ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

বিপ্লব ঘটাতে হবে কম্পিউটার উৎপাদনে-৩

মোস্তাফা জব্বার

প্রকাশিত: ২১:৩৩, ২৭ নভেম্বর ২০২২

বিপ্লব ঘটাতে হবে কম্পিউটার উৎপাদনে-৩

.

বাংলাদেশ মোবাইল ফোন ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের মতে, গত পাঁচ বছরে দেশে মোবাইল ফোনের দাম ১৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। পাশাপাশি সংখ্যার দিক থেকে মোবাইল বিক্রির হার বেড়েছে শতকরা ৮ভাগ। আমদানি করা মোবাইলের তুলনায় স্থানীয় উৎপাদিত হ্যান্ডসেটের মূল্য শতকরা ৩৫ ভাগ কম বলে অ্যাসোসিয়েশনের নেতৃবৃন্দ স্থানীয় উদ্যোক্তাদের ধন্যবাদ জানান।
মোবাইল হ্যান্ডসেট উৎপাদন কারখানাসমূহে কিছু সংখ্যক বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী এবং শীর্ষ কয়েকজন কর্মকর্তা ছাড়া প্রায় সকল বাংলাদেশী কর্মচারী দ্বারা এই সকল কারখানায় উৎপাদন প্রক্রিয়া দক্ষতার সঙ্গে পরিচালিত হচ্ছে। স্যামসাংয়ের স্থানীয় পার্টনার ফেয়ার ইলেকট্রনিক্সের  প্রধান বিপণন কর্মকর্তা মোহাম্মদ মেসবাহ উদ্দিন বলেছেন, তারা  এ পর্যন্ত এক হাজার দুইশত পঞ্চাশ জনকে নিয়োগ করেছে এবং ২০২২ সালের মধ্যে আরও এক হাজার লোক তারা নিয়োগ করবে। বাংলাদেশে ২০১৯ সালে মোবাইল হ্যান্ডসেট উৎপাদন প্লান্ট চালু করে গ্রামীণ ডিস্ট্রিবিউশন। প্রতিষ্ঠানটি প্রতি মাসে তিন লাখ ফোনসেট উৎপাদনে সক্ষম। গাজীপুরের বোর্ডবাজারে প্রতিষ্ঠিত কারখানাটিতে ৬৫০ কর্মী রয়েছে। ২০২২ সালের মধ্যে কারখানাটি দ্বিগুণ উৎপাদনের পরিকল্পনা রয়েছে।

