ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

নোবেলের দেশ থেকে

বিশ্ববাজারে পাটের শপিং ব্যাগ

দেলওয়ার হোসেন

প্রকাশিত: ২০:৩৩, ৩ নভেম্বর ২০২২

বিশ্ববাজারে পাটের শপিং ব্যাগ

পাটকে আমাদের দেশে এক সময় বলা হতো সোনালি আঁশ

পাটকে আমাদের দেশে এক সময় বলা হতো সোনালি আঁশ। কৃষকের উৎপাদিত কৃষিপণ্যের মধ্যে তা ছিল এক মূল্যবান অর্থকরী ফসল। বিক্রি হতো চড়া দামে। দেশের প্রধান কয়েকটি রপ্তানি পণ্যের মধ্যে ছিল অন্যতম। রপ্তানি হতো নানা দেশে। দেশে একটি বড় অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা আসত এর দ্বারা। তাই এর কদর ছিল সোনার মতো দামি।

এই পাটকে কেন্দ্র করে নারায়ণগঞ্জে গড়ে উঠেছিল এশিয়ার বৃহত্তম পাটকল আদমজী জুট মিল এবং এর বিস্তার ঘটেছিল দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। হয়েছিল হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান। স্বাধীনতা-উত্তরকালে এই শিল্পে নেমেছে ধস। কৃষকের মাথায় পড়েছে হাত। কৃষকের কৃষিপণ্যের তালিকা থেকে প্রায় উঠে যেতে বসেছিল পাট চাষ। পাটের আবাদ হারিয়েছিল সোনালি অতীত।
সেই সোনালি অধ্যায় আবার কিছুটা হলেও নতুন করে ব্যাপক সম্ভাবনা নিয়ে ফিরে আসতে শুরু করেছে। বাংলাদেশী বিজ্ঞানীদের নিরলস গবেষণার মধ্য দিয়ে পাটের জেনোম সিকোয়েন্স আবিষ্কারের বিরল কৃতিত্ব অর্জনের সাফল্য এক নতুন দিগন্ত উন্মোচনের সুযোগ করে দিয়েছে পাট সেক্টরে। সোনালি আঁশ ফিরে পেয়েছে অতীত গৌরব।

পাট চাষে বিমুখ, এমনকি এই পাট বাজারে বিক্রি করতে না পারা চাষির আত্মহননের পথ বেছে নেয়ার মতো সেই দুরবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে বর্তমানে। বৈশ্বিক বাজারে পাটের চড়া মূল্য কৃষককে আবার পাট চাষে করে তুলেছে ব্যাপক উৎসাহী। আমাদের বিজ্ঞানীরা বিশ্ব পরিবেশ ধ্বংসকারী পলিথিনের ব্যবহারের বিকল্প পরিবেশবান্ধব পাটের শপিং ব্যাগ উদ্ভাবন করে বাংলাদেশের জন্য খুলে দিয়েছেন অপার সম্ভাবনার এক নতুন দিগন্ত।
কিছুদিন আগে দেশে বহুমুখী পাটপণ্যের মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে পাটমন্ত্রী বলেছেন, এখন পর্যন্ত ২৮২ ধরনের পাটজাত পণ্য তৈরি হচ্ছে দেশে। মেলায় বহুমুখী পাটপণ্যের উৎপাদনরত উদ্যোক্তা ৩৩টি প্রতিষ্ঠান দেশে উৎপাদিত ২৮২ ধরনের পাটপণ্যের প্রদর্শন করে। দেশে উৎপাদিত ২৮২ ধরনের পাটজাত পণ্যের অধিকাংশই বিদেশে রপ্তানি করা হচ্ছে।

রপ্তানির সম্ভাবনা আরও বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। এর ফলে জাতীয় অর্থনীতিতে এই খাতটি এক অসামান্য অবদান রাখছে। পরিবেশ বিপর্যয়ের এই যুগে পরিবেশবান্ধব পাট ও পাটজাত পণ্যের বিশ্বব্যাপী অফুরন্ত চাহিদা বাংলাদেশের উন্নতমানের পাটের হারানো ঐতিহ্যকে পুনরুদ্ধার এবং সমৃদ্ধিশালী করার ক্ষেত্রে এক অনন্য ভূমিকা পালন করতে সক্ষম।
কিন্তু এর জন্য বহুমুখী পাটজাত পণ্যকে দেশে এবং বিদেশে জনপ্রিয় ও নির্ভরশীল করে তোলার জন্য ব্যাপক প্রচারসহ মেলার আয়োজন করার বিকল্প নেই।

