ্যকে মনে রাখতে বলা হয় ইত্যাদি। বিজয়ীদের সাধারণত কম্পিউটার বা অন্যান্য গৃহস্থালি সামগ্রী উপহার দেয়া হয়, তবে নির্বাচিত সবার জন্যই থাকে হানিফ সংকেতের ভাষায় "আমাদের জন্য সব সময়কার মহা মূল্যবান এই বই এবং পরিবেশ বন্ধু গাছ"।
বহুকাল আগে থেকেই ইত্যাদিতে হানিফ সংকেতের নিজস্ব ক'জন শিল্পী ব্র্যাকড্যান্সের মাধ্যমে বিভিন্ন প্যারোডি গান পরিবেশন করে থাকেন। কখনও মাইকেল জ্যাকসনের জাস্ট বিট ইট, কখনও হিন্দি চলচ্চিত্রের গানকে প্যারোডি করে বাংলাদেশের কোনো সামাজিক অবক্ষয়, কিংবা ভুল ধারণা, অসংগতিকে উপস্থাপন করে থাকেন তারা।
ইত্যাদির অর্জনের তালিকা অল্প কথায় লিখে শেষ হবে না। নিবেদিতপ্রাণ মানুষের সন্ধানে সারা দেশে ছুটে বেড়ায় ইত্যাদি টিম। প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রচারবিমুখ আলোকিত মানুষদের তুলে এনেছেন বরাবরই, যাদের অনেকেই পরবর্তী সময়ে পেয়েছেন রাষ্ট্রীয় সম্মান। ভেজাল বিরোধী আন্দোলন, বিশুদ্ধ পানি ও পয়োনিষ্কাশন, পানির অপচয় রোধ, গ্যাসের অপব্যবহার রোধ, বৃক্ষরোপণ, শিক্ষা, পরিবেশদূষণ, স্বাস্থ্য সচেতনতা, সড়ক দুর্ঘটনা রোধ, অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধ, শিশুশ্রম, শিশুদের খেলার মাঠ, প্রতিবন্ধীদের ওপর প্রতিবেদন, অসুস্থ শিল্পী ও মানুষকে নিয়ে মানবিক প্রতিবেদন থাকে প্রায় প্রতি পর্বেই। খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল নিরোধকল্পে প্রথম মোবাইল কোর্ট চালু হয়েছিল ইত্যাদির উদ্যোগেই। গণপরিবহনের পেছনে লেখা কুরুচিপূর্ণ অশোভন স্লোগান হটিয়ে শিক্ষামূলক স্লোগান লেখার রীতি শুরু হয়েছে ইত্যাদির মাধ্যমে। নগর ছাদ বাগানের প্রতি মানুষের আগ্রহ তৈরি করেছে ইত্যাদি। এমন উদাহরণ আছে শতাধিক।
বিবিসিসহ দেশের প্রতিটি জরিপেই দেখা গেছে, ইত্যাদি দেশের সেরা টিভি অনুষ্ঠান এবং দেশের ৭৫ শতাংশ টিভি দর্শক এই অনুষ্ঠান দেখে থাকে। এছাড়া হানিফ সংকেত তার কার্যক্রমের জন্য ২০০৫ সালে মেরিল প্রথম আলো পুরস্কার, ২০১০ সালে একুশে পদক, ২০১৪ সালে জাতীয় পরিবেশ পদক এবং দেশে-বিদেশে বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।
সাব্বির