এই লক্ষ্যে কারখানাটিতে সমান সংখ্যক কর্মচারী বাড়ানো হবে বলে গ্রামীণ ডিস্ট্রিবিউশনের নির্বাহী ভাইস চেয়ারম্যান আশরাফুল হাসান জানান। বেস্ট টাইকুন (বিডি) এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড কোম্পানির অধীনে ভিভো ২০১৯ সালে বাংলাদেশে হ্যান্ডসেট উৎপাদন করা শুরু করে। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে প্রতিষ্ঠিত কারখানায় বাংলাদেশে বিক্রি হওয়া হ্যান্ডসেটের ৯৯ শতাংশ উৎপাদন করছে। কোম্পানিটির সিনিয়র ম্যানেজার ইমাম উদ্দিন বলেন, ভিভো কারখানাটিতে ১২০০ কর্মী কাজ করছে।
আগামী বছরের মধ্যে আরও এক হাজার লোকের নিয়োগ দেবে তারা। সিম্ফনি হ্যান্ডসেট নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এডিসন ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড প্রতিমাসে ৫ লাখের বেশি ফোন উৎপাদন করছে। আশুলিয়াতে প্রতিষ্ঠিত আট লাইনের প্লান্টটিতে ১২শ’ লোক কাজ করে। কোম্পানির  এমডি জাকারিয়া শহিদ বলেন, আমরা স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত ফোন রপ্তানি শুরু করার কারণে আমাদের জনবল আরও বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে।
গাজীপুরের চন্দ্রায় ওয়ালটন ডিজি- টেক ইন্ডাস্ট্রিজের প্লান্ট প্রতি মাসে ৫ লাখ ফোন তৈরি করে। এই প্লান্টটিতে ২ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। কোম্পানিটি ২০২২ সালের ভেতর প্রতিমাসে ২০ লাখ ফোন উৎপাদন করবে এবং আরও এক হাজার লোককে নিয়োগ প্রদানের পরিকল্পনা রয়েছে তাদের।
সম্প্রতি  নোকিয়া ও শাওমি বাংলাদেশে  মোবাইলসেট  উৎপাদন শুরু করেছে এবং তারা এক সঙ্গে ৫ শ’ জনকে নিয়োগ দিয়েছে। মোবাইলসেটের স্থানীয় উৎপাদন ও সংযোজন দেশের তরুণদের উন্নত প্রযুক্তিতে দক্ষতা তৈরির সুযোগ সৃষ্টি করেছে। বেস্ট টাইকুনের কর্মকর্তা ইমাম বলেন, উৎপাদন লাইনে কর্মরত কর্মীদের শিক্ষাগত সনদের প্রয়োজনীয়তা এইচএসসি থেকে শুরু হয়। তবে এই ক্ষেত্রে ইলেক্ট্রনিক্সে ডিপ্লোমাদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। লাইন ম্যানেজার থেকে ইউনিট ম্যানেজার পদে পদোন্নতি পেতে বিএসসি ডিগ্রি প্রয়োজন। তাদের ম্যাটেরিয়াল ম্যানেজমেন্ট এক্সিকিউটিভ এবং কোয়ালিটি কন্ট্রোল ম্যানেজারের পদেও পদায়ন করা যায়। বেশির ভাগ কর্মী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপ্লোমা প্রকৌশলী। নিয়োগের পর তারা সাধারণত ইন-হাউস প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে থাকেন। অনেককে উন্নত প্রশিক্ষণের জন্য বিদেশেও পাঠানো হয় বিশেষ করে চীনে।
গ্রামীণ ডিস্ট্রিবিউশনের হাসানের মতে, কারখানা প্রতিষ্ঠার আগে তারা ডিস্ট্রিবিউটর হিসেবে চীন থেকে যখন ফোনসেট ক্রয় করেছিলেন, তখন ত্রুটিজনিত কারণে দুই পার্সেন্ট ফোন ফেরত পাঠাতে হতো। এখন স্থানীয়ভাবে সংযোজিত ফোনের এক শতাংশ ত্রুটিপূর্ণ বলে প্রমাণিত হয়েছে। এটি প্রযুক্তি গ্রহণে স্থানীয় কর্মচারীদের দক্ষতারই উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এখন গ্রাহক সন্তুষ্টিও আগের তুলনায় বেশ ভালো।
মোবাইল ফোন উৎপাদনে তিনটি প্রধান উপাদান জড়িত, এগুলো হচ্ছে ডিসপ্লে, চিপসেট এবং ব্যাটারি। এই তিনটি উপাদান সবচেয়ে ব্যয়বহুল। বাংলাদেশের কোনো কোম্পানি এগুলো উৎপাদন করে না। বিশ্বের মাত্র কয়েকটি দেশ তাইওয়ান, চীন এবং দক্ষিণ কোরিয়া এগুলো উৎপাদন করে। স্যামসাং, বিওই টেকনোলজি এবং এলজির মতো কয়েকটি  কোম্পানিও ডিসপ্লে তৈরি করে। সংশ্লিষ্ট শিল্পসংশ্লিষ্টরা বলছেন, কিছু বাংলাদেশী কোম্পানি দাবি করছে যে তারা ব্যাটারি তৈরি করছে, আসলে তা সত্য নয়। তারা কেবল কাঁচামাল (লিথিয়াম-আয়ন) আমদানি করে এবং সেটি কেটে শুধু নিজেদের নামে লেভেল পরিয়ে দেয়। ফেয়ার ইলেক্ট্রনিক্সের মেসবাহ বলেন, ফোন ব্যবহারকারীর দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বের নবম বৃহত্তম দেশ কিন্তু বেশিরভাগ গ্রাহক কম দামের ফোন ব্যবহার করেন। মেসবাহ বলেন, বাংলাদেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতার সক্ষমতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ডিসপ্লে, ব্যাটারি এবং চিপসেটের কারখানাও গড়ে উঠবে। প্রতিবেদনে এসব প্রসঙ্গ আলোচিত হয়নি যে, বাংলাদেশের অনেক উৎপাদক এখন মোবাইলের মাদারবোর্ড, ব্যাটারি, কেসিং ও র‌্যামসহ অনেক প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ নিজেরাই উৎপাদন করে।
