ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

বাংলাদেশের মানবাধিকার অনেক দেশের পাথেয়

ড. শাহজাহান মন্ডল

প্রকাশিত: ২১:১৬, ৯ ডিসেম্বর ২০২৩

বাংলাদেশের মানবাধিকার অনেক দেশের পাথেয়

আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার সরকার মানবাধিকার বাস্তবায়নের জন্য সদা সচেষ্ট

আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার সরকার মানবাধিকার বাস্তবায়নের জন্য সদা সচেষ্ট। জনগণের মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল বলেই আওয়ামী লীগ কখনো অসাংবিধানিক পন্থায় তথা নির্বাচন ব্যতিরেকে ক্ষমতায় যাওয়ার চেষ্টা করেনি

জানুয়ারিতে (২০২৩) অনুষ্ঠিতব্য দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বাংলাদেশের কিছু প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়া যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের কিছু লোকের মতো বলে চলেছে যে, বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি খুব নাজুক। এমনকি এদেশে এখন মানবাধিকার নেই বললেও যেন অত্যুক্তি হয় না। আওয়ামী লীগ ও জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকার বিএনপির কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি মানছে না বলে যেন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে! বিএনপির নেতারা রাস্তায় ধুয়ো তুলছেন এই বলে যে, গেল গেল এদেশে মানবাধিকার চুলোয় গেল।

হে মানবাধিকারের প্রবক্তা ইউরোপ-যুক্তরাষ্ট্র, তোমরা দেখে যাও, এদেশে মানবাধিকারের কী হাল! সেসব দেশের কিছু প্রতিষ্ঠান ও প্রতিনিধি বাংলাদেশের কিছু ব্যক্তির ওপর সেদেশে ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে খুশি। বিএনপি বিদেশে বহু কোটি টাকার লবিস্ট নিয়োগ দিয়ে বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণা চালিয়ে আরও খুশি। বাংলাদেশে মানবাধিকার নেই ধরনের অপপ্রচার করে আনন্দিত। নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারাতেই যেন বিএনপি ও তার মিত্র দলগুলোর স্বস্তি। দেশের জন্য তাদেরও যে একটা কর্তব্য আছে, তা যেন তারা জানেই না। নির্বাচনে অংশ নিয়ে দেশকে বিদেশীদের কুনজর থেকে রক্ষা করা যেন শুধু একা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোটের কর্তব্য। ২০২৬-এ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়া যেন তাদের অনাকাক্সিক্ষত।

মানবাধিকারের তথাকথিত অনুপস্থিতি প্রচার করতে তারা এতটাই আগ্রহী যে, তাদের ভাঙা সুটকেসের ভেতর থেকে বিলিয়ন ডলার পানিতে ফেলতেও তাদের বাধে না। কিন্তু বস্তুগত কথা হলো, দেশের প্রতি কোনো দায়িত্ববোধ থাকলে মানবাধিকার সম্পর্কে এমন অপরিপক্ক কথা বিএনপি ও মিত্ররা বলতে পারত না। নির্বাচন সংবিধানে বর্ণিত নিয়মে হবে বললেই তারা ক্ষিপ্ত হয়। কারণ, সংবিধান মান্য না করাটা তাদের মজ্জাগত। স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট সপরিবারে হত্যা করে সংবিধান লঙ্ঘনপূর্বক ক্ষমতা দখল করেছিল বলেই সংবিধানের প্রতি বিএনপির এমন তীব্র অনীহা।
১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর রাষ্ট্রসংঘ যে ‘মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণা’ (ঞযব টহরাবৎংধষ উবপষধৎধঃরড়হ ড়ভ ঐঁসধহ জরমযঃং বা টউঐজ) গ্রহণ করে তার ২১ অনুচ্ছেদে যে মানবাধিকার বর্ণিত তা হলো, প্রত্যক্ষভাবে বা অবাধে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে নিজ দেশের শাসন পরিচালনায় অংশগ্রহণের অধিকার প্রত্যেকেরই রয়েছে। আরও বলা আছে, জনগণের ইচ্ছাই হবে সরকারের শাসন ক্ষমতার ভিত্তি।... এ ইচ্ছা...নির্বাচনের মাধ্যমে ব্যক্ত হবে। বাংলাদেশের সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদে এ মানবাধিকারটি সুন্দরভাবে গৃহীত। আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার সরকার মানবাধিকারটি বাস্তবায়নের জন্য সদা সচেষ্ট।

