ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিপ্লব ঘটাতে হবে কম্পিউটার উৎপাদনে-৪

মোস্তাফা জব্বার

প্রকাশিত: ২২:৪৫, ৪ ডিসেম্বর ২০২২

বিপ্লব ঘটাতে হবে কম্পিউটার উৎপাদনে-৪

.

মোবাইল ব্যবহারকারীর মতোই হ্যান্ডসেট উৎপাদন শিল্প বিপুল আকার ধারণ করলেও এর গল্পটা আরও অল্প সময়ের। পাঁচ বছর আগেও শতভাগ আমদানিনির্ভর ছিল এ ইন্ডাস্ট্রি। ২০১৭ সালে দেশে প্রথম মোবাইল উৎপাদন কারখানা স্থাপনের মাধ্যমে এর সূচনা করে দেশীয় ইলেক্ট্রনিক্স জায়ান্ট ওয়ালটন।
১ হাজার কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ করে কারখানা স্থাপনের পর ট্যাক্স হলিডে, ভ্যাট অব্যাহতিসহ নানা প্রণোদনাও দেয় সরকার। বর্তমানে ওয়ালটন এককভাবে বছরে ৭০ লাখ ইউনিটের বেশি হ্যান্ডফোন উৎপাদনের সক্ষমতা রাখে। এর মধ্যে স্মার্টফোন উৎপাদন সক্ষমতা ১২ লাখ ইউনিটের। দেশে কারখানা তৈরি করে মানুষের মোবাইল ফোনের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছে কোম্পানিটি। রপ্তানিও করছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। ওয়ালটন মোবাইলের সিবিও এস এম রেজোয়ান আলম বলেন, ওয়ালটনের কারখানায় প্রকৌশলী এবং টেকনিশিয়ানসহ চার হাজারের বেশি মানুষ কাজ করছে। ফোন বিপণনের সঙ্গেও কর্মসংস্থান হয়েছে বিপুল সংখ্যক মানুষের। তিনি বলেন, ওয়ালটন দেশে প্রথম ফোন উৎপাদন শুরু করে। এখন প্রায় সব প্রতিষ্ঠানই কারখানা স্থাপন করেছে। আমরা আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে এখন মধ্যপ্রাচ্য ও আমেরিকাসহ ৭-৮টি দেশে ফোন রপ্তানিও করছি। ওয়ালটনের পরেই দেশে মোবাইল ফোনের কারখানা করেছে আরেক দেশীয় ব্র্যান্ড সিম্ফনি। বর্তমানে মাসে প্রায় ৫ লাখ ইউনিট ফোন উৎপাদন করছে প্রতিষ্ঠানটি। দেশের মানুষের চাহিদা মিটিয়ে সম্প্রতি নেপালে ফোন রপ্তানি শুরু করেছে তারা।
এডিসন গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাকারিয়া শাহিদ বলেন, দেশে ফিচার ফোন বাজারের ২৮ থেকে ৩০ শতাংশ সিম্ফনির দখলে। নিজেদের কারখানায়  তৈরি হচ্ছে এসব ফোন। এ জন্য সিম্ফনি গড়ে তুলেছে নিজস্ব সফটওয়্যার নির্মাতা দল। এই দলের সদস্যরা সফটওয়্যার, অ্যাপস ও গেমস ডেভেলপও করছে।
সিম্ফনি, ওয়ালটন ছাড়াও দেশে কারখানা করে বৈশ্বিক ব্র্যান্ড ট্রান্সশন হোল্ডিংসের হ্যান্ডসেট দেশে অ্যাসেম্বল করছে টেকনো।
বৈশ্বিক ব্র্যান্ডের কারখানাও বাংলাদেশে : ২০১৮ সালে বাংলাদেশে অ্যাসেম্বলিং কারখানা তৈরি করে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মোবাইল হ্যান্ডসেট কোম্পানি স্যামসাং। নরসিংদীতে ফেয়ার ইলেক্ট্রনিক্সের এ কারখানায় কর্মসংস্থান ২ হাজারের বেশি লোকের।
রপ্তানি নির্ভরতা কমিয়ে নিয়ে আসাও দেশে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির লক্ষ্যে আইনি কাঠামো পরিবর্তনের কারণেই বাংলাদেশে কারখানা স্থাপনে বাধ্য হয় কোরিয়া বেজড ইলেক্ট্রনিক জায়ান্ট স্যামসাং। প্রতি বছর ৬০ লাখ অ্যাসেম্বলিং সক্ষমতার লক্ষ্য নিয়ে স্যামসাং তাদের কারখানায় এক হাজার কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ করেছে।
ফেয়ার ইলেক্ট্রনিক্সের সিএমও মেসবাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, আমরা এখন আমাদের কারখানায় সব ডিভাইস অ্যাসেম্বল করতে প্রস্তুত। মার্চের পর স্যামসাং ফোন আমদানির আর প্রয়োজন হবে না। তিনি বলেন, এটি হবে দেশের সর্ববৃহৎ প্রযুক্তিভিত্তিক শিল্পকারখানা।
