ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

প্রসঙ্গ ইসলাম

সত্যের সাক্ষ্য জর্দানের সাহাবি বৃক্ষ

মনিরুল ইসলাম রফিক

প্রকাশিত: ২০:৩৯, ২৬ জানুয়ারি ২০২৩

সত্যের সাক্ষ্য জর্দানের সাহাবি বৃক্ষ

ইদানীং একটি ঐতিহাসিক বৃক্ষ নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে আলোচনা ও কৌতূহল দেখা যাচ্ছে

ইদানীং একটি ঐতিহাসিক বৃক্ষ নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে আলোচনা ও কৌতূহল দেখা যাচ্ছে। অবশ্য এ কৌতূহল অনেক প্রাচীন ও পজিটিভ। এর দ্বারা ইসলামি শিক্ষা ও ইতিহাসের নানা দিগন্ত উন্মেচিত হয়। আসি সাহাবি বৃক্ষ নিয়ে আলোচনায়। সাহাবি বৃক্ষ বা আশীর্বাদপ্রাপ্ত বৃক্ষ, আরবিতে যাকে বলা হয় সাজারাতুল মুবারাকা। অবিশ্বাস্য এই গাছটি আছে জর্দানের মরুভূমির প্রত্যন্ত অঞ্চলের সাফাঈ এলাকায়। এই বৃক্ষ জর্দানের রাজধানী আম্মান থেকে ১৫৬ কি.মি. দূরে অবস্থিত।

এটি মক্কা এবং দামেস্কের মধ্যে পুরনো বাণিজ্য রুটে অবস্থিত। পূর্বে এই পথ দিয়ে বাণিজ্য কাফেলা যাতায়াত করত। এটা বিশ্বাস করা হয় যে, এরকম একটি কাফেলা মক্কা থেকে সিরিয়া যাচ্ছিল। সে সময় মুহাম্মদের (স.) বয়স ছিল ১২ বছর ২ মাস ১০ দিন (তালকিহুল ফুহুম, ইবনে যাউজি, পৃ: ৭)। তিনি বৃক্ষটির ছায়ায় বসে বিশ্রাম নিয়েছিলেন। তিনি তার চাচা আবু তালিবের সঙ্গে ছিলেন। এই বৃক্ষের নিচে খ্রিস্টান পণ্ডিত বুহায়রা মুহাম্মদের (স.) নবুওয়াত সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন।
বর্তমানে এটি জর্দানের একটি পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে অতি আকর্ষণীয়। প্রতি বছর অনেক মুসলমান বৃক্ষটি দেখতে আসেন। জর্দানের রাজধানী আম্মান থেকে ১৫৬ কি.মি. দূরে জর্দানের সাহাব শহরের দিকে এর অবস্থান। সেখানে আপনি সেভেন স্লিপারদের গুহা পরিদর্শন করতে পারেন। জর্দানের বাদশাহ দ্বিতীয় আব্দুল্লাহ এই স্থানটিকে পবিত্র স্থান হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। আবদুল্লাহ বৃক্ষটিকে রক্ষা করার জন্য বৃক্ষের চারপাশে বেড়া নির্মাণেরও নির্দেশ দেন।

সাহাবি গাছটিকে কেন্দ্র করে এখানে আগতরা গাছের নিচে নামাজ আদায় করে থাকেন। প্রচুর লোক সমাগম হলে জামাতের সঙ্গে নামাজ আদায় করে থাকেন তারা। এছাড়াও ধু-ধু মরুভূমির বুকে সাহাবি গাছের তলাটি সুশীতল বিশ্রামের স্থান, যা মানুষের মনে প্রশান্তি এনে দেয়। ভক্ত মুসলমানরা ছুটে আসেন একটু পবিত্র বাতাস গ্রহণ করতে, যা একদিন নবীজি (স.)-এর পরশ লেগে হয়েছিল সুশোভিত।
এই গাছটি এখন প্রায় ১৫০০ বছরের পুরনো ঐতিহাসিক সাহাবি গাছ। ৫৮২ খ্রিস্টাব্দে মহামানব হজরত মুহাম্মদ (স.) চাচা আবু তালিবের সঙ্গে বাণিজ্য করতে মক্কা থেকে শাম দেশে বর্তমান সিরিয়ার উদ্দেশে যাত্রা করেন। যাত্রাপথে তারা সিরিয়ার অদূরে জর্দান এসে উপস্থিত হন। এই এলাকাটি তখন ছিল শত শত মাইলব্যাপী উত্তপ্ত বালুকণাময় মরুভূমি। চাচার সঙ্গে রাসূল (স.) মরুভূমি পাড়ি দিতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েন। তারা একটু বিশ্রামের সন্ধান করছিলেন।