উৎপাদনকারী, বিপণনকারী এবং বিদেশী ক্রেতাদের মধ্যে নিবিড় যোগাযোগ, সমন্বয় স্থাপন করা না গেলে সফলতা আসবে না। কিন্তু তেমন উদ্যোগ ও প্রচার চোখে পড়ছে না। এ প্রসঙ্গে সুইডেনের বিদায়ী রাষ্ট্রদূতের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলাম। তিনি জানিয়েছিলেন, এ বিষয়ে তিনি বহুদূর এগিয়েছেন, কিন্তু ফল কী জানা যায়নি। দূতাবাসগুলোতে বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য সংক্রান্ত যে কোনো বিষয়ে জানতে চাইলে এমন ইতিবাচক জবাব পাওয়া যায়। তবে বাস্তবে ফল দেখা যায় না।

বিদেশের মাটিতে যোগ্য ও করিতকর্মা প্রতিনিধি নিয়োগ করা হলে তারাই রাষ্ট্রের উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা পালন করতে পারেন। বদলে দিতে পারেন রাষ্ট্রের অর্থনীতি। একটি রাষ্ট্রের বাইরে তারা বিপুল সংখ্যায় বহুমাত্রিক প্রতিষ্ঠান। ব্যাপক তাদের কর্মকা-ের পরিধি। সেই মহৎ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে মাথায় নিয়েই বিদেশের দূতাবাসের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাষ্ট্রের অকল্পনীয় ব্যয়ভার বহন করে টিকিয়ে রাখতে হয়। কিন্তু সেই ব্যয়ের তুলনায় রাষ্ট্রের অর্জন কী তা কজনইবা জানে?
১ কোটি ৫ লাখ, ৪৯ হাজার ৩৪৭ জন অধিবাসীর দেশ সুইডেন। সেই বিচারে বিশ্ববাজারের দিক থেকে বাণিজ্যের প্রেক্ষাপটে একটি ক্ষুদ্র দেশ হলেও ভোক্তার চাহিদার দিকটি মোটেও নগণ্য নয়, যদি দেশটিকে নর্ডিক সীমানার মধ্যে জুড়ে দেয়া হয়।

আয়তনের দিক থেকে পৃথিবীর ৭ম বৃহৎ ভৌগোলিক সীমানার (১.৩২ মিলিয়ন বর্গমাইল) মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ ৮টি প্রতিবেশী নর্ডিক দেশ- সুইডেন, নরওয়ে, ফিনল্যান্ড, ওল্যান্ড, ডেনমার্ক, আইসল্যান্ড, গ্রীনল্যান্ড ও ফ্যারো দ্বীপকে যদি ধরা যায় তাহলে এর ২ কোটি ২৬ লাখ জনসংখ্যার বাজারটি ছোট বলে গণ্য করা যায় না। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি স্বাস্থ্য ও পরিবেশবান্ধব মননের সচেতন এই এলাকার মানুষগুলো জীবনযাপনে স্বাস্থ্যঝুঁকি ও স্বাস্থ্য রক্ষার বিষয়টিকে দেয় সর্বাধিক প্রাধান্য।
ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে জীবনযাপনে বিপদের হাত থেকে মুক্ত থাকার জন্য এই অঞ্চলে পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ করা সম্ভব না হলেও তা ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করার জন্য বিকল্প হিসেবে বাজারে আনা হয়েছে কাগজ, কাপড় ও পচনশীল উপাদান দিয়ে তৈরি পরিবেশবান্ধব ব্যাগ। একই সঙ্গে পলিথিন ও পরিবেশবান্ধব ব্যাগ উৎপাদন ও বিপণনের ওপর ২০২০ সালের মে মাস থেকে আরোপ করা হয়েছে সর্বনি¤œ ১৫-২৫% ট্যাক্স। ইউরোপের অনেক দেশেও বলবৎ হয়েছে এই ব্যবস্থা।

এর ওপর বেড়েছে অকৃপণচিত্তে ব্যাগ না কেনার মতো বাড়তি দাম। আগে অনেক দোকানে পণ্য কেনার সঙ্গে বিনামূল্যে দেয়া হতো শপিং ব্যাগ। বড় বড় চেইন ফুড স্টোরের মতো দোকানগুলোতে ব্যাগের দাম নেয়া হতো এক কিংবা দুই ক্রোনার। এখন তা অতীত। ব্যাগের দাম হয়েছে ৬-৭ ক্রোনার। পত্রিকার রিপোর্টে দেখা গেছে, তখন দোকানগুলোতে এই ব্যাগ বিক্রির আয় থেকে বার্ষিক মুনাফা আসত মিলিয়ম মিলিয়ন সুইডিশ ক্রোনার।

সওদাপাতি কেনার সঙ্গে দুই-এক ক্রোনার দিয়ে শপিং ব্যাগ কেনার বিষয়টা তেমন গায়ে লাগত না কারও। এখন ৭ ক্রোনার (বাংলাদেশী টাকায় কমবেশি ৭০ টাকা) দিয়ে একটি শপিং ব্যাগ কিনতে অনেক ক্রেতার গায়ে লাগে। ৭ ক্রোনারের একটি ব্যাগে এখন কর দিতে হয় ৩ ক্রোনার এবং ভ্যাট ২৫% অর্থাৎ ৭৫ ওরে বা পয়সা।

