ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

টরন্টোর চিঠি

ভিনসেন্ট ভ্যান গঁগ ও বিশ্বকাপ

শামীম আহমেদ

প্রকাশিত: ২০:৪০, ২৯ নভেম্বর ২০২২

ভিনসেন্ট ভ্যান গঁগ ও বিশ্বকাপ

নভেম্বরের শুরুতে টরন্টোর হারবারফ্রন্টের পাশে একটা গ্যালারিতে আমরা ভ্যান গঁগের চিত্রকলার ডিজিটাল প্রদর্শনী দেখতে গেলাম

নভেম্বরের শুরুতে টরন্টোর হারবারফ্রন্টের পাশে একটা গ্যালারিতে আমরা ভ্যান গঁগের চিত্রকলার ডিজিটাল প্রদর্শনী দেখতে গেলাম। ইমারসিভ ভ্যান গঁগ নামে বিশ্বব্যাপী খ্যাতি কুড়ানো এই চিত্রকলা প্রদর্শনী প্রায় দু’বছর ধরে চলছিল টরন্টোতে। এই মাসেই এটির শেষ প্রদর্শনী হবে। দেখব দেখব করে ঠিক প্রদর্শনীর শেষ সপ্তাহে এসে দেখা হলো আমাদের। একদিকে করোনার সময়ে বাইরে যেতে অনাগ্রহ। তার ওপর তিনজনের টিকিট এবং সপ্তাহান্তে কোনো এক সন্ধ্যায় চিত্রকলা প্রদর্শনী ও তার আনুষঙ্গিক দু’ শ’ ডলার খরচ নিয়ে কিছুটা দ্বিধান্বিত ছিলাম। এটি যে খুব বিরল কিছু এমন নয়।

আমার মনে আছে, আমি যখন প্রথম লন্ডনে যাই, তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির ছাত্র। ব্রিটিশ কাউন্সিলের অর্থায়নে একটি প্রকল্পে পার্টটাইম কাজ করি আইইউবির তখনকার গণযোগাযোগের শিক্ষক আবু নাসের রাজীবের সঙ্গে। রাজীব ভাইয়ের সঙ্গে কাজ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবেই অনেকটাই শিখছিলাম। আবার উনিও আমাকে খুব স্নেহ করতেন। ভালো কাজ আর উনার প্রণোদনায় আমি ব্রিটিশ কাউন্সিলের একটি আন্তর্জাতিক অধিবেশনে যোগ দেওয়ার সুযোগ পাই। যুক্তরাজ্যের নিউ ক্যাসেলে সেই সমাবেশ।

বাংলাদেশ থেকে আমার সঙ্গে ছিলেন ব্রিটিশ কাউন্সিলের তায়েবা আপা, এখন ইউনিসেফে কাজ করেন, শাবনাজ আপা, কনফিডেন্স গ্রুপের এখনকার শীর্ষ কর্মকর্তা বন্ধু তারেক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটারের শিক্ষক ও থিয়েটার কর্মী লিপন ভাইসহ আরও কয়েকজন। যাই হোক ওই কনফারেন্স শেষে ব্যক্তিগত ছুটিতে আমি লন্ডনে আসি কয়েকদিনের জন্য। সেখানে মুক্তার ভাই আমাকে নিয়ে ঘুরতে বের হলেন একদিন। আমি লন্ডন আইতে উঠব, উনারা কেউ যাবেন না। হেসে বললেন আমরা তো লন্ডনেই থাকি, ২২ পাউন্ড দিয়ে এটাতে ওঠার কোনো মানে হয় না। আপনি বেড়াতে এসেছেন, আপনি ওঠেন। এই বিষয়টা অনেক ক্ষেত্রেই খাটে। যেমন আমি টরন্টোতে এতদিন ধরে আছি কখনো সিএন টাওয়ারে উঠিনি।

ইমারসিভ ভ্যান গঁগ প্রদর্শনীর বিষয়েও একই অনুভূতি হচ্ছিল। কিন্তু শেষমেশ গিয়ে মুগ্ধ হলাম। ইমারসিভ প্রদর্শনীতে ভ্যান গঁগের চিত্রকলাগুলোতে ডিজিটাল কনভার্সানের মাধ্যমে প্রজেক্টরে করে একটা বিশাল গ্যালারির দেয়ালে দেখানো হচ্ছিল। অবশ্যই সেগুলোকে স্থিরচিত্র থেকে চলমান চিত্র প্রদর্শনীতে রূপান্তরিত করা হয়। সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয় সুর ও আলোর খেলা। আধা ঘণ্টা করে দুই দফায় এক ঘণ্টা ধরে প্রদর্শনীটি দেখা যায় এক টিকিটেই। প্রদর্শনী দেখে আমরা মুগ্ধ হয়েছি। ভ্যান গঁগ একজন অসম্ভব মেধাবী চিত্রশিল্পী যিনি মাত্র ৩৭ বছরে মৃত্যুবরণ করেন।

মজার বিষয় হচ্ছে, ভ্যান গঁগ ২৭ বছর বয়স পর্যন্ত কখনো কোনো চিত্রকলা আঁকেননি। কিন্তু ২৭ বছরে শুরু করে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি ২০০০টি শিল্পকর্ম সৃষ্টি করেছেন, যার মধ্যে ৯০০টি তৈলচিত্র যা তাঁকে মৃত্যুর পর বিপুল খ্যাতি এনে দিয়েছে। ভ্যান গঁগ ডেলিরিয়াম নামের একটি জটিল রোগে ভুগতেন, যার ফলে আশপাশের বাস্তবতা নিয়ে তিনি বিভ্রান্ত ছিলেন। এছাড়া তিনি টিনিটাস নামে আরেকটি বিরল রোগে ভুগছিলেন, যার ফলে তার কানের ভেতর সারাক্ষণই ঝনঝন শব্দ হতো। ভ্যান গঁগের শৈশব থেকে তারুণ্য খুবই অস্থিতিশীল ছিল। তিনি তাঁর ভাইয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হলেও একসময় তাঁর জীবনযাপনের উচ্ছৃঙ্খলতার কারণে তার সঙ্গে সম্পর্কে দূরত্ব সৃষ্টি হয় এবং তিনি প্যারিস থেকে বহুদূরের একটি গ্রামে চলে যান বন্ধু পল গোগেনের সঙ্গে।

সেখানে দুজনে ছবি আঁকতে থাকেন এবং মাত্র ১৫ মাসে তিনি প্রায় ৩০০ চিত্রকর্ম সম্পাদন করেন। কিন্তু তাঁর মানসিক অস্থিরতা বাড়তে থাকে এবং তিনি বন্ধুকে মারতে উদ্যত হলে পল গোগেন সেখান থেকে পালিয়ে যান। ওই সময়ে ভ্যান গঁগ রেজার দিয়ে তার বাম কান কেটে ফেলেন। ডেলিরিয়ামে আক্রান্ত ভ্যান গঁগ হাসপাতালে আসা যাওয়ার মধ্যে ১৮৯০ সালের ২৭ জুলাই নিজের বুকে রিভলবার দিয়ে গুলি করেন এবং একদিন পরেই সংক্রমণে মারা যান। ভ্যান গঁগ জীবিত থাকতে মূলত তার ভাই, বন্ধু পল গোগেন ও এমিলি বার্নার্ডসহ অনেককে প্রায় ৮০০ চিঠি লেখেন এবং এই চিঠিগুলোতে তাঁর জীবনযাপন, শিল্পদর্শন নিয়ে ধারণা পাওয়া যায়।

তাঁর চিত্রকর্ম ড. গাশি ১৯৯০ সালে প্রায় ৮২.৫ মিলিয়ন ডলারে বিক্রি হয়। মৃত্যুর মাত্র ১০ বছর পর থেকেই ভ্যান গঁগের চিত্রকর্মের কদর বাড়তে শুরু করে। কিন্তু জীবিত অবস্থায় তিনি অর্থনৈতিক দৈন্যতার মধ্য দিয়েই কাটিয়েছেন। তাঁর ভাই থিওর ছেলে ১৯২৫ সালে মৃত্যুর সময় ভ্যান গঁগ ফাউন্ডেশনকে নির্দেশনা দিয়ে যান। বিনিময়ে হল্যান্ড সরকার ভ্যান গঁগ জাদুঘর তৈরি করে। এই ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয় যে, ভ্যান গঁগের চিত্রকর্ম আজীবন সাধারণ মানুষ অযৌক্তিক অর্থব্যয় ব্যতিরেকে দেখে যেতে পারবেন। ম্যাসিমিলানো সিকার্ডি এবং লুকা লঙ্গবার্ডি এই ডিজিটাল প্রদর্শনীর সৃষ্টি করেন যা স্থায়ীভাবে নিউইয়র্ক সিটিতে স্থান পাবে।