এদিকে ২০১৯ সালের জুলাইতে ভিভো নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলায় তাদের নতুন ম্যানুফ্যাকচারিং প্লান্টের উদ্বোধন করে, এটি ছিল তাদের ৫ম বৈশ্বিক উৎপাদন কারখানা।
সম্পূর্ণ প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগে (এফডিআই) ভিভোই বাংলাদেশে প্রথম মোবাইল অ্যাসেম্বলি প্লান্ট চালু করেছে। রূপগঞ্জের প্লান্টটি প্রতি বছর অন্তত ১০ লাখ স্মার্টফোন অ্যাসেম্বল করবে।
২০১৯ সালের নভেম্বরে গ্লোবাল স্মার্টফোন ব্র্যান্ড অপ্পো গাজীপুরে বেনলি ইলেক্ট্রনিক এন্টারপ্রাইজ কোম্পানি লিমিটেড নামে তাদের ম্যানুফ্যাকচারিং প্লান্ট চালু করে; এটি তাদের ১০ম বৈশ্বিক ম্যানুফ্যাকচারিং প্লান্ট। বছরে ১০ লাখ ইউনিট স্মার্টফোন অ্যাসেম্বল করার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে অপ্পোর। শুধু স্যামসাং, অপ্পো, ভিভো নয় গত তিন বছরে দেশে কারখানা স্থাপন করেছে শাওমি, নকিয়া, লাভাসহ অন্তত ৭টি  বৈশ্বিক ব্র্যান্ড।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মোবাইল হ্যান্ডসেট আমদানিতে শুল্কারোপ এবং স্থানীয় উৎপাদনে কর অবকাশ সুবিধা ও ভ্যাট অব্যাহতির কারণে দেশে ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের পাশাপাশি অ্যাসেম্বলিং কারখানা স্থাপন করেছে প্রায় সব বড় ব্র্যান্ড।
বাংলাদেশ মোবাইল ফোন ম্যানুফ্যাকচারিং অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সেক্রেটারি রেজওয়ানুল হক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, পৃথিবীর সব দেশেই পলিসি সাপোর্ট নিয়ে ইন্ডাস্ট্রি গড়ে ওঠে। বাংলাদেশও তাই হয়েছে।
সরকার ২০১৭-১৮ অর্থবছরে প্রথম স্থানীয় অ্যাসেম্বলারদের জন্য একটি ট্যাক্স পলিসি চালু করে এবং এখন পর্যন্ত প্রতি বাজেটে একে সংশোধন করা হয়েছে।
বর্তমানে, স্মার্টফোন আমদানিতে ৫৭ এবং বেসিক এবং ফিচার ফোনে ৩২ ভাগ ট্যাক্স রয়েছে। স্থানীয়ভাবে অ্যাসেম্বলড এবং উৎপাদিত (ম্যানুফ্যাকচারড) হ্যান্ডসেটের জন্য ট্যাক্স যথাক্রমে ১৮ এবং ১৩। এই অর্জনের জন্য আমি কৃতজ্ঞচিত্তে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই।
মোবাইল সেট উৎপাদনের এই অসাধারণ সফলতার পাশাপাশি কম্পিউটার যন্ত্রাদি উৎপাদনে একটি বিপ্লব করার প্রয়োজনীয়তা এখন গভীরভাবে অনুভূত হচ্ছে। মোবাইল উৎপাদনের সফলতা আমাদের প্রচ-ভাবে আত্মবিশ্বাসী করেছে যে, কম্পিউটার উৎপাদনেও এর চাইতে বড় সফলতা আমরা অর্জন করতে পারি। কোনো সন্দেহ নেই যে, মোবাইল ফোন সেটের ব্যবহার কম্পিউটারের চাইতে অনেক বেশি। কিন্তু আমদানিনির্ভরতা এই খাতে একদিকে আমাদের চরম দুর্বলতার প্রকাশ, অন্যদিকে সকল বিবেচনায় এটি আমাদের জাতীয় স্বার্থের সবচেয়ে সহায়ক একটি উদ্যোগ। বস্তুত মোবাইল উৎপাদন ও কম্পিউটার উৎপাদনে প্রযুক্তিগত সক্ষমতার মিল আছে। আমরা দেখেছি যে কেবল উপযুক্ত পরিবেশ দিতে পারলে আমাদের সন্তানেরা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে এসব যন্ত্র উৎপাদনও করতে পারে। মোবাইল শিল্পে যে ইতিবাচক অর্জনগুলো আমরা পেয়েছি, তার চাইতেও ভালো অবস্থান কম্পিউটারেও হতে পারে। অন্তত ২০১৭ সাল থেকেই আমি কম্পিউটার উৎপাদনের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরির আবেদন করে আসছি। প্রতিবছরই এই বিষয়টি আমার কাছে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পেয়ে থাকে। ১৭-১৮ সাল থেকে এটি ভাবা হয় যে কম্পিউটার আমদানির ওপর শুল্ক আরোপ করা হলে এর প্রসার বন্ধ হয়ে যাবে। ২২ সালে এসে সেই ধারণার কোনো যৌক্তিকতা নেই।

