
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার বেসিক উদ্দেশ্য হচ্ছে কোনোরকম হয়রানি বা ভোগান্তি তৈরি না করে লাখ লাখ শিক্ষার্থী থেকে সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীদের ভর্তির জন্য নির্বাচন করা। গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা খুবই ভালো উদ্যোগ। গত পাঁচ শিক্ষাবর্ষে গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষায় কিছু ভুলত্রুটি থাকলেও এটা শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের জন্য স্বস্তির বিষয় ছিল। ২০২০ সালের ১৯ ডিসেম্বরে প্রথমবারের মতো দেশের ২০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা গুচ্ছ পদ্ধতিতে ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের জন্য ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা কার্যক্রমের নেতৃত্ব দিচ্ছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো না আসায় গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা শতভাগ সফল হয়নি। তাই সরকারকে বাকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে একটি গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার আওতায় আনার জন্য জোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের কষ্ট কমে যাবে।
কারণ, শিক্ষার্থীদের এখনো প্রায় পাঁচ-ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরম তুলতে হয় ও পরীক্ষা দিতে হয়। তাই আগের মতো ভোগান্তি থেকে যায়। যদিও গুচ্ছ পদ্ধতির এ পরীক্ষায় একটি আবেদনে গুচ্ছের আওতাভুক্ত সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ থাকছে। কয়েক বছর ধরেই গুচ্ছ পদ্ধতির ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে আলোচনা চলছিল। অবশেষে যখন সত্যিই এ পদ্ধতি আংশিক বাস্তবায়িত হলো, তা পরীক্ষার্থীদের জন্য কিছুটা হলে স্বস্তি নিয়ে আসছে।
গুচ্ছভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা একসঙ্গে হওয়ায় আসন নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা কম। আগে একজন শিক্ষার্থী কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাতালিকায় সুযোগ পেয়ে যখন পছন্দের একটি বেছে নিতেন, তখন একই সঙ্গে অন্য জায়গায় কয়েকটা আসন ফাঁকা থেকে যেত। কিছু ক্ষেত্রে পছন্দের বিষয় পেতে দেরি হতো এবং প্রক্রিয়াটি সময়সাপেক্ষ ছিল। ফলে, অনেকেই হতাশায় ভুগতেন। বিশেষজ্ঞদের দিয়ে এ পদ্ধতিতে যে সমস্যা আছে, সেগুলো বন্ধ করতে হবে। এ সমস্যাগুলোর সমাধান করতে পারলে সবার নিকট খুবই গ্রহণযোগ্য হবে।
তবে গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষায় কিছু জটিলতা তৈরি হয়েছে। যেমনÑ কেউ পরীক্ষার কেন্দ্র পছন্দ দিয়েছেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু তাকে ভর্তি পরীক্ষা দিতে হয়েছে দূরবর্তী অন্য কোনো কেন্দ্রে। আবার কেউ পরীক্ষার কেন্দ্র পছন্দ দিয়েছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, বাস্তবে পরীক্ষার কেন্দ্র পড়েছে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। এভাবে অনেক শিক্ষার্থী কষ্ট এবং ভোগান্তির শিকার হয়েছেন। ফলে, ২০২৬ সালে ভর্তি পরীক্ষায় বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে গুরুত্বের সহিত বিবেচনা করে সমাধান বের করা উচিত ।
তারপরও গুচ্ছ পদ্ধতি ভোগান্তি কমানোর জন্য একটি যুগোপযোগী পদক্ষেপ। তবে কিছু বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে আরও যত্নবান হতে হবে। আবেদন নির্দেশিকাতে বলা হয়েছিল, পছন্দক্রম অনুসারে কমপক্ষে পাঁচটি কেন্দ্র নির্বাচন করতে, যেখানে শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা দিতে চান। তবে তারা সঠিকভাবে কেন্দ্রের তালিকা পূরণ করার পরও অনেক শিক্ষার্থী পছন্দের কেন্দ্র পাননি। সেক্ষেত্রে যেভাবে হোক ওই কেন্দ্রে ব্যবস্থা করা জরুরি। প্রয়োজন হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশে কোনো স্কুল বা কলেজে কেন্দ্র করা যেতে পারে।
অতীতে একেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার জন্য একেক জেলায় বা বিভাগে শিক্ষার্থীদের ছুটতে হতো। স্বাভাবিকভাবেই ভ্রমণক্লান্তি বা অসুস্থতার জন্য প্রস্তুতি থাকার পরও অনেকের পরীক্ষা আশানুরূপ হতো না। তাই গুচ্ছ পদ্ধতি সবার জন্যই স্বস্তির বিষয়। সময় ও অর্থসাশ্রয়ের সঙ্গে পছন্দের কেন্দ্রে পরীক্ষা দিতে পারলে আত্মবিশ্বাসও বাড়বে শিক্ষার্থীদের।
তবে অনেকে চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করতেন, এগুলোতে সুযোগ না হলে তাদের ঘুরতে হতো সারাদেশে। গুচ্ছ পদ্ধতি আশপাশের কোনো কেন্দ্রে বসে ২০ বা ২৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার সুযোগ করে দিয়েছে অধিকাংশ শিক্ষার্থীদের। কিন্তু এ বছর ১৯ বিশ্ববিদ্যালয়ে গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। ৫টি বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছ থেকে বের হয়ে যায়। সরকারের উচিত, যেভাবেই হোক সব বিশ্ববিদ্যালয়কে এক সিস্টেমের আওতায় নিয়ে আসা।
