
ছবি: দৈনিক জনকন্ঠ
দুর্গম পাহাড়ের যেখানে এখনো শিক্ষার আলো পৌঁছেনি, শহরে রেখে সন্তানকে পড়ানোর সামর্থ্য নেই যাঁদের, তাঁদের জন্য আশীর্বাদ ‘আরোং আনৈই’। বান্দরবানের টংকাবতীতে এই ছাত্রাবাস গড়ার পেছনে রয়েছেন স্বপ্নদ্রষ্টা এক যুবক। তাঁর নাম সিংলক ম্রো। শুধু এটি নয়, দুর্গম পাহাড়ে শিশুদের শিক্ষার সুযোগ করে দিতে থানচির ডিম পাহাড়ে আরেকটি ছাত্রাবাস প্রতিষ্ঠায়ও বড় ভূমিকা রয়েছে তাঁর।
বান্দরবানের থানচির মায়ানমার সীমান্তসংলগ্ন নেপিউপাড়ায় থাকেন জুম চাষি মেনরিং ম্রো। পাহাড়-জঙ্গলঘেরা এই গ্রামে কোনো স্কুল নেই। নিজে পড়াশোনা না করলেও স্বপ্ন দেখতেন স্কুলে যাবে ছেলে। মেনরিংয়ের সেই স্বপ্ন এখন সত্যি।
তাঁর ছেলে মেনকও ম্রো নিয়মিত স্কুলে যাচ্ছে। এটা সম্ভব হয়েছে আরোং আনৈই ছাত্রাবাসটির কল্যাণে।
কুংলাপাড়ার লংরাও ম্রোর-ও মেয়েকে রেখেছেন এই ছাত্রাবাসে। তিনি বলেন, ‘আমাদের পাড়া থেকে স্কুল অনেক দূরে।
তাই মেয়েকে এই ছাত্রাবাসে রেখে পড়াচ্ছি।’
মানুষের জন্য মন কাঁদে : বান্দরবান শহর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে চিম্বুক পাহাড়ের পাদদেশে আশোরপাড়া। ১৯৭৬ সালে সেখানে জন্ম সিংলক ম্রোর। বাবা মেনরন ম্রো, মা দামলি ম্রো। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়।
শৈশব থেকে তিনি বেশ শান্ত স্বভাবের হলেও খুব পরিশ্রমী।
আট বছর বয়সে বাবা তাঁকে বিহারে রেখে আসেন। উদ্দেশ্য ক্রামা ধর্মে দীক্ষা। সেই থেকে সিংলক ক্রামা ধর্মের প্রবর্তক মেনলে ম্রোর সান্নিধ্যে থাকতেন। তাঁর খুব প্রিয় শিষ্য ছিলেন। একসময় মেনলে ম্রো নিরুদ্দেশ হয়ে যান। পরে মেনলের প্রধান শিষ্য রিমিডি পারাও ম্রোর সঙ্গী হন সিংলক।
২০০৩ সালে ছোট ভাই মাংরুম গুরুতর অসুস্থ হলে বৈদ্যের মাধ্যমে ভাইকে সুস্থ করে তোলার চেষ্টা করেন সিংলক। কিন্তু চোখের সামনে ভাইয়ের করুণ মৃত্যু ঘটে। সে ঘটনা মনে গভীর দাগ কাটে। সেই থেকে চেষ্টা আর কারো যেন মাংরুমের পরিণতি না হয়। ঔষধি লতাপাতা দিয়ে চিকিৎসার প্রাচীন পদ্ধতি শিখলেন প্রবীণদের কাছে। সিংলক বিনা পয়সায় চিকিৎসাসেবা দিতেন। বিশেষ করে অসহায় গরিবদের।
