ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নোবেলের দেশ থেকে

শতবর্ষ পরেও প্রাসঙ্গিক ইবসেন

দেলওয়ার হোসেন

প্রকাশিত: ২১:০৩, ১ জুন ২০২৩

শতবর্ষ পরেও প্রাসঙ্গিক ইবসেন

আবদুল হক এবং জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী

(গত শুক্রবারের পর)

বাংলাদেশে ইবসেন চর্চা

বাংলাদেশে পাকিস্তান আমলে ইবসেনের প্রধান নাটকগুলো অনুবাদ করেছিলেন দেশের প্রখ্যাত দুজন সাহিত্য-ব্যক্তিত্ব  প্রাবন্ধিক আবদুল হক এবং জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী। তবে পশ্চিম বাংলায় ইবসেনের নাটকের কাজ হয়েছে আরও আগে অনেক বেশি। এই মহান নাট্যকারের নাটক পশ্চিমবঙ্গে মঞ্চে আসে বিংশ শতকের পাঁচের দশকের শেষ ও ছয় দশকের শুরুতে। বিশেষত তাঁর ‘এ ডলস হাউস’-এর রূপান্তর ‘পুতুলের সংসার’-এ তৃপ্তি মিত্রের অভিনয় বাংলা মঞ্চ-নাটকে এক নতুন মাত্রা যোগ করে। ‘দি এনিমি অব দি পিপল’ও মঞ্চস্থ’ করে কোনো কোনো নাট্যদল। বাংলাদেশেও  ‘এ ডলস হাউস’- এর রূপান্তর ছাড়াও আরও কয়েকটি নাটকের মঞ্চায়ন হয়।

ইবসেনের জীবন সংগ্রাম
হেনরিক ইয়ুহান ইবসেন জন্মেছিলেন ১৮২৮ সালের ২০ মার্চ নরওয়ের স্কিয়েন শহরে একটি অভিজাত ব্যবসায়ী পরিবারে। বাবার মূল ব্যবসা ছিল জাহাজযোগে  কাঠ ব্যবসা। তার জ্ঞাতি গোষ্ঠী ছিলেন শহরের ধনাঢ্য এলিট শ্রেণির। সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশতেন না তারা। রাজ পরিবারে জন্ম না নিলেও রাজসিক জীবন যাপন ছিল তাদের।  কিন্তু ইবসেনের বয়স যখন মাত্র আট বছর, তখন ১৮৩৫ সালে বাবা কুন্ড প্লিসনার ইবসেনের (১৭৯৭-১৮৭৭ ) ব্যবসায় দেউলিয়াত্ব বরণ করেন এবং পারিবারিক জীবনে চরম আর্থিক সংকট ও দুর্দশা নেমে আসে। পরে ধনাঢ্য সৎ ভাইয়ের কৃপায় বেঁচে থাকেন। মা ক্যামেলিয়া মারটিনা অল্টেনবার্গ (১৭৯৯- ১৮৬৯) চোখে দেখেন অমানিশার অন্ধকার।

তাদের পরিবারের ওপর এটি ছিল একটি বড় ধরনের আঘাত। চরম আর্থিক কষ্টের ভেতর দিয়ে অতিবাহিত হতে থাকে ইবসেনের শৈশবের দিনগুলো। যখন ইবসেনের বয়স   পনেরো বছর, তখন তিনি বাড়ি ছাড়েন জীবিকার তাগিদে। চলে আসেন গ্রিমস্টাড শহরে। এখানে একজন ফার্মাসিস্ট হিসেবে চাকরি নিয়ে ৬ বছর কঠিন সময় পার করেন ইবসেন। ইচ্ছা ছিল পড়াশোনা করবেন বিশ্ববিদ্যালয়ে, কিন্তু মাধ্যমিক পরীক্ষায়ও পাস করতে পারেননি তিনি।
পেশাগত জীবন অতিবাহিত করার সময়ই তিনি রচনা করেন জীবনের প্রথম নাটক ১৮৫০ সালে। পরের বছর ১৮৫১ সালে বারগেন বা বারিয়েন শহরে একটি নতুন থিয়েটারের আবাসিক নাট্যকার নিযুক্ত হন। পরে হন এর পরিচালক। তবে সফল পরিচালক হিসেবে তিনি সাফল্যের স্বাক্ষর রাখতে পারেননি। তাঁর রচিত নাটকগুলো একের পর এক ব্যর্থ হয়। কিন্তু বারগেন শহরের এই ব্যর্থতা থেকে নতুন অভিজ্ঞতা লাভ করে আরও সমৃদ্ধ হয়ে ওঠেন।
 ১৮৫৭ সালে ইবসেন ফিরে আসেন ক্রিস্টিয়ানিয়া শহরে। বর্তমানে যা রাজধানী শহর অসলো নামে পরিচিত। নিজ দেশে এখানেই তিনি তাঁর জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটান। ওই একই বছর তিনি রচনা করেন তাঁর জীবনের উল্লেখযোগ্য নাটক ‘দি প্রিটেন্ডারস্’। কিন্তু দুর্ভাগ্য তাঁর, থিয়েটারের জগতে শেষ পর্যন্ত টিকে থাকা চূড়ান্তভাবে কঠিন হয়ে পড়ে। তিনি যে থিয়েটার দলে কাজ করতেন, তা দেউলিয়া হয়ে যায়। 
ওদিকে জার্মানির সঙ্গে ডেনমার্কের সংগ্রামে নরওয়ের নির্বিকার ভূমিকা তাঁকে ক্ষিপ্ত করে তোলে। ফলে তিনি স্বেচ্ছা নির্বাসনে চলে যান রোমে। সেখান থেকে ড্রেসডেন এবং জার্মানির মিউনিখে (১৮৬৪-১৮৯২)। তাঁর আন্তর্জাতিক খ্যাতির সূচনা হয় নাটক ‘ব্র্যান্ড’ এবং ‘পিয়ার জিন্ট্’ (১৮৬৬-৬৭) থেকে। তিনি তাঁর রচিত ঐতিহাসিক নাটক ‘এমপ্যারর অ্যান্ড গ্যালিলিয়ান’ (১৮৭৩) কে মনে করতেন ‘মাস্টারপিস’ হিসেবে। তবে তিনি সুনাম অর্জন করেন বিশেষত তাঁর সামাজিক নাটকগুলোর জন্য। এসবের মধ্যে রয়েছে প্রথমত ‘এ ডলস্ হাউস’ (১৮৭৯) এবং ‘ঘোস্টস’ (১৮৮১)। এই দুটি নাটকই প্রচুর বিতর্কের জন্ম দেয়।
এরপর নাট্যকার ইবসেন জীবনের শেষ পর্যায়ে মনোনিবেশ করেন সিম্বোলিজমের দিকে। তাঁর এসব নাটকের মধ্যে রয়েছে ‘দি ওয়াইল্ড ডাক’ (১৮৮৪), ‘রোসমার হোলম’ (১৮৮৬) এবং ‘দি মাস্টারবিল্ডার’ (১৮৯২)। তবে ‘হেড্ডা গ্যাবলার’ এর (১৮৯০) বাস্তবতা ছিল সিম্বোলিজম থেকে তাঁর নীরবে সরে আসা। ১৯০০ সালে তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হন। নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে তাঁর সৃষ্টিশীল নাট্যকর্ম। এরপরও তিনি বেঁচে ছিলেন ছয় বছর। গুনেছেন মৃত্যুর প্রহর। মারা যান ১৯০৬ সালের ২৩ মে। স্ত্রী মারা যান ১৮৬৯ সালে। রেখে যান একমাত্র পুত্রসন্তান সিগুরড ইবসেন (২৩ ডিসেম্বর, ১৮৫৯Ñ ১৪ এপ্রিল, ১৯৩০)। তিনি ছিলেন অবিভক্ত সুইডেনের প্রধানমন্ত্রী ১৯০৩ সাল থেকে ১৯০৫ সাল পর্যন্ত। শেষের এই বছরেই নরওয়ে সুইডেনের কাছ থেকে আলাদা হয়ে যায়।

ইবসেনের সাহিত্যিক-জীবন
এই মহান নাট্যকার তাঁর জীবনের শেষ নাটক ‘হোয়েন উই ডেড অ্যাওয়েকেন’ রচনা করেন ১৮৯৯ সালে। নাটকটিকে তিনি ‘ড্রামাটিক এপিলোগ বলে অভিহিত করেছিলেন। এর ব্যাখ্যায় তিনি এটিকে বলেছেনÑ তাঁর কর্মময় জীবনের উপসংহার। অর্ধশতাব্দী ধরে নিজের জীবন ও শক্তিকে উৎসর্গ করেছিলেন তিনি জীবনধর্মী ব্যতিক্রম নাটক রচনায়। খ্যাতি ও স্বীকৃতি অর্জন করেছেন তাঁর সময়ের অপ্রতিদ্বন্দ্বী শ্রেষ্ঠ নাট্যকার হিসেবে।
তিনি শুধু ঊনবিংশ শতাব্দীর নাটকের একজন অতুলনীয় প্রধান পুরুষই ছিলেন না, ছিলেন একজন বড় মাপের কবিও। ১৮৭১ সালে ইবসেন প্রকাশ করেন তাঁর কবিতা সংগ্রহের বই।

কিন্তু  নাটকই ছিল তার প্রধান নেশা এবং চারণভূমি। অপ্রচলিত ধারার নাটক লিখে তিক্ত সমালোচনার তীরে বিদ্ধ ক্ষত-বিক্ষত ইবসেন ব্যাপকভাবে বিতর্কিত হলেও শেষতক বিজয়ী এবং নন্দিত হয়েছেন সমকালীন সমালোচক এবং দর্শকদের কাছে তাঁর আলোড়নকারী অসাধারণ সৃষ্টির জন্য, যেমনটি ঘটেছিল সক্রেটিসের ক্ষেত্রে। ইবসেন তাঁর নাটকে তুলে ধরেছেন নিজের সময়কালের মধ্যবিত্ত শ্রেণির নারী-পুরুষ, তাদের আশা আকাক্সক্ষা, ভীরুতা, কাপুরুষতা, তাদের সাহস এবং দ্রোহ, পলায়নবাদী মানসিকতা এবং অন্তিমে মুখোমুখি হওয়ার কঠোর বাস্তবতাকে।

‘পিলারস্ অব সোসাইটি’ (১৮৭৭) থেকে শুরু করে তাঁর শেষ নাটক ‘হোয়েন উই ডেড অ্যাওয়েকেন’ পর্যন্ত ইবসেনের ১২টি আধুনিক সমকালীন নাটক  নিয়ে যায় ওই অভিন্ন সামাজিক পরিপার্শ্বের চিরচেনা গ-িতে। হুমকির শিকার ও হুমকিদাতার চরিত্রগুলো বিচরণ করে সমানভাবে।  তারা প্রতিমুহূর্তে স্মরণ করিয়ে দেয় বিশ্ব সভ্যতা গতিশীল, স্থবির নয়। পুরনো মূল্যবোধ ও প্রাচীন ধ্যান-ধারণাগুলো আজ অচল ও মৃত। গতিশীলতাই ব্যক্তি জীবন থেকে সমাজ জীবনকে দেখায় নতুন পথের দিশা। পরিবর্তনের তাগিদ। অচলায়তন ভাঙ্গার অদম্য সাহস।

বদলে যাচ্ছে জীবন ও সমাজ আলোকিত পথে। তাঁর মতো এমন শক্তিশালী একজন ‘কনসেপচুয়াল লেখক এ বিষয়টিকে দেখেন ‘জীবনের ইতিবাচক দর্শন’ হিসেবে। ইবসেন তার নাটক ‘হেড্ডা গ্যাবলার’ সম্পর্কে বলেছেন-, ‘আমার প্রধান লক্ষ্যই হলোÑ  গভীর পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে গুরুত্বপর্ণ সামাজিক চিত্র প্রত্যক্ষ এবং অর্জিত ধারণার ভিত্তিতে মানুষ, মানুষের অনুভূতি ও মানবজাতির নিয়তির ছবি আঁকা।’ 
ইবসেনের নাটক সম্পর্কে বিখ্যাত সুইডিশ গবেষক মার্টিন ল্যাম-এর অবিস্মরণীয় মন্তব্য ছিল, ‘ইবসেনের নাটক আধুনিক নাটকের রোম। সমস্ত সড়ক তার অভিমুখী এবং শুরুও সেখান থেকেই।’ জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে তাঁর এক জার্মান বন্ধুকে ইবসেন বলেছিলেন, ‘কেউ যদি আমাকে বুঝতে চায়, তাকে জানতে হবে নরওয়েকে। উত্তরের মানুষজন চমৎকার অথচ মারাত্মক প্রাকৃতিক পরিবেশের বেষ্টনীতে আবদ্ধ। একাকিত্ব, নিঃসঙ্গ জীবন। দূরে দূরে বিচ্ছিন্ন খামারি জনপদ। এই বাস্তবতা মানুষকে বাধ্য করে অন্যদের ব্যাপারে নিঃস্পৃহ এবং দিজেদের নিয়ে ব্যস্ত থাকা। তারা অন্তর্মুখী এবং আত্মমগ্ন। তারা চিন্তাশীল ও সন্দেহপ্রবণ। তবে আত্মবিশ্বাসী। ঘরের ভেতরে প্রায় প্রত্যেক লোকই এক একজন দার্শনিক! সেখানে শীতকালে ঘন কুয়াশা এবং শুভ্র তুষারপাতে প্রলম্বিত অন্ধকারে ছেয়ে থাকে জীবন ও প্রকৃতি। তার শুভ্র চাদরে ঢাকা পড়ে সুনসান নীরব বাড়িঘর।  সূর্য দেবের জন্য থাকে অধীর প্রতীক্ষা।                    (সমাপ্ত)

স্টকহোম, ২৩ মে, ২০২৩ 

লেখক : সুইডেন প্রবাসী সাংবাদিক 

[email protected]

×