জনগণের এ মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল বলেই আওয়ামী লীগ কখনো অসাংবিধানিক পন্থায় তথা নির্বাচন ব্যতিরেকে ক্ষমতায় যাওয়ার চেষ্টা করেনি। অথচ কে না জানে বিএনপির জন্ম ও ক্ষমতায় আগমন বন্দুকের জোরেÑ অসাংবিধানিক পন্থায়। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যে উদ্বিগ্নতা পোষণ করছে, তার কারণ কেয়ারটেকার সরকারের অনুপস্থিতি নয়, বরং বিএনপির সঙ্গে সুর মিলিয়ে তাকে নির্বাচন থেকে বাইরে রেখে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করা। সম্ভব হলে বিএনপিকে সাহায্য করতে আসার অজুহাতে সেইন্ট মার্টিন দ্বীপে হাজির হয়ে ঘাঁটি তৈরির পথ সুগম করা, যার সুযোগ আওয়ামী লীগ কখনোই দেবে না। খোদ যুক্তরাষ্ট্রে কেয়ারটেকার সরকারের কোনো অস্তিত্ব নেই। তাহলে কেন বিএনপির কেয়ারটেকার দাবিকে সে সমর্থন করে তা সহজেই অনুমেয়। বিএনপি ও তার সঙ্গীদের উপলব্ধি করা প্রয়োজন যে, ইউরোপ-যুক্তরাষ্ট্র তাদের দাবার ঘুঁটি বানিয়ে দেশে অস্থিশীলতা আনতে চায়। 
গত ২৮ অক্টোবর বিএনপি ও তার শরিকদের নেতাকর্মীরা ‘পুলিশ’ পিটিয়ে হত্যা করেছে। পেট্রোল ও গান পাওডার দিয়ে এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ২২৯টি বাস-ট্রাক পুড়িয়েছে। হরতাল-অবরোধ দিয়ে জনজীবনকে চরম অস্বস্তিতে ফেলেছে। দেশে উৎপাদন ব্যবস্থা বিঘিœত হয়েছে। যাতায়াত ব্যবস্থা এবং দেশের সবচেয়ে বড় রেমিটেন্স খাত গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। এ ঘটনাগুলো ইউরোপ-যুক্তরাষ্ট্র দেখেও না দেখার ভান করছে। যেমন ভান করছে তাদের নিজ দেশে স্কুলে, শপিং মলে বন্দুক হামলায় প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু দেখেও। পিউ রিসার্চ সেন্টারের (মঁহ ংযড়ড়ঃরহম রহ টঝ,)  গবেষণায় দেখা যায়, ২০২১-এ সেদেশে এ জাতীয় বন্দুক হামলায় মৃত্যু হয় ৪৮ হাজারের ওপরে। পরের বছরও প্রায় একইচিত্র। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিদিন গড়ে ১২ জন শিশু স্কুলে বন্দুক হামলায় মারা যায়।

এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র মানবাধিকার বিষয়ে নির্বিকার থাকে। বিএনপির নেতাদের হুকুমে কর্মীরা মানুষ হত্যা করলে এবং গাড়ি পোড়ালে যখন মামলা হচ্ছে, তখন যদি বলা হয়, রাজনৈতিক মামলার দ্বারা হয়রানি করা হচ্ছে, তাহলে তা দুঃখজনক অবশ্যই। তাদের কথা সত্য হলে রাজনীতির সংজ্ঞাই পাল্টে ফেলতে হবে। বলতে হবে মানুষ পিটিয়ে হত্যা আর গাড়ি পোড়ানোর নাম রাজনীতি। বস্তুত বিএনপি ও শরিকদের সন্ত্রাসী কর্মকা- কখনোই রাজনীতির আওতায় পড়ে না। প্রতিদিন টিভি খুললেই যখন দেখি, তাদের নেতাকর্মীরা সানন্দে সভা ও মহাসমাবেশ করছে, রোডমার্চ করছে, সংবাদ সম্মেলন করছে, জাতীয় প্রেসক্লাবে জড়ো হয়ে টিভি ক্যামেরার সামনে ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করছে, তখন কি তা সংবিধানের ৩৬ অনুচ্ছেদে বর্ণিত আন্দোলনের অধিকার, ৩৭-এ বর্ণিত সমবেত হওয়ার অধিকার, ৩৮-এ বর্ণিত সংগঠনের অধিকার আর ৩৯-এ বর্ণিত মতামত, বাক্ ও ভাব প্রকাশের অধিকার চর্চা করছে না?