প্রথম ছাত্রাবাস : ম্রোদের চিকিৎসাসেবার বেহাল আর শিক্ষার দৈন্য ভাবিয়ে তোলে সিংলককে। পাহাড়ে অন্যদের তুলনায় ম্রোদের শিক্ষার হার কম। নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা ম্রো ভাষাটাও ভুলে যাচ্ছে। কিন্তু অসচ্ছল বলে শহরে সন্তানকে পড়ানোর সামর্থ্য নেই বেশির ভাগ অভিভাবকের। তাই ২০০৬ সালে রিনাপ্লুং নামের একটি সমিতি গড়ে ম্রোদের সংগঠিত করার উদ্যোগ নিলেন। ২০০৯ সালে থানচির ডিম পাহাড়ের পাশে প্রতিষ্ঠা করলেন রুংলেন থাবা নামের ছাত্রাবাস। সেখানে ছাত্র-ছাত্রী ছিল ১৫ জন। শিক্ষক ও বাবুর্চি দুজন করে। তাঁদের বেতন-ভাতা দিতেন সিংলক। পরে সোনে ইন্টারন্যাশনাল নামের একটি বেসরকারি সংস্থা পাশে দাঁড়ায়।
১৬ বছর পর আরেকটি : নিজে পড়াশোনার সুযোগ না পেলেও নিজ সম্প্রদায়ের মানুষকে এই সুযোগ দেওয়ার চেষ্টায় ত্রুটি নেই সিংলকের। চিরকুমার সিংলক এখন টংকাবতীতে রাস্তার পাশে একটা ঘরে একা থাকেন। সাদামাটা জীবন। ম্রোসমাজের মানুষ একনামে চেনে ও মানে তাঁকে। সিংলক বললেন, ‘মানুষের দুঃখ-কষ্ট দেখলে মন কাঁদে, তাই সাধ্যমতো পাশে থাকার চেষ্টা করি।’
এর মধ্যে ১৬ বছর পার করেছে ডিমপাহাড়ের সেই ছাত্রাবাস। এখন সেখানে ম্রো মাতৃভাষার সঙ্গে বাংলা-ইংরেজিও পড়ানো হয়। কয়েক বছর ধরে টংকাবতীতে আরেকটি ছাত্রাবাস প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন সিংলক। তাঁকে সহযোগিতার হাত বাড়ায় ক্রংসের ব্যাংভু সমিতি ও টংকাবতী এলাকাবাসী। অবশেষে চলতি বছরের ১৯ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে নতুন ছাত্রাবাস—আরুং আনৈই। ম্রো ভাষায় ‘আরুং’ মানে উষা আর ‘আনৈই’ মানে আলো।
ম্রো ভাষার লেখক ও গবেষক ইয়াংঙান ম্রো বলেন, ‘হোস্টেল প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ম্রো মাতৃভাষা টিকিয়ে রাখা। মাতৃভাষা হলো শিকড়ের মতো। মাতৃভাষা হারিয়ে গেলে আমাদের হারিয়ে যেতেও সময় লাগবে না।’
ছাত্রাবাসে যা আছে : ছাত্রাবাসটি বান্দরবান শহর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে, ৫ নম্বর টংকাবতী ইউনিয়নের ব্রিকফিল্ড বাজার এলাকায়। ম্রো ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্যে বাঁশ, কাঠ ও টিন দিয়ে আরোং আনৈই নির্মাণ করা হয়েছে। মোট ৪০ শতক জায়গায় পাঁচটি মাচান ঘর। একটি ছাত্রদের, অন্যটি ছাত্রীনিবাস। আছে অফিসকক্ষ ও রান্নাঘর। পাশেই পাঠদানের ঘর, যেখানে ম্রো ভাষার প্রাথমিক পাঠ দেওয়া হয়। চারপাশে চমৎকার বাঁশের বেড়া, ওপরে টিনের ছাউনি। সামনে খোলা বারান্দা। ভেতরে একটি কক্ষে সবাই পড়াশোনা করে এবং বিছানা পেতে ঘুমায়। এখন সেখানে শিক্ষক মোট চারজন। দুজন বাংলা ও ইংরেজি পড়ান। অন্য দুজন পড়ান ম্রো ভাষা। প্রতিদিন ভোর ৫টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত ম্রো মাতৃভাষায় পাঠদান করা হয়। সন্ধ্যায় বাংলা ও ইংরেজি পড়ানো হয়।
