ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

কলকাতার স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ভবন

ড. অরূপ রতন চৌধুরী

প্রকাশিত: ২১:২৭, ৯ ডিসেম্বর ২০২৩

কলকাতার স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ভবন

‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ ইতিহাস সমৃৃদ্ধ গৌরবোজ্জল একটি নাম

‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ ইতিহাস সমৃৃদ্ধ গৌরবোজ্জল একটি নাম। বাঙালি জাতির অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম মহান মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রাখা একটি প্রতিষ্ঠান। যুদ্ধে বাংলার যোদ্ধাদের মনোবলকে উদ্দীপ্ত এবং যুদ্ধে দিকবদলের পালে হাওয়া দিয়েছে এই বেতার কেন্দ্র। অপরদিকে শত্রুপক্ষের মনে কাঁপন ধরিয়ে দেওয়া শব্দবুলেট ছুড়ে ভীত-সন্ত্রস্ত করে রাখা মুক্তিযুদ্ধের একটি সেক্টর হলো ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’। সাধারণ মানুষ থেকে যোদ্ধারা অধীর আগ্রহ নিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান, সংবাদের জন্য অপেক্ষায় থাকতেন। সূচনা সংগীত হিসেবে বেতার কেন্দ্রটিতে প্রচার করা হতো ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’ উদ্দীপ্ত সৃষ্টিকারী বিখ্যাত গানটি।
পাকিস্তানি জল্লাদ বাহিনীকে বাংলার পবিত্র মাটি থেকে বিতাড়িত করার জন্য সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের পাশাপাশি যে যুদ্ধ মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসাহ-উদ্দীপনা ও সাহস জুগিয়েছে, সাড়ে ৭ কোটি বাঙালিকে অনুপ্রেরণা এবং হানাদার বাহিনীকে সর্বক্ষণ রেখেছে ভীতসন্ত্রস্ত তা হলো ‘মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ’। আর এই মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ পরিচালনা করেছিল ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র।’ স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে পাক সরকারের দখলকৃত এলাকার ৬টি বেতার কেন্দ্র থেকে অবিরাম প্রচ-ভাবে মুক্তিযোদ্ধা ও বাঙালি জাতির বিরুদ্ধে ভয়াবহভাবে মিথ্যাচার এবং অপপ্রচার চালানো হয়েছে। তার বিরুদ্ধে জবাব দেওয়া হয়েছে একমাত্র স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে। মুক্তিযুদ্ধ বিরুদ্ধ অপপ্রচারের বিরুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ছিল শক্তিশালী একটি প্ল্যাটফর্ম।
এই বেতার কেন্দ্রে তখন প্রযুক্তিগত সক্ষমতা যথার্থ না থাকলেও বেতার কেন্দ্রে প্রত্যেকের ছিল উদ্যমতা। বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের বাড়িটির দোতলার ছোট কক্ষটিতে (যেখানে মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ থাকতেন) দুটি ভাঙা টেপরেকর্ডার, সীমিতসংখ্যক বাদ্যযন্ত্র, কতিপয় যন্ত্রশিল্পী, চাদর টাঙানো রেকর্ডিং রুমেই চলে রেকর্ডিং কাজ। দুটি কক্ষে গাদাগাদি করে প্রায় ৭০ জন রাত্রি যাপন করতাম। এই বেতার কেন্দ্রই ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র।’ রক্তক্ষয়ী নয় মাস সম্মুখ যুদ্ধে দেশের অজস্র বীর সন্তান অকাতরে জীবন দিয়েছেন।

