ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

স্মরণ ॥ দেশপ্রেমিক মোশাররফ হোসেন 

সাজেদ রহমান

প্রকাশিত: ২০:৫৩, ২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

স্মরণ ॥ দেশপ্রেমিক মোশাররফ হোসেন 

মোশাররফ হোসেন 

আজ যশোরের প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ মোশাররফ হোসেনের মৃত্যুবার্ষিকী। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, গণপরিষদ সদস্য ও বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক শিষ্য মোশাররফ হোসেনকে ১৯৭৪ সালের এই দিন সন্ধ্যায় যশোর শহরের নিজ বাস ভবনে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তরা হত্যা করে। তিনি পড়াশোনা করেছেন যশোর জিলা স্কুলে, এরপর কলকাতার সুরেন্দ্রনাথ কলেজে (সাবেক রিপন কলেজ) আইন বিষয়ে পড়াশোনা করেন। জন্ম বনগাঁর সবাইপুর গ্রামে। দেশভাগের পর চলে আসেন যশোরে।

১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উত্থাপন করেন বাঙালির মুক্তির সনদ ‘ছয় দফা’। ছয় দফার পক্ষে যশোর অঞ্চলে জনমত গঠনে একনিষ্ঠ থাকেন মোশাররফ হোসেন। ছয় দফার পক্ষে ছাত্রলীগের বাঙালি জাতীয়তাবাদী ছাত্রনেতারা ঐক্যবদ্ধ হন তাকে  কেন্দ্র করে। আগরতলা মামলায় শেখ মুজিবুর রহমানকে অভিযুক্ত করা হলে সারা দেশের মতো যশোর অঞ্চলেও প্রবল গণআন্দোলনের সূচনা হয়। যশোর অঞ্চলে যার নেতৃত্ব দেন মোশাররফ হোসেন।

আগরতলা মামলা থেকে মুক্তি লাভের পর  শেখ মুজিবুর রহমান পশ্চিম পাকিস্তান সফরে গেলে তার সঙ্গী হন  মোশাররফ হোসেন। ১৯৭০ সালে যশোর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি নির্বাচিত করা হয় তাঁকে। একই সঙ্গে আওয়ামী লীগের  কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সদস্যপদ পান তিনি। আওয়ামী লীগের মনোনয়নে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে যশোর সদর আসন থেকে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন মোশাররফ হোসেন। নির্বাচনে জিতে আসাই শেষ কথা ছিল না তার জন্য।

স্বাধীনতার জন্য জনমত গঠন করা ও প্রয়োজনে সশস্ত্র যুদ্ধের সম্ভাবনার কথাও তার মাথায় ছিল। স্বাভাবিকভাবেই ছাত্রলীগের স্বাধীনতাপন্থি সমাজতন্ত্রে অনুরক্ত সদস্যদের নিয়ে গঠিত স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ (নিউক্লিয়াস) যা মুক্তিযুদ্ধের সময় বিএলএফ (মুজিব বাহিনী) নামে যুদ্ধ করেছে তাদের সঙ্গে মোশাররফ  হোসেনের ছিল ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। 
অ্যাডভোকেট মোশাররফ হোসেন স্বাধীনতাকে মূল লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগ যশোর জেলা শাখার শীর্ষস্থানীয় একজন রাজনীতিক। আওয়ামী লীগের ব্যানারে রাজনীতি করেও তিনি স্বতন্ত্র মনোভাব পোষণ করতেন। তিনি তার দলের এ অঞ্চলের প্রথম নেতা, যিনি মনে করতেন বাঙালিদের জন্য আলাদা একটি আবাসভূমি দরকার- দরকার স্বাধীনতা।

