ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৪ জুন ২০২৫, ৩১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

মানবিক বিশ্ব গড়তে চাই বৈশ্বিক শৃঙ্খলা

ফনিন্দ্র সরকার

প্রকাশিত: ১৯:২২, ১৭ মে ২০২৫

মানবিক বিশ্ব গড়তে চাই বৈশ্বিক শৃঙ্খলা

বিশ্ব যেন ক্রমশ আমানবিক হয়ে উঠছে। কথাটি এভাবে বললে যথার্থ হয় যে, বিশ্বে বসবাসরত কথিত শ্রেষ্ঠ প্রাণী মানুষ দিনে দিনে প্রায় অমানুষে পরিণত হচ্ছে। কোথাও কোনো শৃঙ্খলা নেই। আইনের শাসন ব্যবস্থা অনেকটা ধ্বংসপ্রাপ্ত। গোটা বিশ্ব ভয়ংকর অস্থির সময় অতিক্রম করছে। বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্রই ন্যায়বিচার ও নিয়মনীতি মেনে চলার সংস্কৃতি থেকে দূরে সরে এসেছে। মানুষই মানুষের ওপর নিপীড়ন-নির্যাতন চালাচ্ছে। যে যেভাবে পারছে বল প্রয়োগ করে স্বার্থ হাসিল করছে। গণতন্ত্র গণতন্ত্র বলে আমরা হাপিতেশ করছি। কিন্তু গণতন্ত্র কি সেটা না বুঝেও গণতন্ত্রের বুলি আওড়াচ্ছি। আসল সমাধান কী তা চিহ্নিত করার কোনো চেষ্টাই করা হচ্ছে না বলে মনে হয়। বস্তুত মানুষের জীবনটাই যজ্ঞ। মহৎ কর্মযজ্ঞ দিয়ে সমস্ত জীবনটাই কল্যাণের জন্য দান করার মধ্য দিয়েই সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজে পাওয়া যায়। বিশ্বের রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে প্রায় সকল মানুষই যাজ্ঞিক ভাবনা থেকে দূরে সরে এসেছে। মানুষ রাজনীতিতে যে কাজ করে তা মূলত কর্মযজ্ঞই। বর্তমানে রাজনীতি যাজ্ঞিক চরিত্র হারিয়ে ফেলেছে। এখন রাজনীতিক ক্ষেত্রে দেখা যায় একমাত্র ক্ষমতা দখলই রাজনীতির কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে জন্য এত অশান্তি এত অরাজকতা। সাধারণ মানুষকে স্বাধিকার সম্বন্ধে সচেতন করে তোলার কাজ রাজনীতিতে নেই বললেই চলে। রাজনীতির মূল কাজ হলো কোটি কোটি দেশবাসীকে শিক্ষা দিয়ে সচেতন করে তোলা যে- সে এক মহান গণতান্ত্রিক দেশের সম্মানিত নাগরিক। একটা দেশের সরকার শুধু নাগরিকদের কল্যাণের জন্যই কাজ করবে। সরকারকে নাগরিকদের মতামতের ওপরই নির্ভর করতে হবে। জনগণের কাছ থেকেই সরকার শক্তি অর্জন করবে। গণতান্ত্রিক রাজনীতির উদ্দেশ্যই হবে জনগণের মর্যাদা বৃদ্ধি করা। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, রাজনীতিকগণ কেবল ক্ষমতা দখলের সন্ধানেই ব্যস্ত থাকে। ক্ষমতা দখলের প্রতিযোগিতা ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে দলগত পর্যায়ে বিস্তৃত। মনে রাখা দরকার যে, জীবন থেকে যজ্ঞভাবনা সরিয়ে নিলে জীবন হয়ে পড়ে নিম্নমানের। এতে মানব জাতির জীবনযাত্রা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জীবনের যজ্ঞভাবনার সামান্য কিছুও যদি প্রভাবিত হয় তবে সব কিছুই উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। শাসন ব্যবস্থা এক যজ্ঞ, শিক্ষা ব্যবস্থাও যজ্ঞ- এ ভাবনা থেকে সরে এলেই বিশ্ব বিশৃঙ্খলার পতিত হয়। যেটি বর্তমানে লক্ষণীয়।