এখন শিক্ষার্থী ৭১ জন। এর মধ্যে ছাত্রী ২৫ জন। থানচির চামদমপাড়া, বড় মোদক, আলীকদমের কুরুকপাতা, রুমার নাইতিংয়ে, নাইক্ষ্যংছড়িসহ দূরদূরান্ত থেকে এসেছে শিক্ষার্থীরা। পাশেই ব্রিকফিল্ড বাজার পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। শিক্ষার্থীরা সেখানে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করে। ছাত্রাবাসের সামনে খোলা চত্বরে বন্ধুদের সঙ্গে খেলছিল তেনইয়া ম্রো। চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে সে। প্রথমে কিছুটা লজ্জা পেলেও পরে সুকুমার রায়ের ‘আবোল তাবোল’ আবৃত্তি করে শোনাল সবাইকে। রিরোপড়ো নামের আরেকজন ছাত্রী বলল, ‘আমরা ২৫ জন একসঙ্গে থাকি। খেলি। ঘুমাই। এখানে খুব মজা হয়।’
টিকে থাকাতে সহযোগিতা প্রয়োজন : ছাত্রাবাসের জন্য জমি দিয়েছেন দক্ষিণ হাঙর মৌজার হেডম্যান পারিং ম্রো। তিনি বলেন, ‘বান্দবানে যে-সব জনগোষ্ঠী বসবাস করে তার মধ্যে শিক্ষায় আমরা (ম্রো) সবচেয়ে পিছিয়ে। সিংলক বলার পর জমি দিতে দ্বিতীয়বার ভাবিনি।’
ইয়াংঙান ম্রো বলেন, “এই ছাত্রাবাস প্রতিষ্ঠার পেছনে ‘ক্রংসের ব্যাংকভু’ বা মাটির ব্যাংক সমিতির অবদান অনেক। সমিতির সদস্য ছয় শতাধিক। সবাই ক্রামা ধর্মের অনুসারী। প্রতিটি ঘরে মাটির ব্যাংক রাখা হয়। সেখানে সাধ্যমতো টাকা জমা করা হয়। উদ্দেশ্য সমাজের জন্য, বিশেষ করে শিক্ষার জন্য কিছু করা।’
ক্রংসের ব্যাংকভুর সভাপতি সিংলক ম্রো। ঠিকঠাক বাংলা বলতে পারেন না। ম্রো ভাষায় তিনি বললেন, ‘১০ বছর ধরে ২০ লাখ টাকার মতো জমেছে। সেখান থেকে প্রায় পাঁচ লাখ টাকায় নির্মাণ করা হয়েছে হোস্টেলটি। বাংলায় শিক্ষিত ম্রোরা যদি নিজেদের মাতৃভাষায় পড়ালেখা করতে না পারে, তাহলে ম্রো ভাষা হারিয়ে যাবে। তাই সমিতির সদস্যরা এমন উদ্যোগে একমত হয়েছেন।’
সমিতির সদস্য মেনওয়াই ম্রো বলেন, ‘শেষ দিকে আরো এক লাখ টাকার মতো লেগেছিল, যেটা সিংলক দিয়েছেন। মাটি কাটা ও ঘর নির্মাণে এলাকাবাসী স্বেচ্ছাশ্রম দিয়েছে।’
এখানকার আবাসিক শিক্ষক থংয়া ম্রো বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের খরচ হিসেবে অভিভাবকরা বছরে ১৫ হাজার টাকা করে দেবেন। কোনো অভিভাবক টাকা দিতে না পারলে ক্রংসের ব্যাংভু খরচ বহন করবে।’
প্রতিষ্ঠানটি টিকিয়ে রাখতে সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতা দরকার বলে মনে করেন সিংলক। নইলে দীর্ঘ সময় ধরে পরিচালনা করা কঠিন হতে পারে।
সাব্বির