ভ্যান গঁগের মতো অসামান্য মেধাবী মানুষদের অনেকেই জীবিত অবস্থায় তাদের প্রাপ্য খ্যাতি পাননি এবং তীব্র অর্থকষ্টের মধ্য দিয়ে জীবনযাপন করেছেন। ভাবছিলাম এসব কথাই। মৃত্যুর আগে ভ্যান গঁগের শেষ কথা ছিল। দ্যা স্যাডনেস উইল লাস্ট ফরেভার। অর্থাৎ, এই বিষাদে অমর হব। ভ্যান গঁগের প্রদর্শনী আমাকে বাংলার অনন্য সাধারণ কবি জীবনানন্দ দাশের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিল। জীবিত অবস্থায় পত্রিকাগুলো তার কবিতা ছাপাতে তত আগ্রহ না দেখালেও এখন তিনি বাংলা ভাষার অন্যতম সেরা কবি হিসেবে পরিচিত। তিনিও শারীরিক অবস্থার অবনতি, অর্থনৈতিক দুর্দশা ও মানসিক অস্থিরতা থেকে ট্রামের নিচে আত্মহত্যা করেন মাত্র ৫৫ বছর বয়সে।
এদিকে জরাগ্রস্ত এই পৃথিবীতে মানুষের সংখ্যা ৮০০ কোটি হলো। ডিজিটাল গণনাযন্ত্রের এই হিসাব একদম নিখুঁত না হলেও হিসাবের কাঁটাটা আশপাশে কিছুই হবে। করোনায় পৃথিবীতে প্রায় ৭০ লাখ মানুষের মৃত্যুর কারণে তা আজ থেকে ৫০ বছর পর পৃথিবীর জনসংখ্যায় একটা বড় নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলেই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। তবে পৃথিবীতে জনসংখ্যা প্রায় ১১০০ কোটি পর্যন্ত বেড়ে তারপর ঋণাত্মক হওয়া শুরু হবে বলেই বিশেষজ্ঞদের ধারণা।

খরা, বন্যা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, পরিবেশ বিপর্যয়, যুদ্ধবিগ্রহ, অজানা রোগ এবং সার্বিকভাবে মানুষের জনসংখ্যা বৃদ্ধির ক্ষমতা কমে আসছে বলে ধারণা করা হয়। কিন্তু সেই অবস্থায় পৌঁছানোর আগে বিশ্বের এই ৮০০ কোটি মানুষের মুখে খাবার তুলে দেওয়া কঠিন হয়ে যাচ্ছে। চীনকে টপকে খুব শীঘ্রই ভারত জনসংখ্যার দিক দিয়ে পৃথিবীর এক নাম্বার দেশে পরিণত হবে। জনসংখ্যার দিক দিয়ে বাংলাদেশের স্থান দশম হলেও জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারে বাংলাদেশ এখন বেশ পেছনে যা উৎসাহব্যঞ্জক। জনসংখ্যা বৃদ্ধি হচ্ছে কানাডাতেও। কিন্তু সেটা ইমিগ্রেশনের মাধ্যমে। প্রতিবছর প্রায় ৫ লাখ মানুষ আসছে কানাডাতে। যার অধিকাংশই আবার থাকতে চায় টরন্টোতে।

যার প্রভাব পড়ছে টরন্টোর আবাসন, চিকিৎসা ও শিশু যত্ন সেবাতেও। গত সপ্তাহের শুরুর দিকে আমি আমার ডাক্তারের পরামর্শে রক্ত পরীক্ষা করতে গিয়েছিলাম এখানকার একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। কানাডার অনেকটার সেবার মান অত্যন্ত উন্নত হলেও এই ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর সেবার মান বেশ নিম্নমানের। সেবাদানকারীদের ব্যবহার অত্যন্ত কর্কশ ও রুক্ষ। এদের অধিকাংশই অন্য দেশ থেকে কানাডায় ইমিগ্রেন্ট হয়ে আসা মানুষ। তারা ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সবার সঙ্গেই খুব রুক্ষ ব্যবহার করেন, এমনটা শুরু থেকেই দেখে আসছি। তবে আমি খেয়াল করে দেখেছি, এদের সঙ্গে মিষ্টি করে কথা বললে আবার খুব সহজেই তারা মিশুক হয়ে ওঠেন। যেমন আমার রক্ত নিয়ে আসলেন যেই কালো ভদ্রমহিলা তিনি অন্যদের সঙ্গে বেশ উঁচু গলায় কথা বলছিলেন।