তাদের এ অবদান অবিস্মরণীয়। দেশ মাতৃকা স্বাধীন করতে জীবনকে তুচ্ছ ভেবে শত্রুর মোকাবিলায় তারা অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন। এমনও অনেক মুক্তিযোদ্ধা আছেন, যারা অস্ত্র হাতে তুলে নেননি, কিন্তু তাদের কণ্ঠ, তাদের আওয়াজ মুক্তিযুদ্ধ ও আমাদের মুক্তি সেনানীদের, আমাদের স্বাধীনতা প্রিয় জনগণকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। অনুপ্রেরণা আর উৎসাহ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সফলতায় ভূমিকা রেখেছেন। দেশকে স্বাধীন বাংলাদেশ উপহার দিয়েছেন তারা হলেন- স্বাধীন বাংলা বেতারের শব্দসৈনিক, বীর মুক্তিযোদ্ধা।
প্রথম পর্যায়ে চট্টগ্রাম বেতারের কালুরঘাট ট্রান্সমিটারে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র সংগঠিত হয়েছিল চট্টগাম বেতারের দশজন নিবেদিত কর্মী (দুজন বেতার কর্মী ছিলেন না), স্থানীয় নেতৃবৃন্দ, জনগণ এবং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সহযোগিতায়। এই বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রের ১০ জন সার্বক্ষণিক সংগঠক ছিলেন বেলাল মোহাম্মদ, আবুল কাশেম সন্দ্বিপ, সৈয়দ আব্দুল শাকের, আব্দুল্লাহ আল ফারুক, মোস্তফা আনোয়ার, রাশেদুর হোসেন, আমিনুর রহমান, শারফজ্জামান, রেজাউল করিম চৌধুরী এবং কাজী হাবিব উদ্দিন। স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রের প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন বেলাল মোহাম্মদ।
১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল শপথ গ্রহণের পর প্রবাসী সরকার কাজ শুরু করে। ১৯ এপ্রিল এই সরকারের মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে আব্দুল মান্নানকে মন্ত্রী পদমর্যাদায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। ২৪ মে দুটি রেকর্ডার মেশিন এবং মাত্র ১টি মাইক্রোফোন দিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের যাত্রা শুরু হয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২৫ মে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিনে কলকাতার ২৫ মাইল দূরে ৫০ কিলোওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন কেন্দ্রে কুরআন তেলাওয়াত ও বক্তৃতার মাত্র ১০ মিনিটের প্রচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলা বেতারের অস্তিত্বের প্রকাশ ঘটে। মিডিয়াম ওয়েভ ৩৬১.৪৪ মিটার ব্যান্ডে সেকেন্ড প্রতি ৮৩০ কিলোসাইকেলে প্রতিধ্বনিত হয় এটি।

শুরুতে কেন্দ্রটিকে বেশ সমস্যার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত অত্যধিক জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ছিল ‘চরমপত্র’। এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধের গান, যুদ্ধক্ষেত্রের সংবাদ, রণাঙ্গনের সাফল্য কাহিনী, সংবাদ বুলেটিন, ধর্মীয় কথিকা, বজ্রকণ্ঠ, নাটক, সাহিত্য আসরসহ কিছু অনুষ্ঠান পরিধি বেড়ে দৈনিক ১০ ঘণ্টা পর্যন্ত নিয়মিত প্রচার হতো। আর এই বেতার কেন্দ্রের একজন কণ্ঠসৈনিক ছিলাম আমি, যার জন্য গর্বিত মনে করি।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র হাতিয়ারের চেয়ে শক্তিশালী আঘাত হেনেছে নরপশুদের বিরুদ্ধে। মুজিবনগর সরকার নিজস্ব পূর্ণাঙ্গ বেতার কেন্দ্রের গুরুত্ব অনুধাবন করে ভারত সরকারের সহযোগিতায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করে। প্রাপ্ত যন্ত্রপাতি দিয়ে নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও ১৯৭১ সালের ২৫ মে মুজিবনগর থেকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র পূর্ণাঙ্গভাবে কার্যক্রম শুরু করে, যা ১৯৭২ সালের ২ জানুয়ারি পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের এই অবদানের কথা যেমন অনস্বীকার্য, তেমনি এই বেতার কেন্দ্রের সকল শিল্পী কলা-কুশলীদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি ও যুদ্ধে তাদের ভূমিকা প্রশংসনীয় ও সকল পর্যায়ে সমাদৃত।