এছাড়া ভর্তি ইচ্ছুক শিক্ষার্থীরা ছবি পরিবর্তনসহ অন্য কোনো সমস্যায় পড়লে তাদের গুচ্ছভুক্ত কাছাকাছি যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগাযোগ করে তা সমাধান করা হয়েছে। শিক্ষকরাও গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে কিছুটা অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। কারণ, প্রতিকক্ষে প্রধান পরিদর্শক রাখা হয়নি। তবে এ বছর অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে এ সমস্যা সমাধান করা হয়েছে। যদি এখনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় প্রধান পরিদর্শক না রেখে থাকেন, আগামী শিক্ষাবর্ষে যেন এ বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতৃত্বে সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা গুচ্ছ পদ্ধতিতে হলে শিক্ষার্থীরা শতভাগ খুশি হতো। কারণ, এতে এক আবেদনে তাদের ভর্তি কার্যক্রম সম্পন্ন হতো। অনেক শিক্ষার্থী মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এ প্রক্রিয়ায় সংযুক্ত না হওয়ার সিদ্ধান্ত সঠিক নয়। তারা মনে করেন, সব বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষায় এলে সবচেয়ে ভালো হতো। নতুবা ওই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অজুহাতে অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষায় ভবিষ্যতে নাও থাকতে পারে, যা ইতোমধ্যে কিছু বিশ্ববিদ্যালয় অনুসরণ করেছে। তবে নতুন এ ব্যবস্থাকে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত বলে মনে করছেন বেশির ভাগ শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। আশা করছি, এ পদ্ধতিতে পুরানো সমস্যাগুলো দূর হবে। এছাড়া গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার নেতিবাচক দিক হলো, যদি কোনো এক শিক্ষার্থী দুর্ঘটনাবসত পরীক্ষা দিতে না পারেন বা পরীক্ষায় বেশি খারাপ করে ফেলেন, তাহলে তার গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার অন্তর্ভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ আর থাকবে না।
আগে এক বিশ্ববিদ্যালয়ে খারাপ করলেও আরেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালোভাবে প্রস্তুতি নিয়ে ভালো পরীক্ষার মাধ্যমে ভর্তি হওয়ার সুযোগ মিলত। এগুলো পাবলিক পরীক্ষার ক্ষেত্রে মেনে নিতে হবে। প্রতিবছর যে হারে জিপিএ পাস করা শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, সেই অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন সংখ্যা বাড়ছে না। তার ওপর আবার রয়েছে পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয় ও বিষয় নির্বাচন। সব মিলিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর বিশাল চাপ সৃষ্টি হয়। উচ্চশিক্ষার জন্য তাই তীব্র প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হতে হয় তাদের। তবে এ তীব্র প্রতিযোগিতা ফেস করতে গিয়ে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের নানা বিড়ম্বনার মুখোমুখিও হতে হয়। সবচেয়ে জনপ্রিয় যে সমাধানটি গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে আলোচনায় এসেছে, তা হলোÑ সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটি সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি চালু করা, যা ইতোমধ্যে কার্যকর হয়েছে। কিন্তু শতভাগ সফল হয়নি।
অধিকাংশ শিক্ষার্থী রাজধানীতে অবস্থিত বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রগুলোতে পরীক্ষা দেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০ হাজার ৯১৫ জনের পরীক্ষা নেওয়ার ধারণক্ষমতা আছে। কিন্তু প্রথম বছর সেখানে ৩৭ হাজার ৭৪৯ জন শিক্ষার্থী প্রথম পছন্দের কেন্দ্র হিসেবে আবেদন করেছেন। আবার শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫ হাজার জনের পরীক্ষা নেওয়ার ধারণ ক্ষমতা থাকলেও সেখানে পরীক্ষা দেওয়ার জন্য আবেদন জমা পড়েছে ২০ হাজার ৮৯৪ জনের।
ফলে, নির্ধারিত আসনের বেশিসংখ্যক শিক্ষার্থীর পছন্দ থাকায় যারা স্কোরে এগিয়ে ছিলেন, তারাই ওই কেন্দ্রে পরীক্ষার আসন পেয়েছেন। তাই শিক্ষার্থীদের উচিত হবে তার নিজ বিভাগ সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন্দ্র পছন্দ করা। তাতে গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা আয়োজক কমিটির সুবিধা হবে।
দেশে অনুমোদিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ৫৪টি। এসবের মধ্যে সাধারণ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, যেগুলোয় ভর্তি পরীক্ষা আলাদা আলাদা তারিখে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ফলে শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি প্রকৃতপক্ষে ওই রকম হ্রাস পাচ্ছে না। অর্থাৎ গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা সফল হবে তখনই যখন একটি গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষায় অন্তর্ভুক্ত হবে সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় তাই এমন সিস্টেম বের করতে হবে যাতে সাধারণ, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল এবং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে স্নাতক ভর্তির কার্যক্রম সম্পন্ন করা যায়।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক,
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ
প্যানেল