
বর্ষাকাল আসে এক বিশেষ রকম আবহ নিয়ে। গরমের ক্লান্তি দূর করে, পরিবেশ ঠান্ডা করে, প্রকৃতিকে সুন্দর করে তোলে। আমাদের দেশে গরম পড়লে মানুষ হাঁসফাঁস করে। রোদে ঘাম ঝরে, রাস্তা গরম হয়ে যায়, আর পানি খাওয়ার তৃষ্ণা বাড়ে। তখন সবাই অপেক্ষা করে একটু বৃষ্টির জন্য। কারণ বৃষ্টি হলে গরম কিছুটা কমে আসে, হাওয়া ঠান্ডা হয়, পরিবেশটা একটু আরামদায়ক লাগে। তাই বৃষ্টি এলে অনেকেই স্বস্তি পান, ভালো লাগে। বৃষ্টির সময় কিছু অনুভব একদম আলাদা। অনেকেই বৃষ্টির দিনে জানালার পাশে বসে চা খেতে ভালোবাসেন। শিশুরা কদম ফুল হাতে নেয়, কেউ ভিজে খেলে, কেউ ছাতা মাথায় দিয়ে ঘোরে। স্কুল ছুটি হয়ে গেলে একসাথে হেঁটে বাড়ি ফেরা—এগুলো বর্ষার সঙ্গেই জড়িয়ে আছে।
কিন্তু এই বৃষ্টিই আবার অনেক সময় আমাদের জন্য বিপদ ডেকে আনে। বিশেষ করে ঢাকায়, যেখানে রাস্তাঘাট ভালো না, ড্রেনেজ সিস্টেম ঠিকভাবে কাজ করে না- সেখানে বৃষ্টি মানেই ভোগান্তি। ছোট থেকে বড়, সব শ্রেণির মানুষ এই ভোগান্তির শিকার হয়। তাই বলা যায়, বৃষ্টি যেমন একদিকে স্বস্তি দেয়, অন্যদিকে দুর্ভোগও বাড়ায়। ঢাকার রাস্তায় একটানা এক-দুই ঘণ্টা বৃষ্টি হলেই অনেক জায়গায় পানি জমে যায়। বিশেষ করে মিরপুর, রামপুরা, মালিবাগ, বাড্ডা, শ্যামলী, পুরান ঢাকা, মোহাম্মদপুর, উত্তরা- এসব এলাকায় জলাবদ্ধতা নিয়মিত ঘটনা। গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়, রিকশা চলতে পারে না, মানুষ হাঁটতেও পারে না। অফিসগামী মানুষদের সময়মতো পৌঁছানো কঠিন হয়ে যায়। স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীরাও সমস্যায় পড়ে। অনেকেই নোংরা পানি ভেঙে যেতে বাধ্য হন।
এই পানি শুধু বৃষ্টি নয়- ড্রেন থেকে উঠে আসা ময়লা, নোংরা, কখনো কখনো পয়ঃবর্জ্য মিশে যায় তাতে। এতে করে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ে। পা কাটলে ইনফেকশন হতে পারে, নানা ধরনের পানিবাহিত রোগও ছড়াতে পারে। অথচ এসব ঘটনা ঘটে প্রায় প্রতি বছর। কিন্তু সমস্যার স্থায়ী কোনো সমাধান হয় না। কখনো দেখা যায়, রাস্তার পানি এতটাই জমে যায় যে, বাসা-বাড়িতেও ঢুকে পড়ে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, দোকান, ফ্ল্যাট- সব জায়গা ভিজে যায়। মালপত্র নষ্ট হয়, মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অনেক সময় গাড়ি বন্ধ হয়ে পড়ে রাস্তায়, ইঞ্জিন নষ্ট হয়ে যায়। এতে শুধু ব্যক্তি না, পুরো অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ব্যাহত হয়।
আরেকটি বড় সমস্যা হলো, ড্রেনগুলোর মুখ বন্ধ থাকে। প্লাস্টিক, পলিথিন, বোতল, কাগজ- নানান ময়লা আবর্জনা পড়ে থাকে ড্রেনে। ফলে পানি নামতে পারে না। এই সমস্যা শুধু সরকার বা সিটি করপোরেশনের কারণে নয়, আমরা সাধারণ মানুষ নিজেরাও দায়ী। আমরা নিজেরাই রাস্তার পাশে ময়লা ফেলি, ডাস্টবিন ব্যবহার করি না। পরে সেই ময়লাই ড্রেন বন্ধ করে দেয়। বিদ্যুৎ বিপর্যয়ও একটা বড় সমস্যা। বৃষ্টির সময় অনেক এলাকায় বিদ্যুৎ চলে যায়, আবার ফিরতেও সময় নেয়। এতে অনেক সময় বাড়িতে পানির মোটর চলে না, ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়, ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনা বিঘ্নিত হয়, বাসার কাজেও সমস্যা হয়। বৃষ্টির সময় অ্যাম্বুলেন্স চলাচলও ব্যাহত হয়। কেউ যদি অসুস্থ হয় বা হাসপাতাল যেতে হয়, তখন রাস্তায় আটকে পড়লে বিপদ বাড়ে। একদিকে রাস্তার পানি, অন্যদিকে গাড়ির জ্যাম—সব মিলিয়ে একটা বিশৃঙ্খল অবস্থা তৈরি হয়।
প্রশ্ন হচ্ছে- এই সমস্যা কি নতুন? না, এটা বহু বছরের পুরনো সমস্যা। প্রতি বছর বৃষ্টি আসে, জলাবদ্ধতা হয়, মানুষ কষ্ট পায়। কিন্তু বড় কোনো পরিবর্তন দেখা যায় না। কিছু জায়গায় মাঝে মাঝে কাজ হয় বটে, কিন্তু তা সাময়িক। স্থায়ী সমাধান দেখা যায় না।
সরকার, সিটি করপোরেশন ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর সমন্বয় খুব দরকার। পরিকল্পিতভাবে নতুন ড্রেনেজ ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে, পুরনো ড্রেনগুলো পরিষ্কার রাখতে হবে, নিয়মিত তদারকি বাড়াতে হবে। শহরের নতুন ভবন ও রাস্তাঘাট তৈরির সময় বৃষ্টির পানি কোথায় যাবে, সে চিন্তা করেই পরিকল্পনা নিতে হবে। তবে শুধু সরকার নয়, আমাদের নাগরিক দায়িত্বও গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যদি রাস্তার পাশে ময়লা না ফেলি, ডাস্টবিন ব্যবহার করি, পলিথিন না ছড়াই- তাহলে অনেক সমস্যাই কমে যাবে। সচেতনতা ছাড়া কোনো সমাধানই সম্ভব নয়।
সবশেষে বলা যায়, বৃষ্টি আমাদের প্রকৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এটি না হলে ফসল হয় না, পানির সংকট দেখা দেয়। কিন্তু বৃষ্টি যেন অভিশাপে পরিণত না হয়, সেজন্য আমাদের সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। পরিকল্পিত নগরায়ণ, দায়িত্বশীল প্রশাসন, আর সচেতন নাগরিক- এই তিনটি জিনিস একসাথে কাজ করলে তবেই বৃষ্টি হবে শুধু স্বস্তির, দুর্ভোগের নয়।
লেখক : শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
প্যানেল