ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৪ অক্টোবর ২০২৪, ৯ কার্তিক ১৪৩১

গণউন্নয়ন গ্রন্থাগার নিয়ে প্রাসঙ্গিক ভাবনা

শহিদুল ইসলাম

প্রকাশিত: ২০:৫৪, ৩ অক্টোবর ২০২৩

গণউন্নয়ন গ্রন্থাগার নিয়ে প্রাসঙ্গিক ভাবনা

গণউন্নয়ন গ্রন্থাগার

মানুষ জগতে আসার পর বিভিন্ন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে তার আপন মনের ডায়েরিতে। বুদ্ধিমান প্রাণী হিসেবে  আপন অভিজ্ঞতাকে প্রচার করার এবং মৃত্যুর পরও মানবমনে বিরাজ করার একটা সহজাত প্রবৃত্তি সেই প্রাচীনকাল থেকেই রয়ে গেছে মানুষের মাঝে। তাই তো সে তার আপন অনুভূতি অভিজ্ঞতা এবং জ্ঞানগরিমার কথা অপরের কাছে বলতে চায়। কিন্তু হাওয়ায় কথা বেশি দিন স্থায়ী থাকে না। তাই সভ্যতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে উদ্ভাবন ঘটে কথা ধরে রাখার প্রক্রিয়া। হাওয়ায় কথাকে ধরে রাখার জন্য সে মাটির ফলক, প্রস্তর, চামড়া এবং বৃদ্ধ ও বৃক্ষের পাতা ব্যবহার করেছে এবং চিহ্ন বর্ণ অক্ষর, ভাস্কর্য প্রভৃতি ব্যবহার করেছে।

তাই তো আমরা আজও প্রাচীন শিলালিপি এবং সভ্যতার ছাপ বিভিন্ন মাধ্যমে জানতে পারি। কিন্তু কালক্রমে মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকায় নতুন নতুন সভ্যতার উদ্ভব ঘটে। ফলে, পূর্বের লেখা শিলালিপিকে সাজিয়ে রাখার জন্য কক্ষ তৈরি হয়। কালক্রমে ধীরে ধীরে লাইব্রেরির উদ্ভব ঘটে। লাইব্রেরি শব্দটি ল্যাবিং খরনবৎ শব্দ (ধ নড়ড়শ) থেকে উৎপত্তি হয়েছে। পড়াশোনা, জ্ঞানার্জন এবং তত্ত্ব ও তথ্য সরবরাহের নিমিত্তে সংগ্রহকৃত পুস্তকসম্ভারই হলো লাইব্রেরি। খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ১৫০০ (অব্দে) ব্যাবিলন শহরের Nuppur- G ছোট ছোট কক্ষ এবং Clay tablet নিয়ে গড়ে ওঠে প্রাচীন লাইব্রেরি। প্রাচীন এথেন্সে লাইসিয়াম এবং আলেকজান্দ্রিয়ায় বিশাল গবেষণাগার গড়ে ওঠে। বাইজান্টাইনের ইমপেরিয়াল লাইব্রেরি পৃথিবীর গ্রন্থাগার ইতিহাসে একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে।

পরবর্তীতে কর্ডোভা, গ্রানাডা, বাগদাদ, স্পেন, কায়রো প্রভৃতি স্থানে বিশ্ববিখ্যাত গ্রন্থাগার গড়ে উঠেছে। মধ্যযুগীয় পরবর্তী রেনেসাঁর যুগে জ্ঞান-বিজ্ঞান, আবিষ্কার, সাহিত্য, দর্শনে এক বিস্ফোরণের সৃষ্টি হয়। মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকে, মুদ্রণ যন্ত্র, কাগজ, গৃহ এবং অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয়। বর্তমানে আলোকচিত্র কাগজে ছবি, কাঁচের পাতে বাঁধা ছবি, ফনোগ্রাফ রেকর্ড, স্টেপ, কমপ্যাক্ট অডিও ডিকস, ইন্টারনেট প্রভৃতি ব্যবহার হতে দেখা যায়। বর্তমানে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় ব্যাপক উন্নয়ন ঘটায় এবং বিভিন্ন ক্ষেত্র সম্প্রসারিত হওয়ায় লাইব্রেরির আকার ও প্রকার বেড়েই চলেছে।

