ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৭ মে ২০২৫, ২৪ বৈশাখ ১৪৩২

বিজয়ের আগের দুঃসহ ঘটনা

মমতাজ লতিফ

প্রকাশিত: ২০:৩৩, ৬ ডিসেম্বর ২০২৩

বিজয়ের আগের দুঃসহ ঘটনা

ট্রেন চলা শুরু করল

ট্রেন চলা শুরু করল। কোনের দিকে এক তরুণ মাথা মুখ নিচু করে বসা। মনে হলো ও মুক্তিযুদ্ধে যাচ্ছে। এর মধ্যে এক খান সেনা লম্বা রাইফেল বাগিয়ে বগিতে উঠল। নল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আমাদের সবাইকে দেখল। জ্যেঠাকে বলল, ‘ইয়ে কেয়া পড়তা?’ জ্যেঠা বলল, ‘আল্লাহ কা কিতাব।’ ওরা তো নিরক্ষর, কুরআন-হাদিসের নামও জানে না। কি ভেবে আর কিছু না বলে নেমে গেল। আমরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। ওদিকে বসা মহিলা পানের বাটা বের করে পান বানিয়ে মুখে দিল। সঙ্গে বসা নাতির সঙ্গে কথা বলতে শুরু করল। এক সময় চট্টগ্রাম স্টেশনে পৌঁছল ট্রেন। জ্যেঠা, আমার স্বামী দুটো রিকশা নিল। নিথর, নিস্তব্ধ, জনমানবহীন অচেনা শহরটিতে, তবু রিকশাওয়ালারা রিকশা চালাচ্ছিল দুটো পয়সার জন্য। মনে মনে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছিলাম।

পথে হঠাৎ একদল বিহারি ছেলে, বালক বয়সী হৈ হৈ করে এদিক থেকে ওদিকে চলে গেল। আমাদের দু’রিকশা ছাড়া আরও দু’একটা রিকশা পথ ধরে চলে গেল। যা হোক, আমরা আমাদের গন্তব্য কাজী বাড়ির জমিদার বাড়িতে এসে পৌঁছলাম। কাজী চাচা বিকালে মা আর জ্যেঠার সঙ্গে দেখা করতে এলো। বাবা মাকে টাকা দিয়েছিল আমরা যেন পিআইএর বিমানের টিকেট করতে কাজী চাচাকে বলি। কাজী চাচা লোক পাঠিয়ে বিমানের টিকেট কিনে দিলেন। দু’দিন পর যাত্রা। মা রান্না-খাওয়ার ব্যবস্থার করছে। ডাল, ভাত, আলু ভর্তা। পরদিন আমার স্বামী তার বন্ধু চট্টগ্রাম কলেজের বাংলার শিক্ষক রফিক ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে আর সম্ভব হলে ডাক্তার আনতে রওনা হলো।

এসব গলিপথ আজ হয়তো নেই। কিন্তু তখন গোপন পাড়ার ভেতরের পথগুলো কত মানুষকে যে রক্ষা করেছে, তার ইয়ত্তা নেই। ঐ পথে তিনি রফিক ভাই, সঙ্গে রফিক ভাইয়ের পরিচিত চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের ডাক্তার মান্নানকে সঙ্গে নিয়ে ফিরল। ডাক্তার মান্নান আমার কাছে বাচ্চার ব্যবহৃত কাপড় দেখলেন। তারপর লিখে দিলেন, গুয়ানেমাইসিন সিরাপ। বারবার খাওয়াতে হবে, যতবার ডায়রিয়া হয়। ম্যাজিকের মতো কাজ করল এই সিরাপ। আজও মনে পড়ে, কী ধন্বন্তরি ডাক্তার পেয়েছিলাম সেদিন। বলে দিয়েছিলেন, ‘ঢাকায় গিয়েই এম.আর.খানকে দেখাবেন। এ ওষুধে আপাতত ভালো হবে, কিন্তু পরে অন্য ওষুধ লাগবে।’ ডা. মান্নান এবং ডা. এম. আর. খানের প্রতি কৃতজ্ঞতায় মন ভরে ওঠে আজও।

ঢাকায় বিমান বন্দরে নিতে এসেছিল আমার স্বামীর স্কুল বন্ধু পোস্টাল বিভাগের কর্মকর্তা নুরুল ইসলাম চৌধুরী, পিডিবির কর্মকর্তা ফিরোজ সাহেব, যিনি ব্রাদার নামে পরিচিত। মা আমাকে যদি টাকার প্রয়োজন হয়, এই ভেবে কানে, হাতে, গলায় গয়না পরিয়ে দিয়েছিল। মার ধারণা ছিল, ওরা গয়না নিতে চাইলে নিক, তবে মেয়ে নিরাপদ থাকবে। প্রয়োজনে গয়না বিক্রি করা যাবে। আমার সন্দেহ, ঐ অন্ধকার অনিশ্চিত জীবনে টাকা হাত ছাড়া করতে কেউই চাইবে না। গয়না কিনে টাকা হাতছাড়া কেউ করবে না। যা হোক, বিমানে ওঠার আগে পিআইএর বিদেশী এয়ার হোস্টেস ভিড়ের মধ্যে আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। প্রথমে বুঝতে পারিনি, পরে ও বারবার ডাকলে বুঝলাম, সে আমাকে ডাকছে। আমরা সিবাই বিমান বন্দরে মেঝেতে বসা।

উঠে গেলাম, কোলে কঙ্কালসার ছোট শিশু। ও কাঁথা সরিয়ে দেখল, জিজ্ঞেস করল, কোথায় ছিলাম, কোনো নির্যাতনের শিকার হয়েছি কিনা ইত্যাদি। ইংরেজিতে কথা বলছিল, আমি কোনোমতে উত্তর দিলাম। বিমানে আমরা সিটে বসেছি, সামনে এক সেনা আমাদের দিকে রাইফেল তাক করে সারাক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল। 
যা হোক, ঐ মে মাসের শেষে ক্যাম্পাসের বাসায় উঠলাম। জুলাই মাসের দিকে বাসায় এসে উঠল জয়পুরহাট সুগার মিলে কর্মরত আমার ননদের স্বামী, ননদ তিন সন্তান নিয়ে। ওখানে ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে খান সেনারা। ওরা প্রাণ হাতে নিয়ে ঢাকার পথে রওনা হয়ে বেঁচে এসেছে। এরপর আসে ময়মনসিংহ কৃষি কলেজ থেকে খালাত দেবর। সেপ্টেম্বরে আলবদরের তালিকায় নাম আছে আমার ভাই মোমেনেরÑ এ খবর জানায় খালাত ভাই যীষু। বাবা ওকে আমার কাছে পাঠিয়ে দেয়। ছোড়দা ভারতে চলে গেছে। সঙ্গে ছিল ফুপাত দেবর কৃষিবিদ ইয়াসিন। আর ছিল কাশেম নামে এক কিশোর ছেলে। এর মধ্যে ঢাকায় ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে গুলিগোলা ফোটার আওয়াজ। আমরা খুশি হয়ে উঠতাম। আমাদের মুক্তিযোদ্ধা ভাইরা ঢাকায় অপারেশন করছে। 
এরই মধ্যে একদিন, ১০ তারিখ হবে ডিসেম্বরের, সকালে ঘুম ভাঙল খুব খারাপ স্বপ্ন দেখে। সকালের রোদ বিছানায় এসে পড়েছে। উঠে বসে প্রথম যে সিদ্ধান্ত নিলাম, তা হলো, এই ক্যাম্পাসে সাংঘাতিক কিছু ঘটনা ঘটবে। এখানে আমরা থাকব না। যেভাবেই হোক সবাইকে নিয়ে ক্যাম্পাস ছাড়তে হবে। আমার স্বামী শুনে প্রথমে এত লোক নিয়ে কোথায় যাব, এসব ভেবে রাজি হচ্ছিল না।  গোঁ ধরে থাকলাম, কেউ না গেলেও আমি বাচ্চাদের নিয়ে চলে যাব কোথাও। শেষে তাকে রাজি করিয়ে তার বন্ধুদের খোঁজ করতে পাঠালাম। নিজে দ্রুত কোলের বাচ্চাটাকে নিয়ে নিচ তালায় সন্তোষ ভট্টাচার্য মেসো মশাইর বাড়ি গেলাম। 
বললাম, ‘মেসোমশাই তাড়াতাড়ি এ জায়গা ছেড়ে যেতে হবে। এখানে কিছু একটা হবে। মাসিমা, মেসোমশাই, দেরি করবেন না, চলে যান এখান থেকে, খারাপ কিছু একটা হবে।’ মেসোমশাই বলল, ‘মা, তুমি এই দুধের বাচ্চা নিয়ে কোথায় যাবে, বাঁচাবে কি ভাবে ওকে, কোথায় থাকবে?’ বললাম, ‘মেসোমশাই, এখান থেকে রাস্তা অনেক ভালো থাকব, পথে পথে গ্রামের লোক আমাদের খাওয়াবে, ওরাই আশ্রয় দেবে, দরকার হলে গাছতলায় থাকব।’ মেসোমশাই বলল, ‘তা কি হয়?’ ভূঁইঞা সাহেব বলেছেন, তার পীর নাকি বলেছে, ‘এ ক্যাম্পাস সবচেয়ে নিরাপদ, অন্য কোথাও যাওয়ার দরকার নেই।’ শুনে আমি রেগে গেলাম। বললাম, ‘আপনি জানেন না, ঐ পীরেরা সবাই পাকিস্তানপন্থি? ওরা আমাদের ভালো চায় না, মুক্তিযুদ্ধ ওরা চায় না, ওরা পাকিস্তান চায় ..?

আমি কিন্তু বলছি, আমি এ ক্যাম্পাসে থাকব না..,’ দ্রুত ওপরে ঘরে ফিরলাম। মাথাটা গরম হয়ে গেছে। দেখি আমার স্বামী হয়রান হয়ে অনেক হেঁটে ঘোরাঘুরি করে বন্ধুদের বাড়ি তালাবদ্ধ পেয়ে মন খারাপ করে ফেরত এসেছে। বললাম, ‘বিকালে আমার বন্ধু রওশন-শাহাবুদ্দীনের বাসায় যাও। ওদের জিজ্ঞেস কর, ওরা কোথাও যাবে কিনা।’ বিকালে রোকেয়া হলের সহকারী হাউস টিউটর বন্ধু রওশনের বাসায় গেল ও। ওরা জানাল, আজকের ভোরে ওরা রওনা হবে। যদি ওদের সঙ্গে দোহার-বিক্রমপুর যাই, তাহলে ভোরে ওদের সঙ্গে রওনা দিতে হবে। তক্ষণি ওনাকে বাজারে পাঠিয়ে দুই কৌটা দুধ, চিনি, কয়েকটা পাউরুটি কিনে আনালাম। মাঝরাতে উঠে বড় এক ডেকচি খিঁচুড়ি রান্না করলাম। চাদরে ডেকচিটা বেঁধে কিশোর কাশেমের মাথায় তুলে দিলাম। অন্ধকারে আবার আরেকবার আমরা পথে নামলাম। মাথার ওপর স্বাধীনতার জন্য আমাদের মিত্র বাহিনীর প্লেন, নিচে আমরা হাজার হাজার বাঙালি নারী পুরুষ শহর ছেড়ে যাচ্ছি গ্রামে। আবার সেই এপ্রিলের পর আরেকবার। 
সোয়ারীঘাট থেকে দুটো গয়না নৌকা ভাড়া করে উঠলাম আমরা সবাই রওশন-শাহাবদ্দীনের পরিবার স্বজন। সেদিনের বুড়িগঙ্গা জলে টইটম্বুর, নৌকা-লঞ্চে ভরপুর, যেগুলোতে চড়ে শহরবাসী আবারও গ্রামে যাচ্ছে জীবন বাঁচাতে। একদিন  একরাত এক বড় লঞ্চে কাটিয়ে পরদিন নৌকায় দুপুরে যখন পাড়ে নামি, তখন স্বস্তিতেÑশান্তিতে পথের ক্লান্তি ভুলে হাঁটতে হাঁটতে এক সময় বিকালে আমরা দোহার গ্রামের শাহাবুদ্দীনের বাড়িতে পৌঁছাই। সন্ধ্যায় বাজার করে আনল দেবররা। ননদ আয়েশা কাঠের চুলায় দক্ষ হাতে ভাত, নিরামিষ রান্না করল। সবাই খেল। শাহাবুদ্দীনরা একটা বড় ঘর ছেড়ে দিল আমাদের। আমরা ধানের শুকনা খড় বিছিয়ে তার ওপর চাদর বালিশ দিয়ে লেপ নিয়ে আরামের বিছানায় ঘুমালাম। পরদিন ভাই-দেবররা গ্রাম দেখতে বের হলো।

ফিরে এসে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার জন্য তরুণদের মার্চ দেখে এসে মোমেন বলল, এদের যে মনোবল এরা যুদ্ধে জিততে পারবে।’ শুনে মনটা খুশিতে ভরে গেল। ক’দিন আমরা শান্তি ও স্বস্তিতে থাকলাম। ১৬ ডিসেম্বর বিকালে গ্রামে বিজয় মিছিল বের হলো। জানলাম, দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। মিষ্টি কিনে আনা হলো। তারপর ঢাকা যাত্রা। মুক্তিযোদ্ধারা সবাই ঢাকা যাচ্ছে, খালি লঞ্চ পাওয়া যাচ্ছে না। অবশেষে ১৯ ডিসেম্বর একটা বড় লঞ্চে সবাই উঠলাম দুপুরের ভাত খেয়ে। সন্ধ্যায় সদরঘাটে পৌঁছে সবাই খবরের কাগজ কিনছে, আর চিৎকার করে কেঁদে উঠছে। কী বিষয়। তাড়াতাড়ি স্বামীর হাতের কাগজে আমার চোখ আটকে গেল। সব স্যার শহীদ হয়ে গেছেন। মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, আনোয়ার পাশা, সন্তোষ ভট্টাচার্য মেসোমশাই, মুনীর চৌধুরী, গিয়াসুদ্দীন আহমদ, রাশিদুল হাসান, সিরাজুল ইসলাম, ফয়জুল মহী, ডা. আলিম চৌধুরী, ডা. রাব্বী, ডা. আজহারুল হক, ডা. হুমায়ুন কবীর। .... কত কত নাম আর ছবি। বাড়ি ফিরে এলাম।

প্রতিবেশীরা ছুটে এলো, ছুটে এলেন মাসিমা। স্বপ্না বলল, আমার স্বামীকে নিতে এসে পায়নি বলে দরজা ভেঙেছে। দেওয়ালে রবীন্দ্রনাথের ছবিতে গুলি করেছে। লাথি মেরে চেয়ার উল্টে রেখে গেছে। সেই ১২ ডিসেম্বর আমরা চলে গিয়েছিলাম। ১৪ ডিসেম্বর ৪৮ ঘণ্টার কার্ফ্যু দিয়ে সব স্যারকে তুলে নিয়ে গেছে। আমরা বেঁচেছি। তাঁরা শহীদ হয়ে গেলেন। পাড়ায় শহীদ পরিবারের ছেলেমেয়েরা আমার মেয়েদের বন্ধু, ভাই। ওরা একসঙ্গে বড় হয়েছে। ১৪ ডিসেম্বর এসেছিল বুদ্ধিজীবীদের হত্যার দিন হিসাবে। খুশির বিজয়ের দুই দিন আগে। খুনি আলবদর-আলশামস সদস্যরা দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে গেছে। তবে তারা খুনি। আর আমাদের স্যারেরা হলেন শহীদ। দেশ মাতা, কত লাখ লাখ যুবক, তরুণ-তরুণী, পৌঢ়া-প্রৌঢ়, শিশু-কিশোর দেশের শৃঙ্খল মুক্তির জন্য প্রাণ উৎসর্গ করেছে। বারবার তাদের জন্য চোখের জলে ভাসি। তবু, মাতৃভূমি বাংলাদেশ তোমাকে ভালোবাসি।

লেখক : শিক্ষাবিদ

×