ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১০ জুলাই ২০২৫, ২৬ আষাঢ় ১৪৩২

কূটনৈতিক শিষ্টাচারে অসংগতি

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী

প্রকাশিত: ২২:১৭, ৪ নভেম্বর ২০২৩

কূটনৈতিক শিষ্টাচারে অসংগতি

আধুনিক বিশ্বে কূটনীতি বলতে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট সাহায্য ও সহযোগিতা

আধুনিক বিশ্বে কূটনীতি বলতে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট সাহায্য ও সহযোগিতার সম্পর্ক  বোঝায়, যা পররাষ্ট্রনীতির সঙ্গে গভীর সম্পর্কিত। নিজস্ব নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক উন্নতিসহ নানামুখী অপরিহার্যতায় প্রতিটি রাষ্ট্র বৈশ্বিক পরিবেশ-পরিস্থিতি বিবেচনায় যে বৈদেশিক নীতি প্রণয়ন করে; কূটনীতির মাধ্যমে তা বাস্তবায়িত হয়। পক্ষান্তরে, কূটনীতি পরিচালনাকারীকে কূটনীতিবিদ বলা হয়। কূটনৈতিক বা কূটনীতিবিদ হচ্ছে, কোনো রাষ্ট্র কর্তৃক কূটনীতিবিদ্যায় প্রশিক্ষিত এবং কূটনৈতিক পদমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি, যার কাজ হলো অন্য দেশ বা আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে নিজ দেশের হয়ে কূটনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করা। আয়োজক দেশের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামরিক-সামাজিক অবস্থার পর্যবেক্ষণ এবং কূটনীতির ফলের প্রতিবেদন নিজ দেশে সঠিকভাবে প্রেরণ করা কূটনৈতিকদের গুরুত্বপূর্ণ কাজ হিসেবে পরিগণিত।  
সর্বজনবিদিত যে, কূটনীতিকদের আচরণগত বিষয় নিয়ে জাতিসংঘের উদ্যোগে বিভিন্ন দেশের অংশগ্রহণে ১৯৬১ সালে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় হওয়া চুক্তিটি ‘ভিয়েনা কনভেনশন অন ডিপ্লোম্যাটিক রিলেশন-১৯৬১’ হিসেবে পরিচিত। মোট ৫৩টি আর্টিকল সংবলিত এই চুক্তির মূল উদ্দেশ্য ছিল, কিছু নিয়ম-নীতি প্রণয়ন এবং সেগুলো অনুসরণের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক উন্নয়ন নিশ্চিত করা। ওই কনভেনশনে উল্লিখিত নিয়ম-নীতি অনুযায়ী জাতিসংঘের সদস্য যে কোনো দেশে অন্য কোনো দেশের কূটনৈতিক মিশন বা প্রতিনিধি অবস্থান করবে।

এই চুক্তির মাধ্যমে স্বাগতিক দেশ অন্য দেশের কূটনীতিকদের বিভিন্ন ধরনের সুবিধা-নিরাপত্তা-বাসস্থান-আইন প্রয়োগসহ নানা বিষয় নিশ্চিত করে থাকে। ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী, গ্রাহক দেশ কূটনীতিকদের নিরাপত্তা-বাসস্থান-আইন প্রয়োগসহ নানা সুবিধা নিশ্চিত করে। কূটনৈতিক মিশন প্রেরণকারী দেশ মিশনের জন্য বরাদ্দকৃত অফিস সীমার বাইরে অন্য কোনো জায়গায় কোনো অফিস স্থাপন করতে পারে না। মিশন প্রধানকে ওই মিশন এলাকা সম্পর্কিত বিষয়ে সব ধরনের জাতীয়-আঞ্চলিক বা মিউনিসিপ্যালের বকেয়া ও করের বাইরে রাখতে হবে। অর্থাৎ তাদের এ সম্পর্কিত কোনো কর দিতে হবে না। কূটনৈতিক মিশনের দাপ্তরিক কাজে ব্যবহার এবং কূটনীতিক ও তার পরিবারের সদস্যদের গৃহকর্মে ব্যবহৃত যে কোনো পণ্য আনা হলে তা সব ধরনের শুল্ক ও করের বাইরে থাকবে। 
উল্লেখ্য, জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত দেশগুলো ১৯৬৪ সালে ওই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিল। পর্যায়ক্রমে স্বাধীন হওয়া দেশগুলো ভিয়েনা কনভেনশনে স্বাক্ষর করে। বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৭৮সালে ভিয়েনা কনভেনশনের আওতাভুক্ত হয়। ওই চুক্তির আর্টিক্ল ৪১ অনুযায়ী, যেসব ব্যক্তি অন্য কোনো দেশে কূটনীতিকের মর্যাদা ও সুবিধা ভোগ করেন, তারা ওই দেশের আইন এবং নীতি মেনে চলতে বাধ্য থাকবেন। এছাড়া তারা ওই দেশের অভ্যন্তরীণ কোনো বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারবেন না। এই আর্টিকলে আরও বলা আছে যে, কূটনীতিকদের সকল কর্মকা- সেই দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অথবা ওই দেশের দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনো কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে পরিচালিত হবে।

