
মানব জীবন এক বিশাল ক্যানভাস, যেখানে প্রতিটি ব্যক্তি একেকটি স্বতন্ত্র রঙের রেখা। কেউ ঝলমলে রোদ, কেউ গভীর অরণ্যের সবুজ, কেউবা নদীর বয়ে চলা স্রোত। কিন্তু কিছু মানুষ আছে, যাদের সমাজ দুর্বল বলে চিহ্নিত করেছে, যাদের চারপাশে গড়ে তোলা হয়েছে অবহেলার এক অদৃশ্য দেয়াল। তারা প্রতিবন্ধী নামের সেই সূর্য সন্তান, যাদের চোখে অনন্ত স্বপ্ন। অথচ সমাজের বৈষম্যের কুয়াশায় সেই স্বপ্নগুলো অস্পষ্ট হয়ে যায়। প্রতিবন্ধী মানে কি অপূর্ণতা? নাকি এটা শুধু এক সামাজিক নির্মাণ, যেখানে কিছু মানুষকে ‘অক্ষম’ বলে চিহ্নিত করে রাখা হয়েছে? প্রকৃতপক্ষে, প্রতিবন্ধী মানে শক্তির এক নতুন সংজ্ঞা। তাদের হয়তো হাত নেই, কিন্তু মন আছে সৃষ্টির অনিঃশেষ সম্ভাবনায় ভরপুর। তাদের হয়তো চোখ নেই কিন্তু হৃদয়ের গভীরে অনুভূতির এক মহাসমুদ্র আছে। তাদের হয়তো শ্রবণশক্তি নেই কিন্তু তারা পৃথিবীর শব্দ অনুভব করে স্পন্দনে, আত্মার উষ্ণতায়।
জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুসারে, বিশ্বের ১৫% মানুষ কোনো না কোনোভাবে প্রতিবন্ধী, যা প্রায় ১০০ কোটিরও বেশি মানুষের জীবনের গল্প। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (BBS) ২০২৩ সালের প্রতিবেদনে দেখা যায়, দেশের ৭% মানুষ প্রতিবন্ধিতার শিকার। কিন্তু বাস্তব সংখ্যাটি হয়তো আরও বেশি। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিবন্ধীদের ৮৫% এখনো কর্মসংস্থানের বাইরে। আর ৭০% শিশুই মানসম্মত শিক্ষা পায় না। এই সংখ্যাগুলো শুধু পরিসংখ্যান নয় বরং এক একটি হারিয়ে যাওয়া স্বপ্নের প্রতিচিত্র।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) মতে, প্রতিবন্ধিতা মূলত চারটি প্রধান শ্রেণিতে বিভক্ত। যেমন-
১.শারীরিক প্রতিবন্ধিতা- জন্মগত বা দুর্ঘটনাজনিত কারণে হাত, পা বা শরীরের কোনো অংশের স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা হারানো।
২. দৃষ্টি প্রতিবন্ধিতা- সম্পূর্ণ বা আংশিক দৃষ্টিশক্তি হারানো।
৩. শ্রবণ ও বাক প্রতিবন্ধিতা- কথা বলার বা শোনার অক্ষমতা।
৪.বুদ্ধিপ্রতিবন্ধিতা ও নিউরোডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধিতা- মানসিক বিকাশজনিত সমস্যা, যেমন- অটিজম, ডাউন সিনড্রোম, বুদ্ধি প্রতিবন্ধিতা ইত্যাদি।
প্রতিবন্ধীদের সমস্যাগুলো শুধু তাদের শারীরিক সীমাবদ্ধতার কারণে হয় না, বরং সমাজের উদাসীনতা ও সহানুভূতির অভাবই তাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠী আজও অবহেলিত। শিক্ষা, কর্মসংস্থান, চলাচল, চিকিৎসা সবক্ষেত্রেই তারা নানা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়ে থাকেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এখনো সম্পূর্ণরূপে প্রতিবন্ধীবান্ধব হয়ে ওঠেনি। ব্রেইল বইয়ের অপ্রতুলতা, শ্রবণ ও দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষায়িত শিক্ষকের অভাব, হুইলচেয়ার সুবিধাসম্পন্ন র্যাম্প