ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৮ মে ২০২৫, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

ইতিহাসে জাদুঘরের গুরুত্ব

শ্যামল শীল

প্রকাশিত: ১৮:২৬, ১৮ মে ২০২৫

ইতিহাসে জাদুঘরের গুরুত্ব

জাদুঘর আমাদের ইতিহাস আর ঐতিহ্যের এক নমুনা সংগ্রহশালা। দেশের ঐতিহাসিক প্রত্নতাত্ত্বিক, নৃ-তাত্ত্বিক, ভূতাত্ত্বিক শিল্পকলা, প্রাকৃতিক ও প্রাণিবিষয়ক নমুনা সংগ্রহ, সংরক্ষণ প্রদর্শন ও গবেষণার উদ্দেশ্যে জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮ মে আন্তর্জাতিক জাদুঘর দিবস। ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল অব মিউজিয়াম (আইকম) ১৯৭৭ সালে মস্কোয় অনুষ্ঠিত ১২তম সাধারণ সভায় প্রতি বছর ১৮ মে বিশ্ব জাদুঘর দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ১৯৭৮ সালের ১৮ মে প্রথমবারের মতো বিশ্ব জাদুঘর দিবস পালিত হয়। বিশ্বের অন্য দেশের মতো বাংলাদেশে বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দিবসটি পালন করা হয়।
বিশ্বের প্রথম জাদুঘর স্থাপিত হয় কায়রো-মিশরে। দ্বিতীয় শতাব্দীতে মিসরে টলেমি শাসনামলে আলেকজান্দ্রিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়। এশিয়া মহাদেশে জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয় ১৭৮৪ সালের ১৫ জানুয়ারি এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। ব্রিটিশদের মাধ্যমে উপমহাদেশে জাদুঘরের ধারণা তৈরি হয়। ভারতীয় এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্যরা জাদুঘর প্রসারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এশিয়াটিক সোসাইটি পৃষ্ঠপোষক লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংস কলকাতার পার্কস্ট্রিটে জাদুঘর নির্মাণের জন্য জমির ব্যবস্থা করে দেন এবং ১৮০৮ সালে ভবন নির্মাণের কাজ শেষ হয়। উপমহাদেশের প্রথম জাদুঘর ‘এশিয়াটিক সোসাইটিক মিউজিয়াম’ ১৮১৪ সালে প্রতিষ্ঠি হয়।
১৮৫৬ সালের ১ নভেম্বর ‘দি ঢাকা নিউজ’ পত্রিকায় প্রথম ঢাকায় একটি জাদুঘর প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে সংবাদ প্রকাশিত হয়। তবে ১৯ শতকে জাদুঘর প্রতিষ্ঠার বিষয়ে তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ অপ্রত্যাশিতভাবে ঢাকায় জাদুঘর প্রতিষ্ঠার সুযোগ সৃষ্টি করে। তবে ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রহিত হওয়ায় সরকারি উদ্যোগে জাদুঘর স্থাপনের প্রচেষ্টা থেমে যায়। কিন্তু ঢাকার বিশিষ্ট নাগরিকরা জাদুঘর প্রতিষ্ঠার জন্য সোচ্চার হন। ১৯১২ সালের ২৫ জুলাই বাংলার তৎকালীন গভর্নর লর্ড কারমাইকেল ঢাকায় আগমন উপলক্ষে নর্থব্রুক হলে তাকে নাগরিক সংবর্ধনা দেওয়া হয়। এই অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট নাগরিকরা ঢাকায় একটি জাদুঘর স্থাপনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে তিনি ২ হাজার রুপি মঞ্জুর করেন। ১৯১৩ সালের ৫ মার্চ জাদুঘর স্থাপনের সরকারি অনুমোদনের গেজেট প্রকাশিত হয়। ১৯১৩ সালের ২০ মার্চ তৎকালীন সচিবালয়ে (বর্তমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল) একটি কক্ষে জাদুঘরের নিদর্শন সংরক্ষণের কার্যক্রম শুরু হয়। ১৯১৩ সালের ৭ আগস্ট লর্ড কারমাইকেল ঢাকা জাদুঘরের উদ্বোধন করেন। ১৯১৪ সালের ৬ জুলাই নলিনীকান্ত ভট্টশালীকে জাদুঘরের কিউরেটর নিযুক্ত করা হয়। ১৯১৪ সালের ২৫ আগস্ট সর্বসাধারণের জন্য জাদুঘর খুলে দেওয়া হয়। জাদুঘরের নিদর্শন সংখ্যা ক্রমেই বাড়তে থাকলে স্থান সংকুলান না হওয়ায় ১৯১৫ সালের জুলাই মাসে ঢাকার নায়েব নাজিমদের বারোদুয়ারি ভবন নিমতলীতে জাদুঘরটি সরিয়ে নেওয়া হয়। ১৯৮৩ সালের ১৭ নভেম্বর শাহবাগ জাদুঘরের নিজস্ব আধুনিক ভবনে স্থানান্তরিত করা হয়। শাহাবাগে ৮.৬৩ একর জমির ওপর একটি চারতলা আধুনিক ভবনে বাংলাদেশের জাতীয় জাদুঘর অবস্থিত। এই জাদুঘরে ৪৪টি প্রদর্শনী কক্ষ, ৩টি অডিটোরিয়াম, ১টি গ্রন্থাগার ও ২টি অস্থায়ী প্রদর্শনী কক্ষ রয়েছে। জাদুঘরে সংগৃহীত নিদর্শন রয়েছে ৮৫ হাজারের বেশি।
বাংলাদেশের প্রথম জাদুঘর বরেন্দ্র জাদুঘর ১৯১০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। বরেন্দ্র জাদুঘরে প্রায় ৯ হাজার পূরাকীর্তি রয়েছে। রাজধানী ঢাকা শহর, বিভাগীয় শহর, জেলা শহর ও উপজেলায় জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশে জাদুঘরের সংখ্যা শতাধিক। আমাদের দেশেও বিভিন্ন ক্যাটাগরির জাদুঘর রয়েছে। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর (ঢাকা), মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর (ঢাকা), স্বাধীনতা জাদুঘর (ঢাকা), আহসান মঞ্জিল জাদুঘর (ঢাকা), বাংলাদেশ ব্যাংক টাকা জাদুঘর (ঢাকা), সামরিক জাদুঘর (ঢাকা), প্রাণী জাদুঘর (ঢাকা) দিয়াশলাই জাদুঘর (ঢাকা), বরেন্দ্র জাদুঘর (রাজশাহী), জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘর (চট্টগ্রাম), পানি জাদুঘর (কুয়াকাটা), পাথর জাদুঘর (পঞ্চগড়), নৌকা জাদুঘর (লৌহজং) ইত্যাদি। ভিন্ন ভিন্ন নিদর্শন সংরক্ষণে জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হলেও এসব জাদুঘরের লক্ষ্য অভিন্ন।
অতিত ও বর্তমানের সেতুবন্ধ হচ্ছে জাদুঘর। জাদুঘর দেশের গৌরবময় ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সাক্ষ্য বহন করে। নিদর্শনভিত্তিক গবেষণা ও শিক্ষা বিস্তারের জাদুঘর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। একটি দেশের হাজার বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও সভ্যতার সঙ্গে সেই দেশের পরিচয় তুলে ধরে জাদুঘর। দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য জানার জন্য জাদুঘর পরিদর্শন করতে হবে। বাংলাদেশ একটি সু-প্রাচীন সভ্যতার দেশ। আমাদের রয়েছে গৌরবদ্বীপ্ত ইতিহাস। পর্যটকরা জাদুঘর পরিদর্শনে আকৃষ্ট হচ্ছে। প্রতিদিন প্রায় ৫ হাজার দর্শনার্থী বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর পরিদর্শন করছেন। দেশের পর্যটনশিল্পকে সমৃদ্ধ করতে জাদুঘর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

লেখক : সাবেক শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

 

 

 

প্যানেল

×