কিন্তু আশপাশের কোনো গাছ বা ছায়া পাচ্ছিলেন না। তখন তারা কিছু দূরে পাতাবিহীন মৃতপ্রায় একটি গাছ দেখতে পেলেন। এই গাছটির নিচে কেউ বসতে পারত না। কিন্তু কোনো উপায় না পেয়ে ক্লান্ত নবীজি (স.) ও তার চাচা মৃতপ্রায় পাতাহীন গাছটির নিচে বসেন বিশ্রাম নিতে। আল্লাহ তায়ালার রহমতে তখনি সবুজ পাতায় ভরে যায় গাছটি। 
এই ঘটনা দূর থেকে দেখেন জারজিস ওরফে বুহায়রা নামের একজন খ্রিস্টান পণ্ডিত। তিনি নবীজির (স.) চাচার কাছে এসে বললেন, আমি এতদিন এখানে আছি কেউ এই গাছের নিচে বসতে পারেনি এবং এই গাছের কোনো পাতা ছিল না। অন্য বর্ণনায় আছে, বুহায়রা কাফেলার লোকদের মেহমানদারি করেন। অথচ পাদ্রী কখনো তার গীর্জা থেকে বের হতেন না। তিনি অত্যন্ত ¯েœহভরে প্রিয় নবীজির (স.) হাত স্পর্শ করেন এবং আদবসহকারে চাচার কাছে কিছু কথা জিজ্ঞেস করেন (আর রাহিকুল মাখতুম ৭৫)।
খ্রিস্টান প-িত জানতে চান : এই ছেলেটির নাম কি? চাচা বললেন, মুহাম্মদ।
তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন : তার বাবার নাম কি? নবীজির চাচা উত্তর দিলেন আব্দুল্লাহ।
তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন : তার মাতার নাম কি? চাচা এবার জবাব দিলেন আমিনা।
বালক মুহাম্মাদকে (স.) দেখে তাদের সঙ্গে কথা বলে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন পাদ্রীর চিনতে আর বাকি রইল না যে, ইনিই সেই বহু প্রতীক্ষিত শেষ নবী। ইতিহাসের গতি পরিবর্তকারী, আরবসহ সমগ্র পৃথিবী থেকে পৌত্তলিকতার বিনাশকারী, একত্ববাদকে শক্ত ভিতের ওপর প্রতিষ্ঠাকারী।

সঙ্গে সঙ্গে খ্রিস্টান প-িত বললেন, আমি পড়েছি এই আকৃতির ব্যক্তিটিই হবেন ইসলাম ধর্মের শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (স.), সাইয়্যেদুল মুরসালীন আখেরি নবী! এক পর্যায়ে আবু তালেব আরেকটু সবিস্তার জানতে চাইলে বুহায়রা বা জার্জিস বলেন, আপানারা এ এলাকায় আসার পর এ বালকের সম্মানে এলাকার সব গাছপালা এবং পাথর সেজদায় নত হয়েছে। এরা নবী ছাড়া অন্য কাউকে সেজদা করে না। তাছাড়া মোহরে নবুয়ত দ্বারা আমি তাকে চিনতে পেরেছি। তার কাঁধের নিচের নরম হাড়ের পাশে এটি ‘সেব’ ফলের মতো মজুদ রয়েছে। আমরা তার উল্লেখ  আমাদের ধর্মীয় গ্রন্থে দেখেছি।

এরপর পাদ্রী বুহায়রা আবু তালেবকে বলেন, ওকে যত তাড়াতাড়ি পারেন মক্কায় ফিরিয়ে নিয়ে যান। সিরিয়ায় নেবেন না। ইহুদিরা তার ক্ষতি করতে পারে। এ পরামর্শ অনুযায়ী আবু তালেব কয়েকজন ভৃত্যের সঙ্গে তাকে মক্কায় পাঠিয়ে দেন।- (প্রাগুক্ত, বিশ^ নবী- গোলাম মুস্তাফা, তিরমিজি শরীফ)। 
আল্লাহ তায়ালার ইশারায় সেই পুণ্যস্মৃতিধন্য সাহাবি গাছটি নবীজিকে নিরাপদ আশ্রয় দান করেছিল। আজও সেই গাছটি বেঁচে আছে অকৃত্রিম, অলৌকিকভাবে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (স.)-এর নবুয়তের সাক্ষ্য হয়ে। এই গাছটির অলৌকিকতা মনে করিয়ে দেয় সৃষ্টিকর্তা বলে একজন আছেন।

তাঁরই রহমতে বেঁচে আছে গাছটি। কালের পর কাল, যুগের পর যুগ শত শত বছর ধরে দাঁড়িয়ে আছে একটি গাছ। যার নাম সাহাবি গাছ। পৃথিবী সৃষ্টির পর নানারকম অলৌকিক ঘটনার পুনরাবৃত্তি করেছেন মহান আল্লাহ সোবহানা তাআলা। সেই সৃষ্টির পুনরাবৃত্তির অংশ হচ্ছে ঐতিহাসিক সাহাবি গাছ। ইংরেজিতে এই গাছটিকে বলা হয় দ্যা ব্লেস্ড ট্রি। ভাবা যায় চারদিকে ধু-ধু মরুভূমির বুকে দাঁড়িয়ে আছে একটি গাছ।

সাহাবি গাছটির আশপাশে শত বর্গকিলোমিটারজুড়ে কোনো গাছপালার অস্তিত্ব না থাকলেও এই গাছটি এখনো বেঁচে আছে। এখনো অনুপ্রাণিত করে বিশ্ব মুসলিমকে। আল্লাহ তায়ালা পাক কুরআনে ও হাদিসে কুদসিতে বলেছেন- আমার বিস্তৃত সৃষ্টির মাঝে মুহাম্মদ (স.)-এর গর্ব ও সৌরভ সর্বত্র বিরাজামান। নবীজির (স.)-এর ওপর লাখো দরুদ ও সালাম, আমরা যার উম্মত হয়ে ধন্য হয়েছি।
লেখক :  অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতিব

[email protected]

×