
জাহাঙ্গীর আলম সরকার
বাঙালি জাতির হাজার বছরের অবিস্মরণীয় গৌরবময় মাসের নাম ডিসেম্বর। ধারাবাহিকভাবে দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রাম ও নয় মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে এই ভূখ-ের মানুষ বিজয় অর্জন করেছিল। ফলশ্রুতিতে পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন ভূখ- দৃশ্যমান হয়। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের বিজয় কোনো কাকতালীয় ঘটনা নয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৬৬-এর ছয় দফা, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭১-এর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ, ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা ইত্যাদি ঘটনাপ্রবাহ এক অভিন্ন সুতায় গ্রথিত।
পাশাপাশি ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠনের পর এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদ ও ২ লাখ মা-বোনের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয় বিজয়। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক লক্ষ্য অর্জিত হয়। কিন্তু অর্থনৈতিক মুক্তি, গণতন্ত্র, সামাজিক ন্যায়বিচার ও সামগ্রিক উন্নয়ন এখনো সুদূরপরাহত। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুও দেশের রাজনৈতিক মুক্তির পর অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য সাংবিধানিক সংস্কারের পথে এগিয়েছিলেন। ঠিক এই সময় তাঁকে হত্যা করা হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ঘটনা ছিল অনাকাক্সিক্ষত, অনভিপ্রেত।
যুগান্তকারী সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হওয়ার পরই আবার অবরুদ্ধ হয়ে যায়। স্বাধীনতার শত্রু এবং পাকিস্তানের দালালরা বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র সাড়ে তিন বছর পর ক্ষমতা দখল করে এবং দীর্ঘ ২১ বছর এই ক্ষমতা নানা পরিচয়ে কুক্ষিগত করে রাখে। এই ২১ বছর স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা রাজাকারদের গাড়িতে উঠেছে। জাতীয় সংগীত অবহেলিত হয়েছে। রাষ্ট্রের চার মূল আদর্শের ভিত্তি নষ্ট করা হয়েছে। ২১ বছর পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৯৯৬ সালে জয় বাংলা ধ্বনিত হয়। এরপর ২০০৮, ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে একাধারে টানা ৩ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আপামর জনগণের মধ্যে উজ্জীবিত হয়। বিজয়ের মাসে বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও অগ্রগতির প্রশ্নে মহান মুক্তিযুদ্ধের অবদানকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করাই এই রচনার মূল উদ্দেশ্য।
বিগত কয়েক দশকে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অভাবনীয় অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। দারিদ্র্য কমেছে উল্লেখযোগ্য মাত্রায়। কমেছে শিশুমৃত্যু, মাতৃমৃত্যুর হার। জনগণের রোজগার ও আয়ু বেড়েছে। পাশাপাশি নানামাত্রায় বেড়েছে শিক্ষার হার ও স্বাস্থ্যসেবার পরিধি। একই সঙ্গে হয়েছে নারীর ক্ষমতায়ন। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে তলাবিহীন ঝুড়ির দেশটির খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে তিন গুণের অনেক বেশি। আমরা ২০২৩ সালে ৫৩তম বিজয় দিবস উদ্যাপন করতে প্রস্তুত। এ উদ্যাপনের একটি দিক হলো আনুষ্ঠানিকতা- যার মাধ্যমে আমরা নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও বিজয়ের গৌরবময় দিকের বার্তা পৌঁছে দিতে পারি। কিন্তু এই বার্তাটি পৌঁছে দেওয়ার চেয়েও অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ রয়েছে। সেটিকে এড়িয়ে যাওয়া আমাদের উচিত নয়। বিজয়ের এই মাসে গণতন্ত্র, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার কতটা প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছি, সেই আত্মজিজ্ঞাসাও জরুরি।
