.
বিশ্বের প্রায় ৪০টি দেশে আলু মানুষের অন্যতম প্রধান খাদ্য এবং বহু দেশে পশুখাদ্য হিসেবে সমাদৃত। আলু উৎপাদনের দিক থেকে বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্বে সপ্তম স্থানে। আমাদের নিত্যকার খাবারে ও বাণিজ্যে আলু অন্যতম অনুষঙ্গ। আলু শুধু খাদ্য হিসেবেই আবাদ করা হয় না, অর্থকরী ফসল হিসেবেও এর যথেষ্ট কদর। প্রান্তিক চাষির তথ্যমতে, ৬০ শতাংশ জমিতে আগাম জাতের গ্রানোলা আলু চাষ করে খরচ বাদে লাভ হয়েছে ৬০ দিনের এ ফসলে ৫২ হাজার টাকা। কয়েকশ’ বছর ধরে অর্থকরী ফসল হিসেবে রংপুর, ময়মনসিংহ, মুন্সিগঞ্জ, কুমিল্লা, বরিশাল, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর অঞ্চলে পাটের আবাদ হতো বেশি পরিমাণে। ময়মনসিংহের নালিতাবাড়ী, রংপুরের লালমনিরহাটের পাটগ্রাম, গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় পাটগাতি এবং কুষ্টিয়ার সঙ্গে পাটের নাম জড়িয়ে আছে। ব্রিটিশ আমলে দ্বিতীয় মহাসমরে বিশ্বের পাটের বড় জোগানদার ছিল পূর্ববাংলা। দ্রুত গড়ে ওঠে রেল ও নৌপরিবহন ব্যবস্থা। কৃষকদের আয় ও মান বাড়তে থাকে সমানতালে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের পর থেকে ধীরে ধীরে অর্থকরী ফসল পাট ও আখের স্থান দখল করে নিয়েছে আলু। এখন আলুর রমরমা বাণিজ্যে জয়জয়কার অবস্থা। আলুর ওপর নির্ভর করে বেঁচে আছেন অগণিত কৃষক, শ্রমিক, মধ্যস্বত্বভোগী, পরিবহন ও হিমাগার প্রতিষ্ঠান।
লাভজনক অর্থকরী ফসল আলুর চ্যালেঞ্জও কম নয়। হেক্টরপ্রতি বীজের প্রয়োজন প্রায় ১ দশমিক ৫ টন। বিপুল পরিমাণ বীজকন্দ পরিবহন খরচও কম নয়। চাষের প্রায় ৪০ শতাংশ খরচ বীজকন্দ কেনার পেছনে ব্যয় হয়। বীজের চাহিদা বেড়ে গেলে মানসম্পন্ন বীজকন্দ সংগ্রহ করা যেমন সমস্যাসংকুল, তেমনি নীরোগ ও নবীন প্রজন্মের বীজকন্দের স্বরূপ খোলা চোখে বোঝা অসাধ্য। তাই অনেক সময় বহু কৃষকের আশানুরূপ ফলনের স্বপ্ন পর্যবসিত হয় দিবাস্বপ্নে। রবি মৌসুমে ফসলি জমিতে অন্য ফসলের সঙ্গে আলুকে জমি ভাগ করে নিতে হয়। পরিবেশ ও আবহাওয়ার ওপর কৃষকের হাত থাকে না বিধায় মেঘমুক্ত আকাশ এবং ১৫ ডিগ্রি থেকে ২০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেট তাপমাত্রার হেরফের হলে এর ফলনে বিপর্যয় ঘটে। সময়মতো সেচ, সার প্রয়োগে বিঘ্ন ঘটলে এবং মেঘলা ও গুমোট আবহাওয়ায় জীবণুনাশক প্রয়োগ না করতে পারলে ফসল মাঠে মারা যায়। উদ্ভিদ সংরক্ষণ খাতের ছোট বড় করপোরেট বাণিজ্যের উল্লেখযোগ্য ব্যবসা চলে আলুর মৌসুমে। কিন্তু কৃষককে এজন্য সমুদয় ব্যয় মেটাতে হয় গাঁটের কড়ি দিয়ে।
আগামী পৃথিবীতে যে সংকট ঘনিয়ে আসছে, তার অন্যতম হলো লবণমুক্ত সুপেয় পানি। মানুষের ব্যবহৃত লবণহীন সুপেয় পানির প্রায় ৩০ শতাংশ সেচাবাদে ব্যয় হয়। আর এর বড় একটা অংশ জানিয়ে বা না জানিয়ে অপচয়ের খাতে চলে যায়। ব্যাপক আবাদি চারটি ফসলের অন্যতম ফসল আলুতে ব্যয় হওয়া সেচ ও মূল্য সংযোজনে পানির পরিমাণ ধানের পরেই। রোপা আউশ ও রোপা আমনে বৃষ্টির পর কিছু পরিমাণে সম্পূরক সেচের প্রয়োজন পড়ে মাত্র। কিন্তু আলুতে বোরো ফসলের মতো পুরোটা সেচই দিতে হয় শুষ্ক মৌসুমে, যখন চলে পানির আকাল মৌসুম।