এই প্রক্রিয়ার বাইরে কূটনীতিকদের অন্য কোনোভাবে সে দেশের রাজনীতি কিংবা অন্য কোনো বিষয়ে কোনো মন্তব্য করার সুযোগ নেই। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, দীর্ঘকাল ধরে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিশেষ করে দেশের রাজনীতিতে কতিপয় রাষ্ট্রদূতের অতি উৎসাহী-সক্রিয় কর্মকা- পীড়াদায়ক হয়ে উঠেছে। রাষ্ট্র বা সরকারের কি বিষয় কিভাবে সম্পন্ন করা উচিত, সম্পূর্ণ রাষ্ট্রের এখতিয়ার। এর ব্যত্যয় ঘটিয়ে সকল নিয়ম-কানুনের জলাঞ্জলি দিয়ে অন্যদেশের কূটনীতিকের ব্যক্তি- দেশের স্বার্থ হাসিলে বা তাদের অনুগত-আজ্ঞাবহ সরকার ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য নানামুখী অপচেষ্টা অবশ্যই প্রত্যাখ্যাত।

অনর্থক অরাজকতা সৃষ্টি নয়, বরং উদ্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে আধুনিক চিন্তাচেতনার প্রসারে প্রগতি-অগ্রগতির ধারাকে সুদৃঢ় করার লক্ষ্যেই দূতাবাসগুলোর কার্যক্রম সীমিত রাখা বাঞ্ছনীয়।  দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অহেতুক অনধিকার চর্চায় ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে জনগণের মূল্যবোধে আঘাত বা বিভাজনের হীন প্রচেষ্টা যে কোনো সভ্য মানুষের কাছে অপ্রত্যাশিত। 
বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে অস্বাভাবিক-অসংলগ্ন-অনাকাক্সিক্ষত কূটনৈতিক অপতৎপরতা দেশব্যাপী সাধারণ জনগণের মধ্যে অপরিমেয় কৌতূহল-আবেগ-উৎকণ্ঠা তৈরি করেছে। একমাত্র সামরিক জান্তা পরিচালিত দেশসমূহ ছাড়া বিশ্বের প্রত্যেক রাষ্ট্রেই গণতান্ত্রিক ধারা অনুসরণে প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকবৃন্দের ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে সুষ্ঠু ও সুস্থ নির্বাচন অনুষ্ঠান একটি প্রচলিত পরিক্রমা। প্রায় তিন দশক ধরে সামরিক-স্বৈরশাসনের যাঁতাকলে বাংলাদেশ বিপর্যস্ত হলেও সাম্প্রতিক গণতন্ত্রের চর্চা এবং স্থানীয় থেকে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত প্রায় সব নির্বাচন জনগণের অংশগ্রহণে স্বতঃস্ফূর্ত অভিব্যক্তিতে সুচারুরূপে সম্পন্ন হয়েছে।

