
অধ্যাপক ড. এস তাহের আহমদ হত্যা
বহুল আলোচিত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. এস তাহের আহমদ হত্যা মামলার দুই আসামি মিয়া মোহাম্মদ মহিউদ্দিন ও মো. জাহাঙ্গীর আলমের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার (২৭ জুলাই) রাত ১০টা ১ মিনিটে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে দুই আসামির ফাঁসি কার্যকর করা হয়। দুই আসামির মধ্যে জাহাঙ্গীর ছিলেন অধ্যাপক তাহেরের বাড়ির কেয়ারটেকার। আর মহিউদ্দিন ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের একই বিভাগে তাহেরের সহকর্মী। গবেষণাকর্মে জালিয়াতির কারণে মহিউদ্দিনের পদোন্নতিতে নিয়ম অনুযায়ী বাধা দিয়েছিলেন অধ্যাপক তাহের। সেই ক্ষোভে মহিউদ্দিনের পরিকল্পনায় ২০০৬ সালে অধ্যাপক তাহেরকে হত্যা করে লাশ ফেলে দেওয়া হয় ম্যানহোলে।
একটা সময় ছিল যখন প্রতিক্রিয়াশীলদের আঘাতে প্রগতিশীল ব্যক্তিবর্গ, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকবৃন্দের নিহত হওয়ার ঘটনা প্রায় স্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল। এখনো তা নানাভাবে চলমান রয়েছে। এরূপ হত্যাকা-ের সূচনা ঘটে ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০০৪ সালে প্রথাবিরোধী লেখক অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদকে হত্যাচেষ্টার মধ্য দিয়ে। একুশের বইমেলা থেকে ফেরার পথে তাঁকে আঘাতের পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন ওই বছরের আগস্ট মাসে। একই বছরের ২৪ ডিসেম্বর ভোরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস-সংলগ্ন এলাকায় প্রাতঃভ্রমণের সময় কুপিয়ে হত্যা করা হয় অর্থনীতি বিভাগের প্রগতিশীল অধ্যাপক ইউনুসকে। এরপর অধ্যাপক ড. এস তাহের হত্যাকাণ্ড ঘটে ২০০৬ সালে।
প্রথম দুটি হত্যাকা-ের সঙ্গে প্রতিক্রিয়াশীলরা সরাসরি জড়িত; বিচার প্রক্রিয়া চলমান– রায় আসন্ন; রায় হয়েছে শাস্তি হয়নি; কিংবা শাস্তি লঘু করা হয়েছে। অধ্যাপকদের হত্যার বিচারের গতি অতি শ্লথ। কারণ, সমাজে অধ্যাপকদের সক্ষমতা খুবই সীমিত। যাই হোক, প্রথম দুটি হত্যাকা-ের তুলনায় অধ্যাপক তাহের হত্যাকা-ের সঙ্গে তথাকথিত আদর্শ অপেক্ষা ব্যক্তিস্বার্থ প্রধান। হত্যার প্রধান আসামি তাঁরই ছাত্র এবং একই বিভাগের (ভূ-তত্ত্ব ও খনিবিদ্যা) শিক্ষক মিয়া মোহাম্মদ মহিউদ্দিনও অবশ্য একটি প্রতিক্রিয়াশীল দলের সমর্থক ও নেতা। তবে এখানে তার দল অপেক্ষা ব্যক্তিস্বার্থ মুখ্য। কারণ, অধ্যাপক তাহেরকে তার অন্যায্য পদোন্নতির পথে বাধা মনে করে হত্যা করা হয়।
উল্লেখ্য, অধ্যাপক ইউনুস হত্যাকা-ের বিচারের রায়ে ২০১০ সালে নি¤œ আদালত মো. শহিদুল্লাহ ওরফে মাহবুব ও মো. শফিউল্লাহ ওরফে তারেক নামের জেএমবির দুই নেতাকে মৃত্যুদ- দেয়। অন্য ছয় আসামিকে খালাস দেয় আদালত। এরপর ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ তারিখে রাজশাহীর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল পুনর্বিচারের রায়ে জেএমবির দুই সদস্যের মৃত্যুদ- রহিত করে যাবজ্জীবন কারাদ-ের আদেশ দেয়। অন্যদিকে, গত বছরের ১৩ এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক, লেখক ও ভাষাবিজ্ঞানী ড. হুমায়ুন আজাদ হত্যা মামলায় চারজনকে মৃত্যুদ- দেওয়া হয়েছে।