বর্তমানে লাইব্রেরিকে বিভিন্ন নামে নামকরণ করা হয়। যেমন- (১) ন্যাশনাল লাইব্রেরি (২) ইউনিভার্সিটি লাইব্রেরি (৩) পাবলিক লাইব্রেরি (৪) বিশেষ লাইব্রেরি (৫) স্কুল লাইব্রেরি (৬) প্রাইভেট লাইব্রেরি। তাছাড়া ঝঁঢ়ংপৎরঢ়ঃরড়হ এবং অৎপযরাবং নামে দুই ধরনের লাইব্রেরির কথা অধুনা উচ্চারিত হচ্ছে। পাবলিক লাইব্রেরিতে বিশেষ করে গবেষকদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের আনন্দের চাহিদা মিটে থাকে। মানুষ তার অশান্ত অশ্রুর করুণ উষ্ণতা, ভূধর বিধ্বংসী শক্তি, শত কীর্তি সবই সাহিত্যে লিখে রেখেছে। কোনো জাতিকে চিনতে হলে সাহিত্যের বিকল্প নেই। গ্রন্থ চিন্তা-চেতনা এবং জ্ঞান ও কল্পনা শক্তিকে বৃদ্ধি করে। মানুষের জীবনে দুঃখ যন্ত্রণার শেষ নেই। কিন্তু সে যত বই পড়ে ততই তার কাছে দুঃখকে হালকা মনে হয় বলে দার্শনিক বার্ট্রার্ন্ড রাসেল মনে করেন।

বিখ্যাত মনীষী এরননড়হ এর মতে, Books are those faithful mirrors that reflect to our mind the minds of sages and heroes- চিন্তা ও আবিষ্কারের সঙ্গে জীবন ও যুগের চাহিদার কথামালা হচ্ছে সাহিত্য। সাহিত্যের স্থান বইয়ের মধ্যে আর বইয়ের স্থান লাইব্রেরিতে। যে জাতি গ্রন্থ পাঠের আনন্দ থেকে যত বিমুখ তার স্থান পৃথিবীতে তত নিম্নে। আমাদের দেশে বইয়ের প্রতি যত কদর আছে, তার চেয়ে বেশি কদর আছে অন্যদিকে। কারণ, বর্তমানে সরকারি অর্থ গ্রন্থ এবং লাইব্রেরির দিকে আনুপাতিক হারে কম দেওয়া হচ্ছে। পাড়ায় পাড়ায় গ্রন্থাগার চাই বলে যে স্লোগান উঠেছে তা তো শুধু স্বপ্ন। কারণ, এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য বাজেটে বরাদ্দ চাই। নতুন গ্রন্থাগার নির্মাণ তো দূরের কথা, যে গ্রন্থাগার নির্মিত হয়েছে তাতেই  তো পর্যাপ্ত পরিমাণ গ্রন্থ নেই।