আমি শুরুতেই তাকে শুভ সকাল জানিয়ে বললাম, দেখেছ কী বরফটাই না পড়েছে আজ, কে ভেবেছিল এ বছর ডিসেম্বরের আগে বরফ নামবে! এই আবহাওয়ায় আজ তুমি কেমন বোধ করছ? মহিলা আমার কথা শুনেই নরম হয়ে গেলেন এবং আমার সঙ্গে আলাপজুড়ে দিলেন। খুবই যত্নের সঙ্গে রক্ত নিলেন এবং আমাকে খুবই আন্তরিকভাবে বিদায় জানালেন। আমি খেয়াল করে দেখেছি একজন ব্যক্তির ব্যবহার যত কর্কশই হোক না কেন আপনি যদি খুব আন্তরিকভাবে তার সঙ্গে আচরণ করেন, তাহলে তার আচরণেও কিছুটা হলে পরিবর্তন আসে। এটি সবার ক্ষেত্রে কাজ করবে এমন নয়। তবে অনেকের সঙ্গেই কাজ করে। তবে এতে সফল হতে হলে উক্ত ব্যক্তির সঙ্গে চোখাচোখি হওয়া এবং একাকী কথা বলার সুযোগ থাকা বাঞ্ছনীয়। নতুবা এই কৌশল কাজ নাও করতে পারে!
সারাবিশ্বকে নাড়া দিয়ে ২০২২ সালের ফুটবল বিশ্বকাপ শুরু হলো কাতারে। ১৯৯০ সাল থেকে আমার বিশ্বকাপ ফুটবল দেখার স্মৃতি মনে আছে। তখন থেকেই আর্জেন্টিনাকে সমর্থন করি। কেন করি, এটা বলা মুশকিল। বিশ্ব ফুটবল নিয়ে আমার বাবার দিকের আত্মীয়রা কে কোন্ দল সমর্থন করত, সেটা তখন একদমই জানতাম না। অন্যদিকে আমার মায়ের দিকের আত্মীয়রা সবাই ছিল ব্রাজিলের পক্ষে। তাদের ফ্যান না বলে ফ্যানাটিক বলাই শ্রেয়। এতটাই উগ্র সমর্থক তারা ব্রাজিল দলের! আব্বাকেও আমার ব্রাজিলের সাপোর্টার মনে হতো, তিনি কোনো কিছু খুব একটা খুলে বলতেন না।

আমার আম্মা ছিলেন ম্যারাডোনার ভক্ত। আমি আর্জেন্টিনার সমর্থক হয়েছিলাম। ফুটবল নিয়ে ব্যাপক পড়ালেখা করা মানুষজন নানা হিসাব নিকাশ করে মাঠে ফুটবলারদের পজিশন ধরে ধরে বুঝিয়ে দিচ্ছেন এবারের বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা খুব শক্তিশালী একটা দল। এদের একজন স্প্যানিশ লীগে খেলে তো আরেকজন ইংলিশ লীগে খেলে! খেলা পাগল ভক্তরা বলছে, এবারের আর্জেন্টিনা খুবই শক্তিশালী দল, কাপ যাচ্ছে তাদের ঘরে। পৃথিবীর নামি-দামি ক্রীড়া পত্রিকা এমনকি শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গাণিতিক মডেলও বলছে ব্রাজিলের পর বিশ্বকাপ জেতার সর্বাধিক সম্ভাবনা আর্জেন্টিনার।

