ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৩, ১৬ অগ্রাহায়ণ ১৪৩০

টরন্টোর চিঠি

নাগার্নো-কারাবাখ ॥ আঞ্চলিক শক্তি প্রদর্শনের বৈশ্বিক নজির

ড. শামীম আহমদে

প্রকাশিত: ২০:৪৯, ৩ অক্টোবর ২০২৩

নাগার্নো-কারাবাখ ॥ আঞ্চলিক শক্তি প্রদর্শনের বৈশ্বিক নজির

ড. শামীম আহমদে

নাগার্নো-কারাবাখ হচ্ছে বৈশ্বিক অশান্ত পরিস্থিতির সর্বশেষ সংযোজন। আজারবাইজানের অভ্যন্তরে অবস্থিত এই এলাকাটি মূলত আর্মেনীয়দের দ্বারা অধ্যুষিত বহু যুগ ধরে। এই এলাকাটি নিয়ে আজারবাইজানি এবং আর্মেনীয়দের মধ্যে সংঘাত হয়ে আসছে শত বছরেরও আগে থেকে। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন এটিকে আজারবাইজানের অংশ হিসেবে ঘোষণা দেয়। যদিও আর্মেনিয়া এবং আজারবাইজান উভয়েই সোভিয়েত ইউনিয়নেরই অংশ ছিল। রাজনৈতিকভাবে আজারবাইজান এই এলাকা নিজেদের অধীনে পেলেও এখানে বসত করে আসছে মূলত আর্মেনীয়রা। সঙ্গে ছিল তুর্কিরাও। ১৯৮৮ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার প্রারম্ভে এই অঞ্চলের মানুষ আজারবাইজানের সঙ্গে থাকতে অস্বীকৃতি জানায় এবং স্বাধীন রাষ্ট্রের দাবি করে।

মূলত আর্মেনিয়া একটি এপোস্টোলিক চার্চে বিশ্বাসী রাষ্ট্র। এপোস্টোলিক চার্চ খ্রিস্টান ধর্মেরই একটি ধারা। তবে মূলত তারা বেশ কট্টর ধর্মীয় ধারায় বিশ্বাসী। এপোস্টোলিক চার্চে বিশ্বাসী খ্রিস্টানদের বলা হয় পেন্টেকোস্টালস। এরা মূলত যিশুখ্রিস্টে বিশ্বাসী এবং তারা যখন তাদের ধর্ম গ্রহণ করে সেটি যিশুখ্রিস্টের নামেই গ্রহণ করে, যেখানে খ্রিস্ট ধর্মের অন্যান্য ধারায় তারা শপথ নেয় ‘দ্য ফাদার, দ্য সান অ্যান্ড দ্য হোলি ঘোস্ট’ এই তিন শক্তির উল্লেখ করে। অন্যদিকে আজারবাইজানের বেশিরভাগ অধিবাসী ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী, যেখানে আরমেনিয়ায় মুসলমানের সংখ্যা ১০০০ জনেরও কম। আর্মেনিয়ায় যে স্বল্প সংখ্যক মুসলমান আছেন, তারা মূলত ইরান এবং তার্কি থেকে আসা।

অন্যদিকে আজারবাইজানে যারা অমুসলিম আছেন, তারা মূলত রাশিয়ান, জর্জিয়ান এবং আর্মেনিয়ান। আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় নাগার্নো-কারাবাখ জাতিগত দ্বন্দ্ব নিয়ে আলোচনা করা হলেও ধর্মীয় পরিচয়ও এখানে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর রাশিয়া মূলত আর্মেনিয়াকে সমর্থন দিয়ে আসছিল এবং তাদের সমর্থন এবং চেষ্টায় ১৯৯৪ সাল থেকে নাগার্নো-কারাবাখে যুদ্ধবিরতি চলে আসছিল। নাগার্নো-কারাবাখ নিয়ন্ত্রণ করছিল আর্মেনিয়া সমর্থিত একটি বিদ্রোহী স্বতন্ত্র গোষ্ঠী। কিন্তু ২০২৩ সালে এসে হঠাৎ করেই মাত্র কয়েকদিনের সামরিক অভিযানে আজারবাইজান নাগার্নো-কারাবাখ থেকে আর্মেনীয়দের তাড়িয়ে দেয় এবং তাদের স্থানীয় সরকারকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়। এর পেছনে একটা বড় কারণ হিসেবে ধরা হচ্ছে রাশিয়ার আর্মেনিয়া থেকে সক্রিয় সমর্থন প্রত্যাহার।

