ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

আশার আলো ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ’ তহবিল

অলোক আচার্য

প্রকাশিত: ২১:৩৮, ২৫ নভেম্বর ২০২২

আশার আলো ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ’ তহবিল

.

প্রতি বছরই জলবায়ু সম্মেলন ঘিরে পরিবেশবাদীসহ প্রত্যেকের একটি আশা থাকে। বিশেষত উন্নয়নশীল ও দরিদ্র দেশগুলো যারা উন্নত দেশের ব্যাপক শিল্পায়নের ফলে সৃষ্ট উষ্ণতা বৃদ্ধির ফল ভোগ করছে। আমাদের দেশেও এ ধরনের সমস্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বহুদিন ধরেই এই ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য একটি তহবিল গঠন এবং ক্ষতিপূরণের জোর দাবি রয়েছে। যা সদ্য শেষ হওয়া সম্মেলনে আশার আলো দেখেছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত গরিব দেশগুলোকে ক্ষতিপূরণ দিতে ঐতিহাসিক ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ’ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। চুক্তিটি মূলত জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় গরিব দেশগুলোকে সহায়তায় একটি তহবিলের প্রয়োজনীয়তার প্রতি ইতিবাচক পদক্ষেপ। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে পৃথিবীজুড়েই ব্যাপক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। ফলে এ বিষয়টি সম্মেলনে জোর আলোচনায় আসে। এ বছর স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদে জাতিসংঘের ২৫তম জলবায়ু সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পৃথিবীর প্রতিটি দেশই কম-বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর ভেতর বাংলাদেশ রয়েছে চরম ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে। গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের চতুর্থ ন্যাশনাল ক্লাইমেট অ্যাসেসমেন্ট প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র শত শত কোটি ডলার খরচ করলেও লাগামহীন জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশটির মানুষের স্বাস্থ্য ও জীবনযাত্রা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে হুমকির মুখে পড়বে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ঐতিহাসিক হারে কার্বন নিঃসরণ অব্যাহত থাকলে চলতি শতাব্দীর শেষ নাগাদ কয়েকটি অর্থনৈতিক খাতে বার্ষিক ক্ষতির পরিমাণ শত শত কোটি মার্কিন ডলারে পৌঁছাবে। এই ক্ষতির পরিমাণ বহু রাজ্যের জিডিপির চেয়েও বেশি। ক্ষতির প্রকারে পার্থক্য থাকলেও বৃহৎ অর্থনীতির দেশগুলোও রয়েছে চরম ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে।

জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাবের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ দিক সম্প্রতি গবেষকরা জানিয়েছেন। তারা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সংশ্লিষ্ট এলাকার নারীদের গর্ভের সন্তান মারা যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। কারণ হিসেবে বলছেন, মাটিতে বাড়ছে লবণাক্ততার পরিমাণ। ফসল নষ্ট হচ্ছে, মরে যাচ্ছে মিঠা পানির মাছ, কমে যাচ্ছে বিশুদ্ধ খাবার পানি। সেই লবণাক্ত পানি পানের কারণেই বাড়ছে রোগ আর গর্ভের সন্তান মৃত্যুর ঝুঁকি। প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নে এই সম্মেলনে কতদূর অগ্রসর হতে পারবে তা নিয়েই থাকবে প্রধান আলোচনা।
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০০৫ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়েছিল প্রতি এক লাখ মানুষের মধ্যে গড়ে ১১৪৭ জন। এ সংখ্যা এখন প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। ২০১২ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত দুর্যোগের শিকার হয়েছে প্রতি এক লাখে ২০৬৬ জন। তবে একই সময়ে দুুর্যোগের কারণে মৃত্যু ও নিখোঁজের সংখ্যা কমেছে। সম্প্রতি পাকিস্তানে বন্যায় এক-তৃতীয়াংশ পানিতে ডুবে যায় এবং ব্যাপক মানুষের প্রাণহানি ঘটে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকট এখন পৃথিবীর জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি। কার্বন নিঃসরণ কমানো ছাড়া বিকল্প পথ নেই। ফলে প্যারিস জলবায়ু চুক্তি বাস্তবায়নে সারাবিশ^ একমত। তবে এই চুক্তি থেকে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্তের যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপ বিশ^বাসীকে হতাশ করেছে। এই পদক্ষেপ এমন এক সময় নেয়া হলো যখন পৃথিবী মারাত্মক পরিণতির জন্য অপেক্ষা করছে এবং মানুষ যে কোনো উপায়ে এই হুমকি মোকাবিলা করার প্রস্তুতি নিতে চলেছে। অথচ যুক্তরাষ্ট্রও জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের জন্য দায়ী। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা প্রশাসন ২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রকে এই চুক্তির অন্তর্ভুক্ত করেছিল। এদিকে ঠিক একই সময়ে বিজ্ঞানীরা সতর্ক করে বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনে পৃথিবী অবর্ণনীয় দুর্দশার মুখোমুখি হতে যাচ্ছে। ৪০ বছরের তথ্য-উপাত্ত নিয়ে বায়োসায়েন্স ম্যাগাজিনে প্রকাশিত একটি গবেষণার চিত্রে বিজ্ঞানীরা এমন তথ্য তুলে ধরেছেন। বিজ্ঞানীরা টেকসই ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে আমাদের জীবনযাপনের ধরনে পরিবর্তন আনতে পরামর্শ দিয়েছেন। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব কমাতে তারা ছয়টি পদক্ষেপ নেয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন। জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের পরিবর্তে নবায়নযোগ্য কম কার্বন নিঃসরণের জ্বালানি ব্যবহার বিশেষ করে মাংসের প্রতি আসক্তি কমিয়ে উদ্ভিজ্জ খাদ্য গ্রহণ, কার্বনমুক্ত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা তৈরি এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার নিয়ন্ত্রণ করা। আমরা বাস্তবিকপক্ষে খুব দ্রুত গতিতে বিপদে পড়তে যাচ্ছি। এর থেকে প্রতিরোধের উপায় জানা থাকলেও কাজটি একক নয় বরং সামগ্রিক। ফলে এটি দীর্ঘায়িত প্রক্রিয়া।