দলমতের ঊর্ধ্বে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সাদরে বরণ করে প্রতিষ্ঠানসমূহ জনগণের সর্বাত্মক সহযোগিতায় ফলপ্রসূভাবে সচল রয়েছে। পরপর তিনবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জনগণের অবারিত সমর্থনপুষ্ট বর্তমান সরকার সকল বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে বিশ্বপরিম-লে উন্নয়নের রোল মডেল রূপে স্বীকৃতি অর্জন করেছে। অদম্য অগ্রযাত্রায় প্রায় সব ক্ষেত্রেই উন্নয়নের স্বাক্ষর অধিকমাত্রায় দৃশ্যমান। 
ধারাবাহিকতা রক্ষা করে সরকার পরিচালনায় বিচক্ষণতা-দূরদর্শিতা-দক্ষতা-যোগ্যতা-দেশপ্রেমের মাপকাঠিতে জনস্বার্থে গৃহীত সকল উদ্যোগই বিপুলভাবে প্রশংসিত। অনুন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল বিশ্বে পদার্পণ দেশের জন্য অবিস্মরণীয় যুগান্তকারী মাইলফলক। বিভিন্ন রূপকল্প বাস্তবায়নে সফল ও সার্থক বর্তমান সরকার ২০৪১ সালে স্মার্ট বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় ব্রত গ্রহণ করে দ্রুততার সঙ্গে অগ্রসরমান। অথচ দেশের সার্বিক অগ্রগতি ও মহান মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে অদ্যাবধি প্রায় সকল সৎকর্মের বিরুদ্ধাচরণে দেশকে পিছিয়ে দেওয়ার চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র থেমে  নেই।

কথিত বিরোধিতার নামে দেশকে অচল করার কর্মকাণ্ডে তৎপর এসব অন্ধকারের শক্তি অপাঙ্ক্তেয় ক্ষমতাধর অর্থলিপ্সু কৃর্তত্ববাদী কিছু রাষ্ট্রযন্ত্রের সরাসরি হস্তক্ষেপে দেশবাসী চরম হতবাক ও বিস্মিত। এদের অযৌক্তিক পদচারণা ও কূটকৌশলে দেশকে উপকৃত করার বিপরীতে চরম অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির লক্ষ্যে তারা ব্যতিব্যস্ত কিনা; তা নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছে। জাতীয় সংবিধান মতে, জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস। বাঙালি জাতি বরাবরই তা প্রমাণ করেছে। তারা কখনো  কোনো পরাশক্তির কাছে মাথা নত করেনি এবং করবেও না।

মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লাখ শহীদের প্রাণ বিসর্জনে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়। লালসবুজ পতাকার এই বাংলাদেশে স্বাধীনতার অব্যবহিত পর থেকেই স্বাধীনতাকে নস্যাৎ করার হীন উদ্দেশ্যে পরাজিত শক্তি এবং তাদের বিদেশী পৃষ্ঠপোষক বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধবিরোধীরা অবিরাম কূটচক্র কার্যকর করতে বদ্ধপরিকর ছিল। মুক্তির মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর দৃঢ়চেতা-অনমনীয় নেতৃত্বে নষ্ট শক্তির ধারক-বাহকরা দেশের কোনো ক্ষতি করতে না পেরে প্রায় সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার কুৎসিত পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে। শুরু হয় নতুন আরেক অযাচিত শোষণ-শাসন-নিপীড়ন-নির্যাতন-দেশ ধ্বংসের অপকৌশলের অধ্যায়।

চলমান রাজনৈতিক তাৎপর্য বিশ্লেষণে সচেতন মহল ভাবতে শুরু করেছে যে, উল্লেখ্য ঘৃণ্য পদক্ষেপে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পন্থা অবলম্বনে কোনো কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে কিনা, তা সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ জরুরি। সময়ক্ষেপণ না করে নিগূঢ় বিচার-বিশ্লেষণ ও সুদৃঢ়  দেশপ্রেমিক জনতা-গোয়েন্দা সংস্থা সমূহের সমন্বিত সুদক্ষ কর্মকৌশলে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থ হলে দেশ বিপদগ্রস্ত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে জনগণের মনে না করার কোনো কারণ নেই যে, ন্যূনতম শিষ্টাচারবর্জিত স্বল্পসংখ্যক বিদেশী কূটনীতিকের তোড়জোড়, এক ধরনের দলীয় সভার মতো মতবিনিময় অনুষ্ঠান-রাজনৈতিক কর্মসূচির সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ততা কোন্ ধরনের ইংগিত বা বার্তা বহন করছে, তা মোটেও সুধী মহলের বোধগম্য নয়।

দেশভেদে এ ধরনের কূটনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত অতিউৎসাহী আচরণ পরিচালিত হলে বৈশ্বিক পারস্পরিক সমঝোতা-সহযোগিতার পরিবেশ বিঘ্নিত হওয়া অবশ্যম্ভাবী। এতে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, এ ধরনের কর্মকা- সামষ্টিক অর্থবহ সুফল বহনে অকার্যকর হবেই হবে।  
 
লেখক : শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য 
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

×