ও লিফটের অভাবের কারণে তারা শিক্ষা থেকে পিছিয়ে পড়ছে। কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রেও তাদের প্রতি সংবেদনশীল দৃষ্টিভঙ্গির অভাব লক্ষণীয়। বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কাজের উপযোগী পরিবেশ নেই। ফলে তারা কর্মজীবনে প্রবেশ করতে পারেন না বা করলেও তাদের নানা বৈষম্যের শিকার হতে দেখা যায়। প্রতিবন্ধীদের শুধু করুণা নয়, তাদের আত্মনির্ভরশীল করে তোলাই সমাজের অন্যতম দায়িত্ব।
তাদের জন্য কিছু বাস্তবসম্মত উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে-
১.প্রতিবন্ধীবান্ধব শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা- ব্রেইল পদ্ধতির বই, অডিও পাঠ্যবই ও ডিজিটাল শিক্ষা উপকরণের ব্যবস্থা করা। বিশেষ প্রশিক্ষিত শিক্ষক নিয়োগ করা, যেন প্রতিটি শিশু শিক্ষার আলোতে আলোকিত হতে পারে।
২. কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা- সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে প্রতিবন্ধীদের জন্য নির্দিষ্ট কোটার ব্যবস্থা করা। ফ্রিল্যান্সিং, হস্তশিল্প, তথ্যপ্রযুক্তি ও সংগীতের মতো ক্ষেত্রে তাদের দক্ষ করে তোলা।
৩. প্রযুক্তির সহায়তা নিশ্চিত করা- স্মার্ট ব্রেইল ডিভাইস, স্পিচ-টু-টেক্সট সফটওয়্যার, উন্নত হুইলচেয়ারের ব্যবস্থা করা। এমন একটি সমাজ গড়া যেখানে প্রযুক্তি হবে তাদের শক্তির নতুন অস্ত্র।
৪. সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন- গণমাধ্যমে প্রতিবন্ধীদের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে উপস্থাপন করা। পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছোটবেলা থেকেই শিশুদের প্রতিবন্ধীদের প্রতি সহানুভূতিশীল করে গড়ে তোলা।
৫. অর্থনৈতিক সহায়তা প্রদান- প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য সরকারি অনুদান, মাসিক ভাতা ও বিশেষ ঋণ সুবিধা নিশ্চিত করা। উদ্যোক্তা হতে চাইলে তাদের জন্য বিনা সুদে ঋণের ব্যবস্থা করা।
প্রতিবন্ধীরা আমাদের থেকে আলাদা নয়। তারা আমাদেরই অংশ, আমাদেরই রক্তের ধারা, স্বপ্নের সহযাত্রী। তাদের দিকে করুণার চোখে নয়, ভালোবাসার চোখে তাকাতে হবে। তাদের সীমাবদ্ধতা নয়, তাদের সম্ভাবনার কথা ভাবতে হবে। প্রতিবন্ধকতাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নতুন ভোরের সূচনা হওয়া জরুরি। সমাজ যখন তাদের বোঝা ভাবা বন্ধ করে, তখনই শুরু হয় এক নতুন ভোরের সূচনা হয়। সমাজ যখন বলে, ‘তুমি পারবে’ তখনই তারা উঠে দাঁড়ায়। আজ যদি আমরা সবাই একসঙ্গে বলি- তোমরা শুধু প্রতিবন্ধী নও, তোমরা একেকজন আলোর মশাল। তোমাদের ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হবে না, তোমরা উঠবে, জ্বলবে, আলো দেবে। তাহলে সেই দিন হয়তো একদিন প্রতিবন্ধী শব্দটিই শুধু থাকবে অভিধানে, বাস্তব জীবনে নয়।
লেখক : শিক্ষার্থী, গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
প্যানেল