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুসহ নেতৃবৃন্দের ভাষণ সাড়ে ৭ কোটি বাঙালি ও মুক্তিযোদ্ধাদের মনে ব্যাপক আশার আলো সঞ্চার করেছিল। এই বেতার কেন্দ্র দীর্ঘ নয় মাস অমিত তেজ ও তেজস্বিনী ভাষা আর দৃপ্তকণ্ঠে দুর্বার অনুষ্ঠান প্রচারের মাধ্যমে বাংলা ও বাঙালির অতন্দ্রপ্রহরী ‘মুক্তিযোদ্ধাদের’ সার্বক্ষণিক অনুপ্রেরণা, শক্তি ও সাহস দিয়ে দিশাহারা মুক্তিকামী বাঙালি জাতিকে বিজয়ের দারপ্রান্তে পৌঁছে দিয়েছে।
বর্তমান সরকার স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সকল শব্দসৈনিককে বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সম্মাননা ও স্বীকৃতি দিয়েছে। তাদের জন্য ভাতাও বরাদ্দ করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সরকারকে জানাই আমাদের আন্তরিক কৃতজ্ঞতা। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া অনেক গৌরবের ও বীরত্বের। এই বীরত্ব দেশমাতৃকার অস্তিত্বের লড়াইয়ে একজন সৈনিক হিসেবে। মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলার ইতিহাসে ইতোমধ্যে স্বাধীন বাংলা বেতারের সকল কর্মী তাদের কর্মকা-ের জন্য বিশেষ স্থান করে নিয়েছেন।

নতুন প্রজন্ম যেন তাদের কথা ভুলে না যায় সেজন্য স্বাধীন বাংলা বেতারের গান, নাটক, কবিতা, সংবাদ যা এখনো আমাদের মনকে, স্মৃতিকে আন্দোলিত করে- সেগুলো যথাযথ সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। আমি ২০১৮ সালে কলকাতার ৫৭/৮ বালীগঞ্জ সার্কুলার রোডে বেতার কেন্দ্র ভবনটি দেখতে গিয়েছিলাম। অবাক হয়ে দেখলাম, আজও বীরদর্পে মাথা উঁচু করে ঠিক সেভাবেই দাঁড়িয়ে আছে ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ভবনটি।’ বয়সের ভারে মলিন হয়েছে রং, আশপাশে উচ্চ ভবনের পাশে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের মূল ভবনটিকে ছোট মনে হয়। কিন্তু, আমাদের হৃদয়ে মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রাখা অনন্য এই স্থাপনাটির অবস্থান আজীবন আকাশ সমান।
নতুন প্রজন্মের কাছে যেন সেই কথা, আমাদের সেই অনুভূূতি যেন অব্যক্ত থেকে না যায়। স্বাধীনতা যুদ্ধে এই কেন্দ্রটির অসামান্য অবদান ইতিহাসের আড়ালে যেন চাপা না পড়ে। এজন্য বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে ভবনটির যথাযথ সংরক্ষণ ও মুক্তিযুদ্ধের দলিল হিসেবে একটি জাদুঘরে রূপান্তর করা প্রয়োজন। যাতে আগামী প্রজন্ম মহান মুক্তিযুদ্ধে ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের’ সঠিক ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারে। ভারত আমাদের বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র। মুক্তিযুদ্ধের সময়েও ভারতের সহায়তা ছিল অগ্রগণ্য। তাই ভারত সরকারের কাছ থেকে ভবনটির স্বত্ব প্রয়োজনে কিনে নিয়ে হলেও ইতিহাসসমৃৃদ্ধ ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ মুক্তিযুদ্ধের স্মারক চিহ্ন হিসেবে সংরক্ষণ এবং একটি জাদুঘরে রূপান্তর এখন সময়ের দাবি। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ বিষয়ে আশু পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন বলে আমরা আশাবাদী।

লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা, অধ্যাপক, একুশে পদকপ্রাপ্ত শব্দসৈনিক, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থা (মানস) সদস্য, জাতীয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ বোর্ড (স্বরাষ্ট্র্র মন্ত্রণালয়) এবং জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ টাস্কফোর্স কমিটি (স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়) সাম্মানিক জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা, ডিপার্টমেন্ট অব ডেন্টাল সার্জারি, বারডেম ও অধ্যাপক, ইব্রাহিম মেডিক্যাল কলেজ

[email protected]

×