আমার অভিজ্ঞতা অবশ্য তা বলে না। আমি ১৯৯০ সাল থেকে যে আর্জেন্টিনাকে চিনি তারা ঠেলে-ঠুলে ভাগ্যগুণে, কপালকে টেনে-হিঁচড়ে গোলপোস্ট পর্যন্ত নিয়ে যায়। অনেক সময় সেই কপালই আবার তাদের পেনাল্টির আশপাশে নিয়ে ইয়ার্কি করে ছেড়ে দেয়! এই দলে সবসময় শুনি অনেক বড় বড় তারকা খেলে। কিন্তু আমি কখনই একজন, দুজন কিংবা সর্বোচ্চ তিনজনের বেশি আর্জেন্টাইন খেলোয়াড়কে বিশ্বকাপে ভালো খেলতে দেখিনি। সেই ম্যারাডোনা, কেনিজিয়া, বাতিস্তুতা, ওর্তেগা, মেসি এদেরই পুরা দলকে টানতে হয়। যে ডি মারিয়া, এগুয়েরো, ক্রেস্পো, পাসারেলা, মাচেরানো, আয়ালা, তেভেজ নিয়ে এত মাতামাতি হতো, তাদের কাউকে আমি বিশ্বকাপে দলের পক্ষে খুব ভালো খেলতে দেখিনি।

হয়ত টেনেটুনে একটা কিংবা দুটো গোল দিয়ে একটা ম্যাচ জিতিয়ে দিল, পাঁচ-সাতটা ভালো পাস দিল অথবা একটা একশ’ মিটারের শক্ত দৌড় দিল প্রতিপক্ষের সব খেলোয়াড়কে কাটিয়ে- ওই পর্যন্তই। এদের যে কারও চেয়ে ব্রাজিলের সাইড লাইনের অনেককে নিজের দলের পক্ষে তুলনামূলক ভালো খেলতে দেখা যায়। আর্জেন্টিনা সেই দল যাদের সঙ্গে নাইজিরিয়া, ওমান, জাপান এমনকি সৌদি আরবের খেলা থাকলেও ভয় লাগে যদি হেরে যায়! প্রতি বিশ্বকাপে টেনেটুনে প্রথম, দ্বিতীয় রাউন্ড পার হয়। তারপর আমাদের হৃৎপিণ্ডের গতি বাড়তে থাকে। মনের মধ্যে আশার সঞ্চার হয়।

ভাবতে শুরু করি সেই ১৯৮৬ সালের পর আরেকবার কাপ জিততে পারবে কি! কোয়ার্টার ফাইনাল কিংবা সেমিফাইনালে কোনোমতে একটা গোল করলে ভক্তরা দোয়া দরুদ শুরু করে, যাতে সবেধন নীলমণি একটা গোল দিয়েই পুলসিরাতের পুলটা পার হয়ে জয়ের বন্দরে পৌঁছে যাওয়া যায়। ম্যারাডোনা এবং মেসির পর আর্জেন্টিনা দলকে সবসময় সবচেয়ে বেশি নির্ভর করতে হয়েছে তাদের দলের গোলরক্ষকের ওপর। একের পর এক বিপক্ষ দল আক্রমণ করতে থাকে। আর বেচারা গোলরক্ষক জান-প্রাণ দিয়ে সেগুলো ঠেকিয়ে দলকে পরবর্তী রাউন্ডে পৌঁছে দেয়। আর্জেন্টাইন ফরোয়ার্ডরা মাঠে ৬০ শতাংশ সময় বল দখলে রাখলেও ডি বক্সের ভেতরে আর ঢুকতে পারে না।

ডি বক্সের ঠিক বাইরে দলের আট-নয় জন খেলোয়াড় নিয়ে তারা অন্ততকাল ধরে বল ড্রিবলিং আর পাস করতে করতে একসময় বলের দখল হারিয়ে ফেলে। তবুও আর্জেন্টিনা কিভাবে যেন অনেক ম্যাচই জেতে। র‌্যাংকিংয়ের ওপরের দিকেই থাকে। আমি মনে করি আর্জেন্টিনা আমার কাছে অনেকটা ধর্মের মতো। ধর্মের পক্ষে যেমন কোনো যুক্তি খুঁজে পাওয়া কঠিন কিন্তু মৃত্যুর পর কী হবে কেউ জানে না বলে একটা কিছু আগলে রাখতে হয় কিছু একটা প্রাপ্তির আশায়! আর্জেন্টিনাকে সমর্থন করাও অনেকটা ওরকম। গোলরক্ষকের দক্ষতায়, ম্যারাডোনা বা মেসি নামের ঈশ্বরের কৃপায় বা ওই যে অদেখা অজানা উপরওয়ালার দয়ায় জিতে জিতে এগিয়ে যাওয়া। সেখানেও ঝামেলা।