তবে মানবাধিকার বলতে শুধু এগুলোকেই বোঝায় না। আধুনিক বিশে^ মোট ২৭টি অধিকারকে মানবাধিকার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে ‘মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণায়’ (টউঐজ) ২৫টি মানবাধিকার স্বীকৃত (৬টি সমাজতান্ত্রিক এবং ১৯টি বুর্জোয়া বা পুঁজিবাদী)। ঘোষণাটি ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর রাষ্ট্রসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত হয় বলে ১০ ডিসেম্বর বিশ্ব মানবাধিকার দিবস পালিত হয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে প্রণীত বাংলাদেশের ১৯৭২ সালের সংবিধান (বা বর্তমান সংবিধান) টউঐজ-এর মানবাধিকারগুলোকে ২য় ও ৩য় ভাগে ব্যাপকভাবে গ্রহণ করে। সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগের ১৫ক, ২৩ ও ২৩ক অনুচ্ছেদে বর্ণিত ছয়টি মানবাধিকার হলো- অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান ও সংস্কৃতির অধিকার। তৃতীয় ভাগের ১৭টি অধিকার হলোÑ আইনের দৃষ্টিতে সমতা পাওয়ার অধিকার, বৈষম্যের শিকার না হওয়া, সরকারি নিয়োগ লাভে সমান সুযোগ পাওয়া আইনের আশ্রয় লাভ, জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতা, গ্রেপ্তার ও আটকের ক্ষেত্রে রক্ষাকবচ পাওয়া, জবরদস্তি শ্রম থেকে রক্ষা পাওয়া, বিচার ও দণ্ড বিষয়ক রক্ষণ পাওয়া, চলাফেরা বা আন্দোলন-সমাবেশ-সংগঠনের স্বাধীনতা লাভ, চিন্তা-বিবেক ও বাক্স্বাধীনতা পাওয়া, পেশা বা বৃত্তির স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা লাভ, সম্পত্তি, গৃহ ও যোগাযোগের রক্ষণ পাওয়ার এবং হাইকোর্ট বিভাগে রিট মামলা করার অধিকার (অনুচ্ছেদ ২৭, ২৮, ২৯, ৩১, ৩২, ৩৩, ৩৪, ৩৫, ৩৬, ৩৭, ৩৮, ৩৯, ৪০, ৪১, ৪২, ৪৩ ও ৪৪)।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মানবাধিকার সমূহকে সংবিধানে তথা দেশের সর্বোচ্চ আইনে অন্তর্ভুক্ত করেন বিধায় তাঁর দল আওয়ামী লীগ এবং তাঁর সুযোগ্যকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা জনগণের মানবাধিকার রক্ষায় যতটা আগ্রহী ও সচেষ্ট হবে, ততটা আর কেউ হবে কি না সন্দেহ। কারণ, দুঃখজনক হলেও সত্য যে, দেশের অন্যতম বিরোধী দল বিএনপি ও তার অনেক দোসরের মানবাধিকার লঙ্ঘনের যে রেকর্ড আছে, তা যে কারও পক্ষে ভাঙ্গা দুঃসাধ্য। ইউরোপ-যুক্তরাষ্ট্র ভালোই জানে যে, বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার নেপথ্যে কে ছিল।

বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের ইশারাতেই ’৭৫-এর ২৬ সেপ্টেম্বর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি খোন্দকার মোশতাক ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে উক্ত হত্যাকা-ের বিচারের পথ রুদ্ধ করে। এ অর্ডিন্যান্সকে জাতীয় সংসদ তখনকার রাষ্ট্রপতি জিয়ার ইচ্ছায় ১৯৭৯ সালের ৬ এপ্রিল সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী দ্বারা বৈধতা প্রদান করে। এ সংশোধনী মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনকে তথা ‘লাঠিতন্ত্রকে’ বৈধতা দিয়ে গণতন্ত্রকে বিদায় করে। তৎপূর্বে ১৯৭৭ সালের ৩০ মে (‘হ্যাঁ’-‘না’ বা) গণভোটের মাধ্যমে জনগণকে ধোঁকা দিয়ে তাদের নিকট থেকে জিয়ার সামরিক শাসনের প্রতি সমর্থন নেওয়া হয় এবং সরলমনা মুসলিমদের ধর্মীয় চেতনা নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হয়।

বিএনপির শাসনামলেই ঢাকায় শেখ হাসিনার জনসভায় গ্রেনেড হামলা করে ২৪ জনকে হত্যা করা হয় এবং প্রায় ৫০০ জনকে আহত করা হয়। চোরাপথে ১০ ট্রাক অবৈধ অস্ত্র আনা হয়। তাদের ইঙ্গিতেই দেশের ৬৩ জেলার ৫০০ স্থানে একই সময়ে বোমা ফাটিয়ে রাষ্ট্রের নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলা হয়। তাদের দ্বারাই শেখ হাসিনাকে ১৯ বার হত্যার চেষ্টা ও হামলা হয়। অথচ শেখ হাসিনা বা আওয়ামী লীগ একবারের জন্যও বিএনপির নেতানেত্রীদের হত্যা করার চেষ্টা করেনি। বরং দুর্নীতির দায়ে সাজাপ্রাপ্ত বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াকে অনুকম্পা দেখিয়ে জেল থেকে বের করে বাড়িতে থাকাসহ সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। শেখ হাসিনা বা আওয়ামী লীগ সরকার বাংলাদেশে যেভাবে সংবিধানে, আইনে এবং বাস্তবে মানবাধিকার সংরক্ষণ ও বাস্তবায়ন করে চলেছে, তা অভাবনীয় এবং বহু দেশের জন্য পাথেয়।

লেখক : সাবেক ডীন, আইন অনুষদ
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া ও কেন্দ্রীয় আইন বিষয়ক সম্পাদক
বঙ্গবন্ধু পরিষদ

×