সাম্প্রতিক বিশ্ব প্রায় সব রাষ্ট্রের শাসকই চরম ক্ষমতার লোভে পড়ে গেছে। এই লোভ আগেও ছিল, তবে তার প্রকৃতিটা বদলে গেছে। জার্মান ইতিহাসবিদ ও রাজনৈতিক তাত্ত্বিকে হ্যান্স মরগেনথুর মতে, ‘প্রায় সব রাষ্ট্রই একটা সময় লোভে পড়ে যায়। যেখানে তারা নিজেদের স্বার্থকে নৈতিকতার দোহাই দিয়ে ঢেকে রাখে।’ বর্তমান বিশ্ব তার কথার বাস্তব প্রতিফলন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় সভ্যতার ক্রমবিকাশের এক পর্যায়ে আন্তর্জাতিক বিধিবিধানকে সব শাসকই গুরুত্ব দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করতো। মানবাধিকার রক্ষাসহ সব সমস্যা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা হতো। আইনের শাসনের প্রতি ছিল শ্রদ্ধাশীল। এই সংস্কৃতি থেকে যেন সব রাষ্ট্রই সরে এসেছে। বিশ্ব এখন আর আইনের শাসন মেনে চলতে পারছে না। কোনো কোনো রাষ্ট্রের কোনো কোনো রাজনীতিকগণ দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের জিগির তোলে জনগণের সহানুভূতি আদায়ের চেষ্টা করে। এসবের আড়ালে পরস্পরে হিংসা ও বিদ্বেষ লালন করে আসছে। সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা, রেষারেষি সেই সঙ্গে জাতিগত বিদ্বেষকে উস্কে দিয়ে রাজনীতির মাঠকে গরম রাখার চেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করছে ধর্মের দোহাই দিয়ে। কোনো কোনো গোষ্ঠী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে রাষ্ট্রযন্ত্র দখল করে ভিন্নমতাদর্শের ওপর ক্রমাগত আঘাত করে চলেছে। ‘জোর যার মুল্লুক তার’ নীতিতে বিশ্ব রাজনীতি এক ভয়ংকর বিশৃঙ্খলা ভেতর দিয়ে গতিময়তা লাভ করছে। কোনো কোনো অঞ্চলে যুদ্ধ চলছে। আবার কোথাও কোথাও যুদ্ধের দামামা বেজে উঠছে। পারমাণবিক অস্ত্রের হুমকিও অনেকটা স্বাভাবিকতা লাভ করেছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হয় ২০২২ সালে। ইউক্রেনের চেয়ে অপেক্ষাকৃত অনেক বেশি শক্তিশালী রাষ্ট্র রাশিয়া যখন ইউক্রেনে সামরিক অভিযান চালায় তখন মনে হয়েছিল খুব সহজে ইউক্রেন পরাস্ত হবে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। পৃথিবীর শক্তিধর রাষ্ট্র অর্থাৎ বিশ্বের একক পরাশক্তির দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতায় ইউক্রেন এখনো যুদ্ধে টিকে আছে। যদিও ব্যাপক ক্ষতি ও ইউক্রেনের অনেক ভূমি রাশিয়ার দখলে চলে গেছে। যুদ্ধে ব্যাপকভাবে নিরীহ মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। মাঝেমধ্যে যুদ্ধ বিরতি ঘটে, কিন্তু যুদ্ধ চলমান। মধ্যপ্রাচ্যও অশান্তির আগুনে জর্জরিত। গাজা যুদ্ধের ভয়াবহতা বিশ্ববাসীকে বিস্মিত করেছে। গাজা ও সিরিয়াতে ইসরাইলের আক্রমণ অব্যাহত রয়েছে। লেবাননে হিজবুল্লাহ গোষ্ঠীর সঙ্গেও বড় ধরনের সংঘর্ষের শঙ্কা বিরাজ করছে। এদিকে দক্ষিণ এশিয়াতেও যুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছে। গত ২২ এপ্রিল ২০২৫ ভারতের ভূ-স্বর্গখ্যাত রাজ্য জম্মু কাশ্মীরের পেহেলগাও অঞ্চলে জঙ্গি হামলায় ২৬ জন পর্যটক প্রাণ হারায়। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভারত-পাকিস্তান পরস্পরের সামরিক অভিযানের হুমকি প্রদর্শন করছে। ভারতের দাবি, এই হামলার জন্যে পাকিস্তান দায়ী। বর্তমানে দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধবিরতি চলমান। উত্তর কোরিয়াও জাপানে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করার হুমকি দিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে জাপানের নিরাপত্তা ও মানসিক স্থিতি দুর্বল হয়ে পড়েছে।