রাশিয়া কেন আর্মেনিয়া থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নাগার্নো-কারাবাখকে স্বতন্ত্র রাখার চেষ্টা করল না, তার পেছনে দুটি কারণ থাকতে পারে। একটি হচ্ছে ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়া যেভাবে আর্মেনিয়াকে পাশে চেয়েছিল, সেভাবে পায়নি। আর্মেনিয়ার প্রেসিডেন্ট নিকোল পাশিনিয়ান এ বছরের জুন মাসে যখন ঘোষণা দেন যে, ইউক্রেন যুদ্ধে আর্মেনিয়া রাশিয়ার সঙ্গে নেই, তখনই বোঝা যাচ্ছিল রাশিয়া-আর্মেনিয়া সম্পর্ক খারাপ হচ্ছে। ৩ সেপ্টেম্বর পাশিনিয়ান যখন প্রকাশ্যে বলেন, নিরাপত্তার জন্য রাশিয়ার ওপর পুরোপুরি নির্ভর করা আর্মেনিয়ার জন্য ভুল সিদ্ধান্ত ছিল, তখনই মূলত তারা নাগার্নো-কারাবাখকে ধরে রাখার ক্ষেত্রে রাশিয়ার সমস্ত সমর্থন হারিয়ে ফেলে। এর আগে পুতিনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা আন্তর্জাতিক ক্রিমিনাল কোর্টে যোগ না দিতে পাশিনিয়ানকে হুঁশিয়ারি দেয় রাশিয়া। 
কিন্তু আর্মেনিয়ার ক্রমবর্ধমান পশ্চিমা ঘেঁষা অবস্থান দেখে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ২০২০ সালে আজারবাইজানের নাগার্নো-কারাবাখে আগ্রাসনকে যৌক্তিক বলেন এবং এপ্রিলে রাশিয়া আর্মেনিয়া থেকে পণ্য আমদানি করা বন্ধ করে দেয়। ২৩ সেপ্টেম্বর আজারবাইজান যখন পূর্ণ শক্তি নিয়ে নাগার্নো-কারাবাখ ফিরিয়ে নিতে উদ্যত হয়, তখন রাশিয়া সাফ জানিয়ে দেয় যে, তারা আর্মেনিয়াকে আজারবাইজানের আক্রমণ থেকে রক্ষা করবে না, মূলত তাদের প্রেসিডেন্টের ভূমিকার জন্য। ১৯ সেপ্টেম্বর রাশিয়ার সরকার অধ্যুষিত মিডিয়া দলিল দস্তাবেজ প্রকাশ করে নাগার্নো-কারাবাখ দ্বন্দ্বের জন্য স্পষ্টতই আর্মেনিয়া এবং পশ্চিমা বিশ্বকে দায়ী করে।