১৯৭১ সালের ২৭ মার্চেই মোশাররফ হোসেন ভারতে পৌঁছেন। যশোরের বয়রা বর্ডার দিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করার পর ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) কর্মকর্তা নেগি তাকে গ্রহণ করেন এবং মোশাররফ হোসেনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু বনগাঁ বারের আইনজীবী কংগ্রেস নেতা অখিল রায় চৌধুরীর বাসাতে  পৌঁছে দেন। সেখান  থেকে মোশাররফ যান সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়ের কাছে, যিনি পরবর্তীতে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হন। সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়ের সহযোগিতাতেই মোশাররফ হোসেন দেখা করেন ভারতের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে।
১৯৭১ সালের এপ্রিলের শুরুতেই তার দেখা হয় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দিল্লিতে। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ভেতর তিনি অন্যতম একজন যিনি ভারত সরকারের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দেখা করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণ প্রতিরোধে সহায়তা ও শরণার্থীদের জন্য সীমান্ত উন্মুক্ত করে দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিতের চেষ্টা করেন। 
ভারতে মোশাররফ হোসেন সর্বাত্মকভাবে আত্মনিয়োগ করেন যুদ্ধে। ছাত্র-যুবকদের সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য স্থাপিত যুব শিবিরের ব্যবস্থাপনা শুরু করেন। সেখানে মার্কিন সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডির সঙ্গেও দেখা হয় তার। মুক্তিযুদ্ধের এক পর্যায়ে ইন্দিরা গান্ধী বনগাঁ এলে আবারও তার সঙ্গে দেখা হয়  মোশাররফ হোসেনের। ছেলেদের যুদ্ধের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা তো বটেই, সীমান্ত পেরিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে রসদ, অস্ত্র, গুলি বহনও করেছেন তিনি নিজে। নির্বাচিত এমপি হিসেবে রাজনৈতিক তদারকিতেও তাকে ব্যস্ত থাকতে হয়েছে। 
স্বাধীনতার পর অল্প সময়ের ব্যবধানেই রাজনৈতিক পরিস্থিতি পাল্টাতে থাকে স্বাধীন বাংলাদেশে। একদিকে জাতীয় রাজনীতিতে সমাজতন্ত্রকে কেন্দ্র করে মেরুকরণ। তাই ১৯৭২ সালের অক্টোবর মাসেই মোশাররফ হোসেন পদত্যাগ করেন আওয়ামী লীগ  থেকে। সংবাদ সম্মেলনে তিনি জানান  কেন তিনি আওয়ামী লীগ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। ১৯৬৬ সালের দুঃসময়ে যে মোশাররফ হোসেন যশোর আওয়ামী লীগের হাল ধরেন, জাতীয়তাবাদ-সমাজতন্ত্র-ধর্মনিরপেক্ষতার সঙ্গে সঙ্গে গণতন্ত্রের প্রতিও নিষ্ঠাবান সেই মোশাররফ হোসেন স্বাধীন বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ছাড়েন।

১৯৭২ সালের ২২ সেপ্টেম্বর তার সংসদ থেকে পদত্যাগ করার পত্র গৃহীত হয়। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বিরোধী দলের যাত্রা শুরুর তোড়জোড় চলতে থাকে। বাংলাদেশ গণপরিষদ সদস্য মোশাররফ হোসেন শুরু থেকেই নতুন দলের ভিত্তি তৈরিতে সক্রিয় হন। ১৯৭৪ সালের ৩  ফেব্রুয়ারি; আততায়ীরা এসেছিল মোশাররফ হোসেনের চেম্বারে। একজন পিস্তল হাতে আর একজন স্টেনগান হাতে। খুব কাছ থেকে টিগার চাপে তারা।

আততায়ীর গুলিতে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক মোশাররফ হোসেনের মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে তাজউদ্দীন আহমদ যশোরে আসেন। শোকবার্তা পাঠান প্রধানমন্ত্রী  শেখ মুজিবুর রহমান, যোগাযোগমন্ত্রী মনসুর আলী, ড. আলীম আল রাজীসহ অনেকে। রাজনৈতিক ভিন্নমতের কারণে নিজের স্বাধীন দেশে বলি হন মোশাররফ হোসেন। তার রক্ত গিয়ে মেশে রক্তগঙ্গায়। মুক্তিযোদ্ধা হত্যার সেদিনের সেই উদ্বোধনই পরে স্বাধীনতাবিরোধী ধর্মাশ্রয়ী শক্তির পুনর্জন্মের পথ উন্মুক্ত করে দেয়। এত বড় একজন দেশপ্রেমিকের নাম এখন যশোরে উচ্চারিত হয় না, এটাই আমাদের দুঃখ।
লেখক : সাংবাদিক

×