বিশ্বের পারস্পরিক দেশের মধ্যে অনেক ছোট ছোট বিষয়ে বিরোধ রয়েছে, যা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা যায়। কিন্তু সে দিকে কেউ নজর না দিয়ে শক্তি প্রদর্শনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীর শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো দীর্ঘ সময় যুদ্ধ সংস্কৃতি পরিহার করে চলেছে। এসব শক্তিশালী দেশ সরাসরি যুদ্ধে জড়াতো না। এরা মধ্যস্ততাকারী গোষ্ঠী বা জোট তৈরি করতো। কিংবা নেপথ্যে যুদ্ধ পরিচালনা করতো। বর্তমানে সে কৌশল বদলে গেছে। এখন বড় শক্তিধর দেশগুলো নিজেরাই সরাসরি সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র-চীন সম্পর্ক এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যেখানে চীন যার বন্ধু, সে বন্ধুরাষ্ট্র আমেরিকার শত্রুতে পরিণত হচ্ছে। আবার আমেরিকার ঘনিষ্ঠ দেশ চীনের বৈরী রাষ্ট্র হিসেবে বিকশিত হচ্ছে। ক্রমাগত পরিবর্তন হচ্ছে রাজনীতির সমীকরণ। বর্তমান বিশ্বয়নের যুগে ভূরাজনীতিকে সকলেই গুরুত্ব দিচ্ছে। সমুদ্রকেন্দ্রিক অর্থনীতিকে জোরদার করতে সমুদ্র জবর দখলের প্রতিযোগিতা চলছে। প্রয়োজনে সামরিক শক্তিতে কাজে লাগাতে কৌশলী হচ্ছে। দক্ষিণ চীন সাগরকে ঘিরে যে সব ঘটনা ঘটছে তা খুবই উত্তেজনাপূর্ণ। আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা কাঠামো অনেকটাই ভেঙে পড়েছে। রাশিয়ার ইউক্রেন আগ্রাসন তার প্রমাণ। পৃথিবী এখন টালমাটাল অবস্থায় উপনীত। মানবতা বলতে কিছু নেই। মনুষ্যত্ব বিকাশের পথ রুদ্ধ। আমার মনে হয় জবরদস্তিমূলক মধ্যযুগীয় শক্তির মহড়ায় লিপ্ত হয়ে পড়েছি। বিশ্ব রাজনীতিও গতিপথ বদল করে ফেলেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যেমন প্রকৃতি নষ্ট হচ্ছে, নদীর স্বচ্ছ পানি গন্ধযুক্ত নর্দমার পানিতে পরিণত হয়েছে, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে গেছে। তেমনি রাজনীতিও গন্ধযুক্ত হয়ে পড়েছে। বিশ্ব রাজনীতি এখন আর সূক্ষ্ম কূটনৈতিক কৌশলের ওপর নির্ভরশীল নয়। কূটনীতিকরাও নিজ দেশ ও জনগণের স্বার্থের পরিবর্তে ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের কৌশল অবলম্বন করে দায়িত্ব পালন করছেন। যে কারণে আন্তর্জাতিক সম্পর্কে বৈরিতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশে দেশে কূটনীতিকগণ জেনেভা কনভেনশনের শর্তগুলোরও ধার ধারছে না। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনকে উপেক্ষা করে শ্রেণীস্বার্থ, গোষ্ঠীস্বার্থ চরিতার্থ করার প্রতিযোগিতা করছে। বিশ্বের মানুষ পরমাণু যুদ্ধের ঝুঁকিতে পড়েছে।