২৩ সেপ্টেম্বর রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লেভরভ জাতিসংঘের ৭৮তম সাধারণ সভায় এই পরস্থিতির জন্য আর্মেনিয়াকে দায়ী করে বলেন, ১৯৯১ সালের চুক্তি অনুযায়ী নাগার্নো-কারাবাখ পরিষ্কারভাবেই আজারবাইজানের অংশ এবং রাশিয়া সেটির স্বীকৃতি দিচ্ছে। ঐতিহাসিকভাবে খ্রিস্ট ধর্মালম্বী অধ্যুষিত রাষ্ট্র হিসেবে আর্মেনিয়াকে সমর্থন দিয়ে আসলেও সাম্প্রতিক মতবিরোধের কারণে রাশিয়া তাদের এই অবস্থান থেকে সরে আসল। রাশিয়ার কাছ থেকে নীরব সম্মতি পেয়েই মূলত আজারবাইজান তাদের হারানো ভূখ-ের পূর্ণ অধিকার ফিরে পেতে সাহসী হয়। দ্বিতীয়ত, ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে ব্যস্ত রাশিয়া নাগার্নো-কারাবাখে নিজেদের সক্রিয় রাখার আর কোনো যৌক্তিকতা খুঁজে পাচ্ছিল না। এছাড়া এটিও মনে রাখা দরকার, গত  কয়েক বছরে আজারবাইজান এবং তুরস্ক উভয় দেশই অর্থনৈতিক এবং সামরিক দিক থেকে ক্রমশ শক্তিশালী হচ্ছিল।

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান খুব পরিষ্কারভাবেই মুসলমান অধ্যুষিত দেশগুলোকে শক্তিশালী করার পক্ষে এবং আজারবাইজানকে নাগার্নো-কারাবাখকে পুরোপুরি নিজেদের অধীনে আনার জন্য সবরকম সাহায্য দিয়ে আসছিলেন। বিশেষত এই জুলাইয়ে যখন নাগার্নো-কারাবাখের নিকটবর্তী পাইপলাইনের কাছে আর্মেনীয় এবং আজারবাইজানিরা সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে, তখন আঙ্কারা পরিষ্কারভাবে তাদের সমর্থন ব্যক্ত করে আজারবাইজানের প্রতি। এই সময়ে আজারবাইজান এবং তুরস্ক সামরিক মহড়া করছিল এবং তুরস্ক তাদের দুটো এফ-১৬ ফাইটার জেট আজারবাইজানের গাঞ্জা ঘাঁটিতে রেখে আসে। এটিও মনে রাখা দরকার, তুরস্ক এবছর আগের তুলনায় ছয়গুণ বেশি যুদ্ধাস্ত্র বিক্রি করেছে আজারবাইজানের কাছে। 
আজারবাইজান তার যুদ্ধাস্ত্র মূলত কেনে ইসরাইল এবং রাশিয়ার কাছ থেকে। সাম্প্রতিক সময়ে তুরস্কের কাছ থেকে কেনা ড্রোন তাদের আর্মেনীয় বিচ্ছিন্নতাবাদিদের তাড়িয়ে দিয়ে ইরানের সঙ্গে সীমানায় পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় মূল ভূমিকা রেখেছে বলেও জানায়। শুধু সামরিক এবং ধর্মীয় কারণেই নয়; অর্থনৈতিকভাবেও আজারবাইজান ও তুরস্ক একে অপরের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আজারবাইজানের কাছ থেকে তুরস্কের তেল আমদানি বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ২৩ শতাংশ। তুরস্ক নাগার্নো-কারাবাখ পুনরায় অধিগ্রহণে আজারবাইজানকে সহযোগিতার মাধ্যমে ওই অঞ্চলে রাশিয়ার চাইতে বেশি গুরুত্ব প্রতিষ্ঠা করে তা সিরিয়া এবং লিবিয়ার বিরুদ্ধে তাদের আধিপত্য খাটানোয় কাজে লাগাতে চায়। এটি অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ন্যাটো সদস্য হয়েই তুরস্ক খুব শক্তভাবেই নিজেদের স্বাতন্ত্র্য ধরে রেখেছে, যেখানে অন্য দেশগুলো হয় আমেরিকা কিংবা রাশিয়ার কাছে মাথা নত করেছে। তুরষ্ক পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে নিজেদের অবস্থান প্রকাশে কুণ্ঠিত নয় এবং তার জন্য তারা নানা ধরনের সামরিক ও কূটনৈতিক প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছে। 
গত এক সপ্তাহে আজারবাইজান সেনাবাহিনীর নাগার্নো-কারাবাখে পূর্ণ শক্তির অধিগ্রহণ, রাশিয়ার আর্মেনিয়ান নাগার্নো-কারাবাখ সরকারকে প্রতিরক্ষা দিতে অস্বীকার এবং প্রায় ১ লাখেরও বেশি আর্মেনিয়ান মানুষের আর্মেনিয়ায় প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে এটি পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছিল যে, আজারবাইনের স্বীকৃত ভূখ-ে আর্মেনীয়দের দখলদারিত্বের অবসান দিতে যাচ্ছে। নাগার্নো-কারাবাখের বিচ্ছিন্নতাবাদী সরকারের প্রেসিডেন্ট বাস্তবতা অনুধাবন করতে পেরে একটি ডিক্রি স্বাক্ষর করে জানিয়েছেন যে, ১ জানুয়ারি ২০২৪ সাল থেকে নাগার্নো-কারাবাখ নামে আর কোনো রাষ্ট্রের অস্তিত্ব থাকবে না। যদিও আর্মেনিয়ার প্রেসিডেন্ট এই ডিক্রিকে স্বীকৃতি না দিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে নাগার্নো-কারাবাখকে আর্মেনিয়ার অংশ কিংবা স্বতন্ত্র ভূখ- হিসেবে টিকিয়ে রাখার জন্য লবি করে যাচ্ছেন।