এবারের বিশ্বকাপের এখন পর্যন্ত দুটো খেলা দেখেও তাই মনে হলো। সেই মেসির দু’এক মুহূর্তের জাদুতে হয় নিজে গোল দিয়ে অথবা অন্যকে দিয়ে গোল দেয়ানো। ডি মারিয়া জানপ্রাণ দিয়ে খেলেছে। কিন্তু বলটা নিয়ে গোল দেওয়ার মতো কেউ নেই। সৌদি আরবের সঙ্গে খেলার দিন জেতার জন্য সৌদি আরবকে কৃতিত্ব দিতে হবে। তারা ভালো দল হিসেবেই জিতেছে। মেক্সিকোর সঙ্গে খেলায় আর্জেন্টিনা মেসি আর ফার্নান্দেজের দুর্দান্ত দুই গোলে জিতেছে বটে। কিন্তু পুরো খেলায় গোল দিতে সংগ্রাম করেছে। এদিকে ব্রাজিল দল খেলেছে দুর্দান্ত প্রতাপে। সঙ্গে সঙ্গে দক্ষতা দেখিয়েছে ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, স্পেনও। জার্মানি যদিও বাদ পড়ার দ্বারপ্রান্তে। তবুও তাদের এই অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়াবার যোগ্যতা আছে।

মনে হয় আমার যে personality trait, তাতে করে আমি রহফরারফঁধষ পযধৎরংসধ’র ভক্ত। পারসোনালিটি ট্রেইট হচ্ছে সেই জিনিস যেটা নির্ধারণ করে একজন ব্যক্তির চিন্তা-ভাবনা, অনুভূতি, ব্যক্তিত্ব, ব্যবহার কী ধরনের হয়। আমার কাছে ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্য, দক্ষতা খুব গুরুত্বপূর্ণ। যে কারণে ব্যক্তিকেন্দ্রিক সমাজ, রাষ্ট্র, নেতৃত্ব, ব্যবস্থাপনা আমার পছন্দ। হয়ত সে কারণেই দল হিসেবে প্রতিবার ধুঁকতে থাকা আর্জেন্টিনাকে পছন্দ করি শুধু ম্যারাডোনা বা মেসির অসামান্য, অবিশ্বাস্য, অমানবিক ফুটবল খেলার দক্ষতার কারণে। দল হিসেবে যে কোনো দিন বলতে পারি আর্জেন্টিনার চেয়ে ব্রাজিল, জার্মানি, ইংল্যান্ড অনেক ভালো।

কিন্তু এটাও নির্দ্বিধায় বলতে পারি যে, একজন ম্যারাডোনা কিংবা মেসির সমমানের খেলোয়াড় নেই। যে কারণেই আর্জেন্টিনাকে সমর্থন করি না কেন, করি- এতটুকু জানি। তাদের সমর্থন করেন আমার মতো কোটি কোটি মানুষ। এই ‘কেমন যেন একটা এলোমেলো’ দল নিয়েও পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ফুটবল সমর্থক আর্জেন্টিনা দলের। ১৯৭৮ সাল থেকে আর্জেন্টিনা দলকে নেতৃত্ব দিয়ে এসেছেন ম্যারাডোনা ও মেসির মতো সর্বকালের সেরা দুই খেলোয়াড়। ম্যারাডোনা মারা গেছেন, মেসিরও এটাই শেষ বিশ্বকাপ। ফুটবলের ঈশ্বরদের সহায়তা ছাড়া ১৯৭৮ সালের পর প্রথম বিশ্বকাপে নামবে আর্জেন্টিনা ২০২৬ সালে। আর্জেন্টিনা কি পারবে এদের ছাড়া বিশ্ব ফুটবলে আধিপত্য জারি রাখতে? কে জানে!
খুব সাদাসিধেভাবে সত্য বিশ্লেষণ করে গেলাম। জীবনে এই পর্যায়ে এসে নিজের দল সম্পর্কে এই কথাগুলো যে নির্দ্বিধায় বলতে পারি, এটাই আমার আনন্দের জায়গা। ভালোবাসার জন্য বিশ্বের সেরাটাকেই বেছে নিতে হবে এমন কোন কথা নেই। বরং খুব সাধারণকেও ভালোবেসে সর্বোচ্চ স্থানে নিয়ে যাওয়া- এই আত্মত্যাগেই ভালোবাসার আনন্দ। ভালোবাসি আর্জেন্টিনা, ভালোবাসি মেসি।
টরন্টো
২৮ নভেম্বর ২০২২

×