ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ১৯ মে ২০২৫, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

নীল জলরাশি ঘেরা মালদ্বীপ

সৌন্দর্যের পাশাপাশি সংগ্রামে টিকে থাকা এক দ্বীপরাষ্ট্র

জীবন রহমান মহন, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, মালদ্বীপ

প্রকাশিত: ০১:৩০, ১৯ মে ২০২৫

সৌন্দর্যের পাশাপাশি সংগ্রামে টিকে থাকা এক দ্বীপরাষ্ট্র

ছবিঃ সংগৃহীত

ভরত মহাসাগরের বুকে বিস্তৃত এক স্বপ্নরাজ্যের নাম মালদ্বীপ। নীল জলরাশি, প্রবালদ্বীপ আর বিলাসবহুল রিসোর্টের জন্য বিশ্বব্যাপী পরিচিত এই দেশটি শুধুমাত্র পর্যটনের নয় এটি এখন জলবায়ু পরিবর্তনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকা, উন্নয়ন ও অস্তিত্বের লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়া একটি সত্যিকারের আধুনিক রাষ্ট্র।

মালদ্বীপের অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিমে, শ্রীলঙ্কা থেকে প্রায় ৭০০ কিলোমিটার দক্ষিণে এবং ভারতের কেরালা উপকূল থেকে প্রায় ৪০০ কিলোমিটার পশ্চিমে। এটি মূলত ১,১৯০টি ছোট-বড় প্রবাল দ্বীপ নিয়ে গঠিত, যা ২৬টি প্রাকৃতিক অ্যাটলে বিভক্ত।

দেশটির মোট আয়তন প্রায় ২৯৮ বর্গকিলোমিটার, যা ভৌগোলিকভাবে অত্যন্ত ছোট হলেও এর সমুদ্রসীমা বিশাল। মালদ্বীপের মূল ভূখণ্ড অনেকখানি বিচ্ছিন্ন এবং নিচু; সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে গড় উচ্চতা মাত্র ১.৫ মিটার, যা বিশ্বে সর্বনিম্ন। মালদ্বীপের মোট জনসংখ্যা প্রায় ৫ লাখ ২০ হাজার (২০২৪ সালের প্রাক্কলিত তথ্য অনুযায়ী)। এদের মধ্যে রাজধানী মালের জনসংখ্যাই প্রায় ২ লাখের কাছাকাছি, ফলে এটি বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ রাজধানীগুলোর একটি। সরকারিভাবে মালদ্বীপের ভাষা ধিভেহি, তবে ইংরেজি ব্যাপকভাবে প্রচলিত, বিশেষ করে প্রশাসনিক ও পর্যটন খাতে। এখানে ইসলাম রাষ্ট্রধর্ম এবং ১০০% মুসলিম জনসংখ্যা রয়েছে, যা সংবিধানে বাধ্যতামূলকভাবে নির্ধারিত।

মালদ্বীপ বিশ্বের অন্যতম বিলাসবহুল পর্যটন গন্তব্য। এখানে বর্তমানে ১৭০টিরও বেশি রিসোর্ট আইল্যান্ড রয়েছে, যেগুলো স্বতন্ত্র দ্বীপে গড়ে তোলা হয়েছে। প্রতিটি রিসোর্টে আছে নিজস্ব বিমানঘাঁটি, নিরাপত্তা, পানীয় জল ব্যবস্থাপনা ও বর্জ্য পরিশোধন কেন্দ্র।প্রতি বছর প্রায় ২০ লক্ষ আন্তর্জাতিক পর্যটক মালদ্বীপ ভ্রমণ করেন। পর্যটন খাত থেকে দেশটির মোট জাতীয় আয়ের প্রায় ৭০ শতাংশ আসে। পর্যটন শিল্পে প্রধানত কাজ করেন বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা ও ফিলিপাইনের নাগরিকরা।মালদ্বীপের অর্থনীতি মূলত পর্যটন, মৎস্যশিল্প এবং বৈদেশিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল। এখানে শিল্পায়ন খুবই সীমিত এবং স্থানীয়ভাবে খাদ্য উৎপাদনও প্রায় নেই বললেই চলে। অধিকাংশ খাদ্য ও ভোগ্যপণ্য আমদানিনির্ভর হওয়ায় জীবনযাত্রার ব্যয় অনেক বেশি।

একটি ছোট পরিবারকে মাসে চলতে গেলে গড়ে ১,০০০ থেকে ১,৫০০ মার্কিন ডলার ব্যয় হয়, যা স্থানীয় নাগরিকদের জন্য অনেকসময় কষ্টসাধ্য হয়ে ওঠে। তবে রাষ্ট্রীয় সেবা ও সাবসিডি ব্যবস্থা মোটামুটি ভালো, বিশেষত স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা খাতে।

মালদ্বীপের নাগরিকদের জীবনশৈলী আধুনিক হলেও ধর্মীয় অনুশাসন বেশ কঠোরভাবে পালিত হয়। নারীরা হিজাব পরে থাকেন এবং ইসলামি শরিয়া আইন বিচারব্যবস্থার অন্যতম অংশ। এখানকার পরিবারগুলো সাধারণত যৌথ পরিবারে বসবাস করেন এবং আত্মীয়তার বন্ধন দৃঢ়।

রাজধানী মালেতে অতিরিক্ত জনসংখ্যা ও যানজট একটি বড় সমস্যা। এখানে জায়গার সংকট এতটাই যে, বাসার ভাড়া দক্ষিণ এশিয়ার অনেক বড় শহরের চেয়েও বেশি। তবে দ্বীপগুলোর জীবন শান্তিপূর্ণ এবং প্রাকৃতিকভাবে অত্যন্ত মনোরম।

মালদ্বীপ বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর একটি। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে অনেক দ্বীপ ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন, আগামী ৫০ থেকে ১০০ বছরের মধ্যে মালদ্বীপের একটি বড় অংশ পানির নিচে চলে যেতে পারে। এই ভয়াবহ সম্ভাবনা মোকাবেলায় মালদ্বীপ সরকার আন্তর্জাতিক মহলে ‘জিরো কার্বন’ লক্ষ্য অর্জন, পরিবেশবান্ধব টেকসই রিসোর্ট ও পুনর্ব্যবহারযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধির উদ্যোগ নিয়েছে।

নোভা

×