তখন খালে বা ভূউপরিস্থ পানির চেয়ে বহু যুগ ধরে সঞ্চিত ভূগর্ভস্থ পানির ওপর বেশি চাপ পড়ে। সে পরিমাণ পানি দিয়ে এর দ্বিগুণের বেশি জমিতে ভুট্টা, গম বা অন্য সব রবি ফসলে সেচ দেওয়া সম্ভব। আর বাজারজাত বা রপ্তানির আগে আলু পরিষ্কারকরণেও দরকার পড়ে বেশি পরিমাণে অমূল্য পানি। ক্রমপচনশীল কৃষিপণ্য হিসেবে আলু তাপমাত্রার প্রতি সংবেদনশীল বিধায় সংরক্ষণের জন্য বিশেষ অবকাঠামো ও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের প্রয়োজন। পরিবহনে অন্য ফসলের আয়তনের তুলনামূলক ব্যয় ও স্থান লাগে বেশি। আবাদকালে ১৫ থেকে ২০ ডিগ্রি এবং পরিবহনকালে ৮ থেকে ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা থাকা চাই। হিমাগারে সংরক্ষণের জন্য আরও নিম্নতাপের প্রয়োজন। বিশেষজ্ঞদের কারও কারও মতে, আলু পরিবহনে কার্গো বিমানের চেয়ে সমুদ্রপথে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা গেলে সাশ্রয়ী মূল্যে তা রপ্তানি করা সম্ভব। এ ধারণা যতটা সহজ, বাস্তবে তা কঠিন। কার গোয়ালে কে দেবে ধোঁয়া! তার ওপর আমাদের আশপাশেই রয়েছে রপ্তানি প্রতিযোগী দেশ ভারত, মিয়ানমার, চীন, পাকিস্তান, কম্বোডিয়া। আলু রপ্তানির ধারাবাহিক প্রবাহ নিশ্চিত করায় প্রয়োজন একটি সুসংগঠিত টানা সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে তোলা। একই প্রজন্ম বারকয়েক এবং একই জমিতে বারবার আলু চাষে এর ফলন ও মান কমে যায়। তেমনি মাটির গুণাগুণ ও উত্তম কৃষি ব্যবস্থার অভাবও বাজারজাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। নির্বিচারে রাসায়নিক সার ও বালাইনাশক ব্যবহার বিদেশে আলু রপ্তানির বড় বাধা।
সম্প্রতি আলুর চড়া দামে এবার আলু মজুতের সরকারি তথ্যকে চ্যালেঞ্জ করে হিমাগার মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন। সংগঠনটি দাবি করেছে, সরকার আলু মজুতের যে তথ্য দিচ্ছে তা সঠিক নয়। কারণ, বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, কোল্ড স্টোরেজের ২০ শতাংশ খালি রয়েছে। আর এ কারণে বাড়ছে আলুর দাম। এ ছাড়া অসাধু ব্যবসায়ীরা আলু মজুত করছে বলেও মনে করে সংগঠনটি। সম্প্রতি রাজধানীর কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন সম্মেলন কক্ষে আলুর সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানানো হয়। সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটির সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু বলেন, মুনাফালোভী একটি চক্র আলু মজুত করে দাম বৃদ্ধি করছে। এখানে কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের কোনো দায় নেই। তবে কারা সিন্ডিকেট করে আলুর দাম বাড়াচ্ছে সরকার চাইলে সেসব তথ্য আমরা দেব। উল্লেখ্য, বর্তমান রেকর্ড মূল্যে খুচরা বাজারে প্রতিকেজি আলু মানভেদে ৫০-৫৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা গত বছরের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ।
কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি বলেন, কোল্ড স্টোরেজ শেড থেকে আলু বের হয় ১৮ টাকা কেজি দরে, যা খুচরা বাজারে ৫০-৫৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। পরিবহন, আড়ত ও খুচরা বিক্রেতাদের খরচসহ সব মিলিয়ে এ আলু ভোক্তাপর্যায়ে সর্বোচ্চ ৩৬ টাকার বেশি হওয়া উচিত নয়। মূল্যবৃদ্ধির কারণ হিসেবে যারা আলু সংরক্ষণ করেছে, তারা মনে করছে আলুর মজুত কম রয়েছে। এজন্য তারা আলুর দাম বাড়াচ্ছে। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী আলু গত বছরের তুলনায় কম সংরক্ষিত রয়েছে। তবে যে আলু সংরক্ষিত আছে তা দিয়ে আগামী ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত পর্যাপ্ত পরিমাণ আলুর সরবরাহ থাকবে বাজারে। কারা আলুর দাম বৃদ্ধি করছে, কারা সিন্ডিকেট করে আলু মজুত করছে, তাদের তথ্য আমরা বিভিন্ন সংস্থাকে দিয়েছি। বিষয়টি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কেও জানানো হয়েছে। এখন আলুর দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারকেই ব্যবস্থা নিতে হবে। হিমাগার মালিকদের যে একতরফা দোষারোপ করা হচ্ছে, এটা ঠিক নয়। সরকার আলু মজুতের যে তথ্য দিচ্ছে তাও সঠিক নয়। অসাধু ব্যবসায়ীরা আলু ধীরে ছাড়ছে। ফলে, বাজারে দাম বাড়ছে। কেন দাম বাড়ছে সেটা সরকারের সংস্থাগুলোকে আমরা বলেছি। এই দাম কী ভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে সেটা সরকারকে ভেবেচিন্তে করতে হবে। মোবাইল কোর্ট বা হয়রানিমূলকভাবে দাম নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয় বলেও মত দিয়েছেন কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের এই নেতা।
এদিকে গত জুলাই মাসে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে আলুর উৎপাদন ও দাম নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করে তা কৃষি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। প্রতিবেদনে অসাধু ব্যবসায়ীদের কৃত্রিমভাবে দাম বৃদ্ধির বিষয়টি তুলে ধরা হয়। তাতে বলা হয়, ১৫ টাকার আলু ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে। সাধারণত কৃষকের হাতের আলু শেষ হওয়ার পর জুন থেকে হিমাগারের আলু বাজারে সরবরাহ আসতে থাকে। কিন্তু এই সরবরাহ ঠিকভাবে হচ্ছে না। এবারে প্রতিকেজি আলুর উৎপাদন খরচ হয়েছে ১০.৫০ টাকা, যেটা সব খরচ মিলে খুচরা বাজারে ৩২ টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়। কিন্তু কৃত্রিমভাবে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী আলুর দাম বৃদ্ধি করছে, যা এখন ৪৫-৫০ টাকায় বাজারে বিক্রি হচ্ছে। এর জন্য অবশ্য হিমাগার মালিকদেরও দায়ী করা হয়েছে। কারণ, হিমাগার মালিকরা চাহিদার তুলনায় অপর্যাপ্ত পরিমাণ আলু বাজারে ছাড়ছে। জানা গেছে, এ বছর আলুর উৎপাদন হয়েছে এক কোটি ১২ লাখ টন। স্থানীয় চাহিদা ৯০ লাখ মে টন। চাহিদার বিপরীতে ২২ লাখ টন আলু বেশি উৎপাদন হওয়া সত্ত্বেও আলুর দাম বাড়ছে।