অধ্যাপক তাহের হত্যার ১৬/১৭ বছর পর তা আবারও দেশজুড়ে আলোচিত ও আলোড়িত হবে- এটি ভাবনার অতীত। অবসর কিংবা মৃত্যুর পর অধ্যাপকদের স্মরণ করা হয় না খুব একটা। খুনের পর তো নয়ই। তবে অধ্যাপক তাহের হত্যার বিচার নিশ্চিত করার পেছনে তাঁর পরিবারের, বিশেষ করে তাঁর স্ত্রী, পুত্র ও নির্দিষ্ট করে তাঁর কন্যা শেগুফতা তাবাসসুমের অবিরত লেগে থাকা সংগ্রাম ও দৃঢ় তৎপরতা অনস্বীকার্য। প্রায় ভুলে যাওয়া এই হত্যাকা-কে বিচারের মুখোমুখি করে সবার সামনে উপস্থিত করার জন্য অধ্যাপক তাহেরের পরিবারের দীর্ঘদিনের অপেক্ষা দেশের মানুষের আবেগকে নাড়া দিয়েছে।
তাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও নিরলস আইনি লড়াইয়ের চূড়ান্ত পর্যায়ে ২০২২ সালের ৫ এপ্রিল অধ্যাপক তাহের হত্যায় ২ জনের মৃত্যুদ-, ২ জনের যাবজ্জীবন বহাল থাকে। পরবর্তীতে এ রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে মহিউদ্দিন ও জাহাঙ্গীর আবেদন করলে গত ২ মার্চ সে আবেদনও খারিজ হয়ে যায়। আইনজীবী সেগুফতা তাবাসসুমের ভূমিকায় আজ অনেক বাবাই গর্বিত। ১৭ বছর পর আসামিদের ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় অধ্যাপক তাহেরের মেয়ে আইনজীবী সেগুফতা তাবাসসুম আহমেদ বলেন, ‘সত্যের জয় হলো।’ তিনি সবাইকে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন।
অধ্যাপক তাহেরকে হত্যার পর তাঁর পুত্র পরিবারের দায়িত্ব নেয়। উচ্চমাধ্যমিকে অধ্যায়নরত কন্যা পরবর্তীতে পিতা হত্যার প্রতিশোধ তীব্র বাসনা থেকে নিজেকে আইনজীবী হিসেবে গড়ে তোলেন এবং পিতার হত্যার রহস্য উন্মোচন করে প্রকৃত দোষীদের বিচারের মুখোমুখি করেন। ১৬ বছরের সংগ্রামের ফসল হিসেবে তারা অধ্যাপক তাহেরের হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে আদালতের রায় আদায় করতে সক্ষম হয়েছেন। রায় শোনার পর তারা ১৬ বছর ধরে বিশেষ করে ২০০৬ সালে হত্যাকা-ের সময় এবং হত্যাকা-ের রায় প্রদানকালে সাংবাদিক ও প্রগতিশীল মানুষের ইতিবাচক ভূমিকার কথা স্বীকার করেছেন।
আসামিদের ফাঁসি কার্যকর তথা এই জঘন্য হত্যাকা-ের অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত হওয়ায় তাঁকে হারানোর বেদনা কিছুটা হয়তো প্রশমিত হলো। যদিও কোনো কিছুর বিনিময়ে তাঁকে আর ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়। অধ্যাপক তাহেরের মতো অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ ও অধ্যাপক ইউনুসের হত্যাকারীদের শাস্তি নিশ্চিত হওয়াও আইনের শাসন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবার ও স্বজনদের প্রতি সমবেদনার জন্য সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক তাহেরের পরিবার এবং বিশেষ করে তাঁর মেয়ে আইনজীবী শেগুফতা তাবাসসুমের সংকল্প ও প্রচেষ্টার জন্য তাঁকে সম্মান এবং অভিনন্দন জানাতে হয়। তাঁকে দৃষ্টান্ত হিসেবে গ্রহণ করতে হয় দুটি কারণে। প্রথমত, পিতার হত্যার বিচারের প্রশ্নে তাঁর সারাজীবনের সংগ্রাম; সেজন্য তাঁকে সেলাম ও সাধুবাদ। অন্যদিকে, একটি ঘৃণ্য অপরাধের বিচার নিশ্চিত করার জন্য তাঁকে অভিবাদন জানাই। এর মধ্য দিয়ে আমরা উপলব্ধি করতে চাই যে, অন্যায়ের বিচার হবেই হবে। দুষ্কৃতকারীরা কিছু সময়ের জন্য নিজেদের বিচার থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে সক্ষম হলেও ইতিহাসে এবং বাস্তবতার কাছে একদিন তাদের বিচার হবেই। তাদের বিচারের জন্য হয়তো সকল পরিবারে অধ্যাপক তাহেরের মতো যোগ্য ও সংগ্রামী সন্তান নাও থাকতে পারে, কিন্তু অপরাধের বিচার কোনো না কোনোভাবে হবেই।
হত্যাকাণ্ডের বিচার হোক বা না হোক নিহত ব্যক্তিকে আর ফিরে পাওয়া যায় না। এই বাস্তবতা থেকে অধ্যাপক তাহের, অধ্যাপক ইউনুস, অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ এবং তাঁদের মতো দেশের অন্য শিক্ষকদের সম্মানজনক অবস্থান, সামাজিক মর্যাদা, নিরাপত্তা ইত্যাদি নিয়েও চিন্তা-ভাবনা প্রয়োজন। দেশের শিক্ষকদের বিষয়ে সাধারণ মানুষের যে ভক্তি, শ্রদ্ধা ও সম্মান ছিল আজ তা কোন পর্যায়ে পর্যবসিত হয়েছে সেটি ভাববার বিষয়। শিক্ষকরা আজ নানাভাবে অসম্মানিত। শিক্ষকদের যখন অসম্মান করা হয় তখন অনেকের কাছে বিষয়টি খুব স্বাভাবিক এবং সাধারণ মনে হতে পারে। কিন্তু যে দেশে শিক্ষক লাঞ্ছিত হয়, যে দেশের শিক্ষকদের আত্মমর্যাদা থাকে না এবং যে দেশের শিক্ষকদের কটাক্ষ করা হয় সে দেশে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হতে পারে, কিন্তু প্রকৃত শিক্ষা ও কল্যাণ নিশ্চিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না।
অধ্যাপক তাহেরসহ সকল হত্যাকা-ের বিচারের মধ্য দিয়ে এই উপলব্ধি করতে চাই ব্যক্তিস্বার্থ কতটা প্রকট হতে পারে যে, পদোন্নতি বাধাগ্রস্ত হতে পারে ভেবে তাঁকে অপর শিক্ষক (যিনি এক সময় তাঁর ছাত্রও ছিলেন) তাঁকে খুন করতেও কুণ্ঠাবোধ করে না। এই যদি হয় সমাজের অবস্থা, শিক্ষকদের ক্ষমতাবানরা কান ধরে উঠবস করাতে পারেন, স্থানীয় কাউন্সিলর কর্তৃক শিক্ষক লাঞ্ছিত হতে পারেন, টেলিফোনে রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা গালমন্দ করতে পারেনÑ সবই সম্ভব। যে দেশে এসব সম্ভব, দেশের প্রকৃত বিকাশ ও মানবিক উন্নয়ন সেখানে প্রায় অসম্ভব। যে দেশে শিক্ষকদের সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের মনোভাব, বিকাশ, সামাজিকীকরণ ও সমাজ বাস্তবতা বিরূপ সেই সমাজ বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে একটি কল্যাণকর রাষ্ট্রের কল্পনা বাস্তবসম্মত নয়।
যতদিন না সমাজে শিক্ষার গুরুত্ব যথাযথভাবে উপলব্ধি করা সম্ভব হবে এবং শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় অনুকূল অনুষঙ্গ তথা শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ, শিক্ষার্থীদের সুযোগ-সুবিধা, শিক্ষকদের যথাযথ সম্মান, নিরাপত্তা ও সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত হবে, ততদিন পর্যন্ত দৃশ্যমান উন্নয়ন কল্যাণমুখী রাষ্ট্র গঠনে সহায়ক হবে না। উন্নয়ন দেখা যাবে, অনুভব করা যাবে না। এই পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন অপরিহার্য।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর জীবদ্দশায় শিক্ষকদের যেভাবে সম্মান দেখিয়েছিলেন, শিক্ষার গুরুত্ব উপলব্ধি করেছেন, সেটি বর্তমান সমাজে অনেকটা অনুপস্থিত। ব্যক্তিস্বার্থ, ক্ষমতা, মুনাফা ও অবকাঠামোগত উন্নয়নই এখন মুখ্য। বিদ্যমান অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়া কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমতাবস্থায় বঙ্গবন্ধুর ভাবাদর্শে শোষণহীন সোনার বাংলা গঠনের লক্ষ্যে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য বর্তমান সরকার আরও মনোযোগী হবে- সেটিই আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক : অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়