২২ সালের এপ্রিল মাসে আরও দি বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকা কেমন করে বাংলাদেশ মোবাইল উৎপাদনের হাবে পরিণত হয়, সেই বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
মাত্র পাঁচ বছরে দেশে ফোন ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্ডাস্ট্রি বিশাল আকার ধারণ করেছে; অথচ একসময় এ বাজার ছিল পুরোপুরি আমদানিনির্ভর। মোবাইল ফোন ছাড়া আমরা এখন একটিদিনও ভাবতে পারি না। কিন্তু ২৫ বছর আগেও এর অস্তিত্ব ছিল না। গত দুই যুগে এ যন্ত্রটি আমাদের জীবনের সঙ্গে যেভাবে মিশে গেছে সম্ভবত পৃথিবীর আর কোনো উদ্ভাবন এত বিকশিত হয়নি।
কেবল যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যমই নয়, মোবাইল এখন আমাদের নিত্যদিনের বিনোদন, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা, চাকরি-বাকরি এমনকি গবেষণার হাতিয়ারও। নানা প্রয়োজনে আমাদের জীবনের অপরিহার্য অংশ হওয়ার পাশাপাশি মোবাইল ফোন উৎপাদন-বিক্রি, সেলফোন সার্ভিস, মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসসহ কয়েক লাখ কোটি টাকার বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করছে এ পণ্যটি। দেশে বছরে শুধু হ্যান্ডসেটের বিক্রিই ১৫ হাজার কোটি টাকার বেশি বলে জানিয়েছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ মোবাইল ফোন ব্যবসায়ী সমিতির (বিএমবিএ) তথ্যমতে, দেশে বর্তমানে ১২-১৩টি (১৪টির বেশি) কোম্পানি ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ করেছে মোবাইল ফোন উৎপাদনে। এসব কোম্পানির উৎপাদন সক্ষমতা ৪ কোটি ইউনিটের বেশি। নতুন বিনিয়োগ নিয়ে উৎপাদনের অপেক্ষায় রয়েছে কেউ কেউ। আর কারখানা ও বিপণন মিলিয়ে কর্মসংস্থান এক লাখের বেশি মানুষের।
বিএমবিএ সভাপতি মো. নিজাম উদ্দিন জিতু বলছেন, মোবাইল ফোন উৎপাদন ও বিক্রিতে দেশে যে একটি বাজার  তৈরি হয়েছে শুধু তাই নয়, গ্রাম থেকে শহর পুরো ষোলো কোটি মানুষের জীবন পাল্টে দিয়েছে এ যন্ত্রটি। শুধু হ্যান্ডসেট ইন্ডাস্ট্রি নয়, মোবাইল ফোন এখন মানুষের প্রতিটি কাজেই অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।
মাত্র ২৫ বছরের ব্যবধানে পুরো পৃথিবীর লাইফস্টাইল পাল্টে দেওয়া মোবাইল ফোন বাংলাদেশে প্রথম চালু হয় ১৯৯৩ সালের এপ্রিল মাসে। হাচিসন বাংলাদেশ টেলিকম লিমিটেড (এইচবিটিএল) ঢাকা শহরে এএমপিএস মোবাইল প্রযুক্তি ব্যবহার করে মোবাইল ফোন সেবা শুরু করে। এর আগে বিশ্বব্যাপী মোবাইল ফোনের প্রথম বাণিজ্যিক সংস্করণ বাজারে আসে ১৯৮৩ সালে। ফোনটির নাম ছিল মোটোরোলা ডায়না টিএস ৮০০০এক্স।
১৯৯০ সাল থেকে ২০২১ সালের মধ্যে পৃথিবীব্যাপী মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১২৪ মিলিয়ন থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৭ বিলিয়ন ছাড়িয়ে গেছে। আর এ বছরের শেষে ৭৩ বিলিয়নে পৌঁছাবে বলে ধারণা করা হয়। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও সবচেয়ে প্রয়োজনীয় যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে মোবাইল ফোন সংযোগের সংখ্যা ১৮ কোটি ছাড়িয়েছে। বিপুল এ গ্রাহকের সংযোগে ৪৫ কোটি হ্যান্ডসেটের জোগান দিতে গড়ে উঠেছে ১৫ হাজার কোটি টাকার হ্যান্ডসেটের বাজার। দেশে কারখানা গড়ে উঠেছে স্যামসাং, নোকিয়া, ওয়ালটন, সিম্ফনি, টেকনো, ভিভো, শাওমি, অপ্পোসহ ১২-১৩টি ব্র্যান্ডের। তারা জোগান দিচ্ছে মোট ৯০ শতাংশের বেশি হ্যান্ডসেট। দেশের বড় শিল্পগ্রুপ ফেয়ার ইলেকট্রনিক্স, ওয়ালটন, এডিসনের পরে নতুন করে বাজারে আসছে প্রাণ আরএফএলও।
২৬ নভেম্বর ২০২২


লেখক :  তথ্যপ্রযুক্তিবিদ,  কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান- সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যার এবং বিজয় ডিজিটাল শিক্ষা সফটওয়্যারের উদ্ভাবক, ডিজিটাল প্রযুক্তির অনেক ট্রেডমার্ক, প্যাটেন্ট ও
কপিরাইটের স্বত্বাধিকারী
[email protected]

www.bijoyekushe.net.bd

×