গ্রেটা থুনবার্গ নামটি আজ সারাবিশ্বে পরিচিত। জলবায়ু নিয়ে এই একটি মেয়ের বক্তব্য, বিশ্ব নেতাদের প্রতি চাওয়া এবং সাহসী ভূমিকার জন্য সে সারাবিশে^ পরিচিত হয়েছে। কেবল গ্রেটা থুনবার্গ নয়, বরং নতুন প্রজন্মে সবাই চায় একটি নিরাপদ বিশ্ব গড়তে এবং নিরাপদ বিশ্ব আমাদের ভবিষ্যতের জন্য রেখে যেতে। জাতিসংঘের জলবায়ু বিষয়ক সম্মেলনে সুইডেনের কিশোরী গ্রেটা থুনবার্গের ভাষণ বিশ্ব নেতাদের অন্তর নাড়িয়ে দিতে সক্ষম হলেও তাতে আদৌ অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায় না। যে প্রজন্ম আন্দোলন করে যাচ্ছে একটি সুন্দর পৃথিবীর জন্য। একটি দূষণমুক্ত নিরাপদ পৃথিবীর দাবি আজ সবার। বিশ্ব নেতাদের কাছে এটাই চাওয়া। জলবায়ু নিয়ে বিভিন্ন সময়ে সম্মেলনের বহু সিদ্ধান্ত এসেছে। কিন্তু আমরা তার বাস্তবায়ন এবং প্রভাব দেখেছি খুবই কম। শিল্পের যাঁতাকলে পৃথিবীর অবস্থা আজ অত্যন্ত দুর্বিষহ। দেশগুলোর মধ্যে শিল্পোন্নত দেশ জার্মানি জলবায়ু সুরক্ষা তহবিলে বরাদ্দ দ্বিগুণ করার ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো উল্লেখযোগ্য কিছু দেশ এখানে অংশগ্রহণও করেনি। জলবায়ু পরিবর্তনের দায় কেউ এড়াতে পারে না। কিন্তু কেবল উন্নয়নের দোহাই দিয়ে পৃথিবীর অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলে তা থেকে পরিত্রাণের উপায় না খোঁজাটা বড় ধরনের বোকামি।
পরিবেশের বিরূপ অবস্থার সঙ্গে লড়াই করার মতো পর্যাপ্ত সামর্থ্য আমরা এখনো অর্জন করতে পারিনি। তবে পরিস্থিতি কিছুটা উন্নত করতে পেরেছি। সম্প্রতি ঘূর্ণিঝড় বুলবুল আমাদের দেশে আঘাত হানার পর আমরা দক্ষভাবে পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে পেরেছি। কিন্তু বুলবুলের চেয়েও অধিক শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়তো ভবিষ্যতে আঘাত হানতে পারে। আমাদের সেদিনের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। বিগত বছরগুলোতে আইলা বা সিডর বা নার্গিসের মতো প্রলয়ঙ্করী প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতির দিকে তাকালে সহজেই আমরা তা অনুমান করতে পারি। বিভিন্ন সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিভিন্ন সময় প্রচুর মানুষ মারা গেছে। ১৯৭০ সালে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় ১০ লাখ লোক মারা গিয়েছিল। আর পার্শ্বক্ষয়ক্ষতি তো ছিল আরও ভয়ঙ্কর। ১৯৯১ সালের ঝড়ে প্রায় দেড় লাখ লোক নিহত হয়েছিল। তাছাড়া ১৯৮৮, ১৯৯৮ সালের বন্যাতেও যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। আর কয়েক বছর ধরে সবচেয়ে বড় আতঙ্কের নাম ভূমিকম্প। যা মোকাবিলা করার শক্তি আমাদের একেবারেই অপর্যাপ্ত। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে পৃথিবী প্রাণীকুলের বসবাসের অনুপযুক্ত হয়ে পড়ছে। টিকে থাকা রীতিমতো হুমকিতে পরিণত হচ্ছে। জলবায়ু স্বাভাবিক মাত্রায় ফিরিয়ে আনতে এবারের জলবায়ু সম্মেলন ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং বিশ্ব তাকিয়ে ছিল। ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য তহবিল গঠন এক্ষেত্রে বিশাল অর্জন।  

লেখক : শিক্ষক
[email protected]

×