জাতীয় জীবনে অনেক ইতিবাচক দিক থাকা সত্ত্বেও স্বীকার করতে হবে যে, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে আছি। তিন দশক ধরে সংসদীয় গণতন্ত্র চালু রয়েছে। কিন্তু জাতীয় সংসদ রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু কতটা হয়েছে, সেটি এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ভঙ্গুর অবস্থা। রাজনীতিতে সহনশীলতা ও সমঝোতার নীতি অনুপস্থিতÑ ইত্যাদি বিষয়গুলোতে রাজনৈতিক দলগুলো দায় এড়িয়ে যেতে পারে না। ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। কিন্তু গণতন্ত্রকে সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে সেই নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ আমরা দেখছি না। যদি তারাও অংশগ্রহণ করত, তবে সেটি আরও অংশীদারিত্বমূলক হতো। রাজনীতিতে বিরোধ ও সমস্যা থাকবে, আলোচনার মাধ্যমেই তার সমাধান কাম্য। আমাদের রাজনীতি ও গণতন্ত্রের এসব সংকট দূর হোক, এটাই বিজয়ের প্রত্যাশা।
১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদের কাছে জেনারেল এরশাদ ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। ইতিহাসে সেই দিনটিকে ‘গণতন্ত্র মুক্তি দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়। এই ইতিহাস কারোরই অজানা নয়। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ৮ দলীয়, বিএনপির নেতৃত্বে ৭ দলীয় এবং সিপিবি, জাসদ (ইনু), ওয়ার্কার্স পার্টির নেতৃত্বে ৫ দলীয় জোট সম্মিলিতভাবে ১৯৯০ সালে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে। আন্দোলন করতে গিয়ে রাজপথে প্রাণ দিতে হয় নূর হোসেন, ডা. মিলনসহ অজানা অনেককে। উত্তাল হয়ে ওঠে ঢাকার রাজপথ। এ সময় তীব্র হয় গণআন্দোলন, শেষ পর্যন্ত রূপ নেয় গণঅভ্যুত্থানে। সামরিক শিকলে বন্দি গণতন্ত্র মুক্তির আন্দোলনের চূড়ান্ত রূপরেখা তৈরি হয়। পতন হয় স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের।
’৯০ পরবর্তী বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার রক্ষায় দায়িত্বশীল ভূমিকা রেখেছে। বাংলাদেশের সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে অবৈধ ক্ষমতা দখলের পথ রুদ্ধ হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার গণতন্ত্র, সংবিধান, আইনের শাসন ও মানবাধিকার সমুন্নত রাখতে অঙ্গীকারবদ্ধ। বিচারহীনতার সংস্কৃতি বন্ধ করে দেশে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে বর্তমান সরকার। সপরিবারে জাতির পিতার হত্যার বিচারের রায় কার্যকর করেছেন শেখ হাসিনা। জাতীয় চার নেতা হত্যার বিচার সম্পন্ন হয়েছে। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী-মানবতাবিরোধীদের বিচারের রায় কার্যকর হয়েছে। আদালত ২১-এ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায় প্রদান করেছে। কোনো ষড়যন্ত্রই শেখ হাসিনাকে ন্যায়বিচার এবং সাধারণ মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার পথ থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি।
২০২৩ সালে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যুদ্ধের সংকটের মধ্যে যখন বাংলাদেশের বিজয় উৎসব পালন করা হচ্ছে, তখন গণতন্ত্রের মূল্যায়ন হচ্ছে পুনরায়। বিএনপিসহ সমমনা কয়েকটি দলের হরতাল-অবোরোধের নামে তা-বের আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। ফলে, পুনরায় ফিরে এসেছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রসঙ্গটি। বিজয়ের মাসে গণতন্ত্র ও অগ্রগতি নিয়ে নতুন করে ভাবার অবকাশ রয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা বিজয় অর্জন করেছি। নিজেদের জন্য একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র পেয়েছি। যে রাষ্ট্রের ভিত্তি গণতন্ত্র, সামাজিক সাম্য এবং মৌলিক অধিকার চর্চা। যে রাজনৈতিক সংগ্রাম আর ত্যাগের মধ্য দিয়ে এই রাষ্ট্রের জন্ম, সেই ইতিহাসকে যথাযথ উপলব্ধি করাই হলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। এই চেতনার মধ্যে গণতান্ত্রিক দাবি আদায়ের আদর্শ রয়েছে, মুক্তির স্বপ্ন আছে আর আছে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ না করার মূল্যবোধ। অন্যদিকে গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতা ও মানবাধিকার বাংলাদেশের অগ্রগতির অন্যতম অনুপ্রেরণা, যা আবার মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অন্যতম একটি অনুষঙ্গও বটে। একাত্তরে আমরা ঐক্যবদ্ধ ছিলাম বলেই জয়ী হয়েছিলাম। আমরা যদি বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও অগ্রগতি নিশ্চিত করতে চাই, তাহলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সুসংহত করার বিকল্প নেই। আসুন, বিজয়ের এই মাসে বাংলাদেশের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ গণতন্ত্র ও অগ্রগতির জন্য ঐক্যবদ্ধ হই।
লেখক : আইনজীবী, লেখক ও পিএইচ.ডি গবেষক
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যলয়