কিন্তু মনে রাখা দরকার, ১৯৯১ সালের চুক্তি অনুযায়ী সমগ্র বিশ্ব, জাতিসংঘ এবং আর্মেনিয়া নাগার্নো-কারাবাখকে আজারবাইজানের অংশ হিসেবে মেনে নিয়েছিল। তাই এখন আর্মেনিয়ার কোনো আপত্তি আর কার্যত কাজ করবে না। আজারবাইজান যদিও আর্মেনীয়দের নাগার্নো-কারাবাখ ছেড়ে না যেতে অনুরোধ করে বলেছে যে, শুধু আজারবাইজানের পূর্ণ অধিগ্রহণে আসা ছাড়া অন্য কিছুই পাল্টায়নি। তবুও জাতিগত আগ্রাসনের আশংকায় এখানকার বসবাসরত প্রায় সব আর্মেনিয়ানরাই এলাকাটাটি ছেড়ে গেছে। কেবল বয়স্ক, পরিবারের কেউ বেঁচে নেই এবং শারীরিক প্রতিবন্ধকতাজনিত কারণে কিছু মানুষ এখনও ওই অঞ্চলে রয়ে গেছে। 
সার্বিকভাবে বৈশ্বিক যে কোনো দ্বন্দ্ব বোঝার জন্য এখন আমাদের গভীরভাবে ভাবতে হবে। রাজনৈতিক, সামরিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় সব ধরনের কারণেই এখন বিভেদ ও বিভেদ নিরসন হচ্ছে। কোনো একটি কারণকে মাথায় রেখে বৈশ্বিক শক্তির ভারসাম্য কিংবা ভারসাম্যহীনতাকে বুঝতে চাইলে সেটা বোকামি হবে। নাগার্নো-কারাবাখকে নিয়ে আজারবাইজান এবং আর্মেনিয়ার যে প্রায় দুইশ বছরের দ্বন্দ্ব, সেটি তাই প্রমাণ করে। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারত, আমেরিকা, রাশিয়া, চীন ও মিয়ানমারের সম্পর্ক বুঝতে হলেও আমাদের গভীরে যেতে, প্রচুর পড়ালেখা ও গবেষণা করতে হবে। শুধু রাজনৈতিক বিশ্বাস ও পত্রিকার হেডলাইন দিয়ে তর্কে জড়ানো অর্থহীন ও বোকামিও বটে। 

২ অক্টোবর ২০২৩
টরন্টো, কানাডা