আজ সাগর তীরে পার্ক, প্রমোদতরী করার জন্য শত শত কোটি টাকার পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। খেলার পেছনে শত শত কোটি টাকা বরাদ্দ করা হচ্ছে। ভালো কথা, নাগরিক জীবন যুগের তালে তাল মিলিয়ে জীবনযাত্রার ধরন, চাহিদা পরিবর্তন হচ্ছে। ফলে, আধুনিক জীবন পেতে হলে এগুলো দরকার আছে  ঠিক। কিন্তু গ্রন্থের দিকের খরচও যদি সামঞ্জস্য বিধান করা সম্ভব না হয়, তাহলে অন্তঃসারশূন্য জাতিতে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। তাছাড়া সরকারি খরচে প্রকাশনা যে হারে পাওয়ার কথা, সে হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে না। ফলে, অনেক লেখক, গবেষক প্রকাশনার অভাবে কাজ সৃষ্টি করতে পারছেন না। স্কুল কলেজের চেয়ে লাইব্রেরি উচ্চ বলে মনে হয়। কারণ, আমাদের দেশের ছাত্রদের বিদ্যা জোর করে শিখানো হয়। এখানে স্বেচ্ছায় স্বচ্ছন্দে স্বশিক্ষিত হওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু লাইব্রেরিতে ইচ্ছামাফিক পাঠক বই বাছাই করতে পারেন। সুতরাং যত বেশি লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করা যায়, তত সমাজের জন্য মঙ্গল।
লাইব্রেরিতে গবেষণার কাজ করা সম্ভব বেশি। তথ্যপ্রযুক্তি এবং বিদ্যুতের কারণে রাতে ভালো পরিবেশ পাওয়া সম্ভব হয় আর ধীরস্থিরভাবে নির্জন চিন্তা করার জন্য রাত সবচেয়ে বেশি উপযোগী। বিদেশে এই প্রচলন রয়েছে। উন্নত বিশ্ব রাতে বেশি কার্যক্রিয়া সম্পাদন করে থাকে। কিন্তু আমাদের দেশে রাত ৮টার সময় লাইব্রেরি বন্ধের প্রথা প্রচলিত আছে। যার ফলে পড়া যায় ৭.৪৫ মিনিট পর্যন্ত। অতএব, সন্ধ্যা না হতেই লাইব্রেরি বন্ধ হয়। এটা দুঃখজনক বিষয়।

তাই রাত দশটা পর্যন্ত লাইব্রেরি খোলা রাখার ব্যবস্থা করা আবশ্যক। কোনো জাতিকে ধ্বংস করতে হলে তার লাইব্রেরিগুলোকে আগে ধ্বংস করলেই যথেষ্ট। কিন্তু আমরা বীরের জাতি, আমরা ধ্বংস হতে চাই না। বরং পৃথিবীর বুকে গৌরব নিয়ে বাঁচতে চাই। তাই সরকারকে এ বিষয়ে মনোনিবেশ করা উচিত। মনে রাখা দরকার, সভ্যতার ছাপ হচ্ছে গ্রন্থ আর গ্রন্থের স্থান হচ্ছে লাইব্রেরি। মন ও মনন এবং আর্থিক উন্নতির জন্য নি¤েœর বিষয়গুলোর প্রতি দৃষ্টি দেওয়া জরুরি। যথা (১) লাইব্রেরির জন্য অর্থ বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে। যাতে বেশি লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়।

পাড়ায় পাড়ায় পাঠাগার চাই স্লোগান বাস্তবায়ন করা। (২) প্রতিবছর বইয়ের সংখ্যা আনুপাতিক হারে বৃদ্ধি করতে হবে। (৩) শুক্রবারসহ সপ্তাহে সাত দিন লাইব্রেরি খোলা রাখতে হবে। (৪) প্রতিদিন রাত দশটা পর্যন্ত লাইব্রেরি খোলা রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। (৫) সরকারি খরচে প্রকাশনার সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। (৬) জনগণকে গ্রন্থ পাঠে উদ্বুদ্ধ করতে হবে, যাতে তারা নিজের পরিচয়, মূল্যবোধ এবং দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সত্য জ্ঞান লাভ করতে সক্ষম হয়।
এই কার্যক্রমগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমাদের দেশের জনগণের আত্মিক উন্নয়ন সম্ভব হবে বলে প্রত্যাশা। আত্মিক উন্নয়ন সাধন হলে আর্থিক উন্নয়ন খুব বেশি দেরি হবে না। 

লেখক : শিক্ষক 

[email protected]

×