কারণ, আমরা যে কম্পিউটার উৎপাদন করতে পারি তা প্রমাণিত।  ২০১৮ সালে তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ কম্পিউটার ল্যাব গড়ে তোলার জন্য দেশীয় কম্পিউটার গ্রহণ করে। একই বিভাগ পরবর্তীকালেও দেশীয় কম্পিউটার গ্রহণ করে। সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় দেশীয় কম্পিউটার নিচ্ছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের ব্যুরো অব স্ট্যাটিস্টিকস দেশীয় ট্যাব গ্রহণ করেছে। এখন পর্যন্ত দেশীয় কম্পিউটারের ক্ষেত্রে কোনো ত্রুটির কথা জানা যায়নি। এসব ক্ষেত্রে দেশীয় কম্পিউটার নেওয়ার ফলে শত শত কোটি টাকা রাষ্ট্রের সাশ্রয় হয়েছে। গত বছরের বাজেটে বিষয়টি বাস্তবায়িত হয়ে যাওয়াটা প্রায় নিশ্চিত ছিল। কিন্তু সামগ্রিক বিবেচনায় প্রস্তাবটি গ্রহণ করা হয়নি। এবার আমি বিষয়টি তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টার দৃষ্টিতে আনলে তিনি বিষয়টির গুরুত্ব উপলব্ধি করেন ও আমদানি করা কম্পিউটার ও যন্ত্রাংশের আমদানি ব্যয়ে অন্তত ২০-২৫ ভাগ পার্থক্য থাকা উচিত বলে তিনিও মতপ্রকাশ করেন। গত ৭ এপ্রিল ডিজিটাল বাংলাদেশ টাস্কফোর্সের সভায় প্রধানমন্ত্রীও এই উদ্যোগ গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত প্রদান করে। ফলে, এবারের বাজেটে বিষয়টি বাস্তবায়িত হবে সেটাই প্রত্যাশা।
আমি তিনটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারি :
ক) সফটওয়্যারের মতো হার্ডওয়্যার উৎপাদনকেও শূন্যকর সুবিধা প্রদান করা যায়। মোবাইলের মতো আমদানির ওপর শুল্ক ও ভ্যাট বাড়ানো যেতে পারে।  পার্থক্যটা অন্তত ২০/২৫ ভাগ হতে পারে। ২২-২৩ সালের বাজেটে সুবিধা দেওয়া হলেও যতটা প্রয়োজন ততটা দেওয়া হয়নি।
খ) সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিদেশী ব্র্যান্ড কেনার বদলে দেশীয় ব্র্যান্ডের ডিজিটাল ডিভাইস কেনার বিধান করা যায়। মোবাইল সেটের মতো কম্পিউটার পণ্য বাংলাদেশে সংযোজিত বা উৎপাদিত হলে বিপুল মানুষের কর্মসংস্থান ছাড়াও প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হবে।
গ) দেশীয় কম্পিউটার উৎপাদনের ক্ষেত্রে কর ও ভ্যাট রেয়াত দেওয়া ছাড়াও রপ্তানির প্রণোদনা নিশ্চিত করতে হবে। শতকরা ১০ ভাগ প্রণোদনার বিষয়টি ২০১৭ সালেই সিদ্ধান্ত হলেও এখনো এতে প্রচুর জটিলতা রয়ে গেছে।
সামগ্রিকভাবে দেশে কম্পিউটার উৎপাদনের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করাটা এখন সময়ের দাবি।
ঢাকা,  ২ ডিসেম্বর ২০২২

লেখক :  তথ্যপ্রযুক্তিবিদ,  কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান- সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যার এবং বিজয় ডিজিটাল শিক্ষা সফটওয়্যারের উদ্ভাবক, ডিজিটাল প্রযুক্তির অনেক ট্রেডমার্ক, প্যাটেন্ট ও কপিরাইটের স্বত্বাধিকারী
[email protected]

www.bijoyekushe.net.bd

×