১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্তির পর মানব জাতির মধ্যে একটা পরিবর্তনের ধারা সূচিত হয়েছিল। এই যুদ্ধ মানব মনকে প্রচণ্ডভাবে নাড়া দিয়েছিল। মানব হৃদয়ে এক নতুন প্রজ্ঞা সঞ্চারিত হয়েছিল। বিশ^ মানবীয় ‘সচেতনতার, ক্রমবিকাশ সূচিত হয়েছিল। সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সংস্থাগুলো বিশ্বমানবীয় সচেতনতার ভাবকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল। কিন্তু সেই মানবিক ভাব ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে গেল। জাতিপুঞ্জের সংস্থাগুলোও তার কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলল। জাতিসংঘের দোহাই দিয়েই বিশ্বে যত অপকর্ম হচ্ছে। ঐ বিশ্ব সংস্থাটিও কার্যত অর্থহীন প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। বৈশ্বিক বিশৃঙ্খলা রাষ্ট্র সমাজ তথা শাসনব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিয়েছে। এই বিশৃঙ্খলা এড়াতে দরকার কাজ, ভালো কাজ। সমাজে কিছু ব্যস্তবাগিশ আছে, যারা কেবল এখানে ওখানে কেবল কিছু অনুষ্ঠানে ব্যস্ত থাকে। তাদের কাজের মাত্রা খুবই সীমিত। তারা নাম চায়, প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি এবং গুরুত্বপূর্ণ আধিকারিকদের সঙ্গে চায় ছবি তুলতে। কিন্তু লোক কল্যাণে তাদের কোনো ভূমিকা নেই। আধুনিক, প্রগতিশীল নর-নারী লোক কল্যাণমূলক কাজকেই ধর্মীয় কাজ হিসেবে বিশ্বাস করে। কিন্তু প্রগতিশীল আধুনিক নর-নারীর এই মহৎ কাজে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে কিছু ধর্মান্ধ তর্কবাগিশ। লোক কল্যাণের চেয়ে ঘুরে বেরিয়ে বক্তব্য প্রদানই এদের মূল কাজ। এ ধরনের লোক সমাজ জীবনে, প্রতিষ্ঠানে, রাজনীতিক দলে সর্বত্রই রয়েছে। কর্মজীবী মানুষ যৌথভাবে মানব কল্যাণমূলক কাজে অংশ গ্রহণ করলে বিশৃঙ্খলার সুযোগ থাকবে না।
বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় মানুষে মানুষে ভেদাভেদ সৃষ্টি হয়েছে। কিছু মানুষ অন্য কিছু মানুষকে ঘৃণা করে, হিংসা করে। রাষ্ট্রশক্তি এসবকে প্রশ্রয় দিয়ে সমাজে বিশৃঙ্খলা তৈরিতে মত্ত থাকে। ফলে রাষ্ট্র আইনের শাসনের ক্ষেত্রে দুর্বল হয়ে পড়ে। একটা সময় শাসন ব্যবস্থাই ভেঙে যায়। শাসকগোষ্ঠী এই ভেদনীতিকে পুঁজি হিসেবে ব্যবহার করে ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধার শেষে জনগণকে বিপদে ফেলে চলে যায় অন্যত্র। রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি সর্বক্ষেত্রে মনুষ্যত্ব বিকাশে কর্মসূচি প্রণয়ন করতে হবে। মানবিক বিশ্ব গড়ে তুলতে হলে গোটা বিশ্বের মানব জাতিকে একত্ব পরিহার করে বহুত্বে মনোনিবেশ করতে হবে। সেই সঙ্গে সেবা ও ত্যাগের মানসিকতায় জীবন পরিচালিত করতে হবে। রাজনীতিবিদ তথা রাষ্ট্রের শাসকদেরই আগে ত্যাগের দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। তবেই মানবিক বিশ্ব গড়ে উঠবে।
     
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
[email protected]

প্যানেল

×