এ ছাড়া গত বছরের তুলনায় চলতি বছর প্রায় দেড় লাখ টন বেশি আলু উৎপাদন হয়েছে। তবে সরকারি এই তথ্যকে এবার চ্যালেঞ্জ করে বসে হিমাগার মালিকরা। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূলত আলুর দাম বাড়াতেই হিমাগার মালিকরা এখন ভুল তথ্য উপস্থাপন করছে। এখন হিমাগার মালিকরাই কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি আলু কিনে সংরক্ষণ করে এবং সুবিধামতো সময়ে বাজারে ছাড়ে। এবার হিমাগার মালিকদের যোগসাজশে অস্থির হয়ে পড়ছে আলুর বাজার। দ্রুত হিমাগারগুলোতে অভিযান চালিয়ে বাজারে আলু ছাড়ার তাগিদ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। ইতোমধ্যে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর থেকে হিমাগারগুলোতে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। অধিদপ্তর থেকে বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য কিছু সুপারিশও করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, হিমাগার থেকে চাহিদা অনুযায়ী দ্রুত আলু খালাস করতে হবে। আলুর সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে পর্যাপ্ত পরিবহন সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। এর সঙ্গে যেসব অসাধু ব্যবসায়ী কৃত্রিমভাবে আলুর বাজার অস্থির করার চেষ্টা করবে, তাদের বিভিন্ন তদারকি সংস্থা এবং পুলিশ প্রশাসনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে বলেও সুপারিশ করা হয়।
এক কেজি আম আর সমপরিমাণের আলুর স্থান ও পরিবহন খরচ এবং তার বিক্রয়মূল্যের তুলনামূলক বিচারে কোন্টি লাভজনক, তা অর্থনীতির বিষয়। পাল্টা প্রশ্নও আছে। আলুর বিস্তার আর আমের বিস্তার এক রকম নয়। আম মৌসুমি চাহিদাসম্পন্ন। আর আলু সাংবৎসরিক নিত্যব্যবহার্য। আলু নিয়ে ভাবনায় নানা প্রশ্ন উদয় হলেও পরিশেষে বলা যায়, প্রতিবছর আলু আবাদের পরিধি ও পরিমাণ ক্রমবর্ধমান। কিন্তু এর সঙ্গে দেশীয় বাজার, সংশ্লিষ্ট শিল্প এবং রপ্তানি চাহিদা ও মানের ন্যূনতম যোগসূত্র নেই। আন্তঃবিভাগীয় সমন্বয়হীনতা এবং তথ্যবিভ্রাটসহ ঘাটতিও প্রচুর। বিপুল পরিমাণে ভূগর্ভস্থ পানি উঠিয়ে সেচ ও পরিবেশ দূষণকারী রাসায়নিক দ্রব্য কীটনাশক ব্যয় করে শ্রম-ঘামে উৎপন্ন এ বাণিজ্যিক ফসলটির পরিণতিতে যেন পাট ও আখ উৎপাদনকারী কৃষকদের মতো কখনো অচিরেই সমূহ লোকসানে পড়তে না হয়। তাই আলু বেশি উৎপাদন করব কি করব না– কৃষকদের এ প্রশ্নের উত্তর প্রদানে সময় থাকতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সচেতন দৃষ্টি প্রদান জরুরি।
লেখক : অধ্যাপক, ডিন ও সিন্ডিকেট সদস্য,
সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা