
প্রতীকী ছবি।
আজ একুশে ফেব্রুয়ারি। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন তথা ভাষা শহীদদের স্বরণে দিনটি পালিত হয়। ভাষা আন্দোলন বাঙালির গণচেতনা ও স্বাধিকার আন্দোলনের এক বলিষ্ঠ ভূমিকা। ভাষার জন্য আন্দোলন এবং জীবনের বিনিময়ে তা প্রতিষ্ঠিত করা পৃথিবীর ইতিহাসে এক বিরল দৃষ্টান্ত।
বিশ্বের আর কোনো দেশের মানুষের ভাষার জন্য সংগ্রাম ও রক্তদানের ইতিহাস নেই। আর বাঙালিকে সেই ভাষা আন্দোলনই প্রেরণা যুগিয়েছিলো পরবর্তী সকল আন্দোলনের। ভাষা আন্দোলনই বাংলার জনগণের মধ্যে নতুন জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটায় এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত করে।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ক্ষেত্রে ভাষা আন্দোলন এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
মূলত বাঙালির স্বাধীনতা এবং জাতীয়তাবাদের মূলভিত্তি হচ্ছে সেই ভাষা আন্দোলন। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পেছনে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমেই তৎকালীন পূর্ব বাংলার গণতান্ত্রিক আন্দোলন জোরালো ভূমিকা পালন করে। ভাষা আন্দোলনের চেতনাই জনগণের মধ্যে পরবর্তীকালে ৭১ এর মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের এক নতুন চেতনার জন্ম দেয় এবং এর মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে বাঙালির জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটে। তাই ভাষা আন্দোলন বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির গণচেতনার সর্বপ্রথম বহিঃপ্রকাশ এবং স্বাধিকার আন্দোলনের এক বলিষ্ঠ পদক্ষেপ।
ব্রিটিশ বিরোধী ধারাবাহিক বিভিন্ন আন্দোলন যেমন ব্রিটিশদের উৎখাত করতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলো তেমন ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে অন্যান্য সকল আন্দোলন বাঙালিকে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়তে চেতনা যুগিয়েছিলো।
১৯৪৭ সালে ভারত পাকিস্তান বিভক্ত হয়। ভারত পাকিস্তান বিভক্ত হওয়ার পরেই ভাষা আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে পাকিস্তান এবং হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে ভারত গঠিত হলেও শুধু ধর্মীয় কারণে বাংলাদেশ পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। কিন্তু পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের আদর্শগত কোনো যোগসূত্র ছিল না বললেই চলে।
পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মাতৃভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বেও সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক পন্থায় পূর্ব বাংলায় উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা চালানো হয়। এছাড়া পূর্ব বাংলার মানুষের প্রতি নানাভাবে বৈষম্যমূলক নীতি আরোপ করা হয় পাকিস্তানের পক্ষ থেকে।যার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৪৭ সালের ২ সেপ্টেন্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় শিক্ষক ও ছাত্রের উদ্যোগে ‘তমুদ্দুন মজলিস’ গঠনের মাধ্যমে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার ব্যাপক আন্দোলন শুরু হয় এবং সে আন্দোলনে চূড়ান্ত সফলতা আসে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি।
আর সেই ভাষা আন্দোলনের প্রভাব বাংলার সুদীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাসের প্রতিটা আন্দোলনে প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করেছিলো। যার সার্থক ফসল আজকের এ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।
১৯৪৮ সালের একুশে মার্চ মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ রেসকোর্স ময়দানের একটি জনসভায় এবং কার্জন হলের এক সমাবর্তন অনুষ্ঠানে ঘোষণা দেন, ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’। এ ঘোষণার দেশব্যাপী তীব্র প্রতিবাদের ঝড় প্রবাহিত হয়।১৯৫০ সালে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান নতুন করে ঘোষণা দেন, ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।’ এতে বাঙালি প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং আন্দোলন আরও জোরদার করার শপথ গ্রহণ করে। ১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি খাজা নাজিমুদ্দিন একই ঘোষণার পুনরাবৃত্তি ঘটান। ফলে ছাত্রসমাজ, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবীসহ সব শ্রেণীপেশার মানুষের মাঝে নিদারুণ ক্ষোভ ও হতাশার সৃষ্টি হয়। আন্দোলনের গতিবেগ ধীরে ধীরে তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে।পাকিস্তান সরকার ১৪৪ ধারা জারি করলেও তা ভঙ্গ করা হয়।
আজকের এই দিনে অর্থাৎ ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে আন্দোলনরত ছাত্রদের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণে শহীদ হন রফিক, সালাম, আব্দুল জব্বার, শফিউল, বরকত-সহ আরও অনেকে। সেদিন পাকিস্তানের পুলিশ গুলি চালালেও প্রতিবাদ থামানো যায়নি। তাই এই দিনটি ভাষা শহীদ দিবস হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। বাংলা ভাষার জন্য শহীদ হওয়া মানুষদের স্মরণে, প্রতি বছর এই দিনটিকে বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় স্মরণ করা হয়।
বাংলাদেশে এই দিনটি শ্রদ্ধার সহিত পূর্ণ মর্যাদায় পালন করা হয়।ফুল দিয়ে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়।কাকভোর শহীদ মিনারে অগণিত মানুষের জমায়েত হয়। প্রভাতফেরি ও শোভাযাত্রায় বহু মানুষ সমাগম হয়।গান আর কবিতা আবৃতিতে পুলকিত হয় পুরো দিন।
ইউনেস্কো দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করার আগ পর্যন্ত বাংলাদেশে এই দিনটিকে শহীদ দিবস হিসেবে পালন করা হতো।
১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো (UNESCO) ২১ ফেব্রুয়ারিকে 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসেবে পালন করার সিদ্ধান্ত নেয়। ফলে ২০০০ সালে বিশ্বে প্রথম আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালিত হয়। তারপর থেকে প্রতি বছর পালিত হয়ে আসছে। ২০১০ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত সিদ্ধান্ত মোতাবেক প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি বিশ্বব্যাপী 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' পালন করা হয়।
এমএম