তাই অনেক ক্রেতাই বাসায় যত্ন করে রাখা ব্যাগটি বারবার ব্যবহারের জন্য রেখে দেন। আগে বাসায় এসে ব্যাগ খালি করে আবর্জনা হিসেবে রিসাইক্লিং কন্টেইনারে ফেলে দেয়া হতো। এখন এই অভ্যাসের পরিবর্তন শুরু হয়েছে। এখন এর ব্যবহার কমানোর উদ্দেশ্যে গৃহীত পদক্ষেপ অনুযায়ী পরিবেশ সচেতন শপারদের পকেটে বা সাইড ব্যাগে এই ব্যাগ মজুদ থাকে। এভাবে পলিথিন ব্যাগের যথেচ্ছ ব্যবহার কিংবা আবর্জনা হিসেবে নিক্ষেপের মাত্রা কমেছে বহুলাংশে।

সুইডেনে প্রতিবছর শপিং ব্যাগ ব্যবহার করা হতো ১০০ কোটি পিস। সারাবিশ্বে হয় এক ট্রিলিয়ন। উৎপাদন হয় ৩০০ ট্রিলিয়ন টন। যার মাত্র ১০% হয় রিসাইকেল। বাকিটা যায় নদী, সাগর, জলাশয়, ভূপৃষ্ঠের মাটিতে। যা ১০০ বছরেও পচে না, মাটির সঙ্গেও মেশে না। ছড়ায় জৈব বিষÑ টক্সিন। নানানভাবে এর ক্ষতির শিকার মানুষ, জীব-প্রাণী, জল, স্থল, প্রকৃতি, উদ্ভিদ জগৎ ও সমুদ্র।
পলিথিন ব্যাগের ওপর ট্যাক্স আরোপ এবং এর দাম বৃদ্ধির ফলে ব্যবহার কমে এসেছে লক্ষণীয় মাত্রায়। ২০১৭ সাল থেকে পলিথিন ব্যবহারে কড়াকড়ি আরোপের পর ২০১৯ সালে প্রতিজন সুইডিশ বছরে গড়ে ৭৪টি পলিব্যাগ কিনত। ২০২০ সালে এসে এর অঙ্ক দাঁড়ায় ৫৫টিতে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের টার্গেট এর সংখ্যা ৪০টিতে। বছরে আমেরিকান নাগরিকরা ব্যবহার করছে গড়ে ৩০০টি পলিব্যাগ।
আরেকটি বিষয়ও উল্লেখযোগ্য। সফট ড্রিংক, চকোলেট জাতীয় খাবারের প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় শিশু-কিশোর, তরুণ-যুবাদের মধ্যে মেদ, ওজন, স্থূলতা ও নানা শারীরিক সমস্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় এসব পণ্যের ওপর বাড়তি করারোপের ফলে বেশ সুফল পাওয়া গেছে। এমনটি হয়েছে সিগারেট ও তামাকের মতো নেশাজাত পণ্যের ক্ষেত্রেও।
এত কথার মূল কথা হলো- আমাদের সামনে একটি বিশাল বিশ্ববাজার আছে। যোগান দেয়ার মতো আমাদের সোনালি সম্পদ- পর্যাপ্ত কাঁচামাল, পাটের প্রাচুর্য আছে। তা দিয়ে শুধু শপিং ব্যাগ নয়, বৈচিত্র্যময় বহু পণ্য তৈরির সুযোগ ও সম্ভাবনা রয়েছে। অপার বাণিজ্যের সম্ভাবনা আমাদের হাতের মুঠোয়। ব্যাপক গবেষণার দিকে মনোযোগ দিলে পাটের যুগান্তকারী বহু আবিষ্কার বিশ্ববাজারে এবং মানবকল্যাণে ব্যবহার উপযোগী পণ্যসামগ্রীর বিস্ময়কর নজির হাজির হতে পারে।

পাট নিয়ে এমন বহুমাত্রিক গবেষণা জার্মানির গবেষণাগারে চলার খবর একটি বিজ্ঞান সাময়িকীতে পড়েছিলাম। পরিধেয় উন্নতমানের কাপড় থেকে শুরু করে অকল্পনীয় সব বিচিত্র সম্ভার উদ্ভাবনের তথ্যবহুল খবর ছিল তাতে। পড়েছি আর নিজের মাথার চুল নিজেই ছিঁড়েছি এই অনুশোচনায় যে, তাহলে আমরা কি করছি? সেদিকে আমাদের দৃষ্টি কতটুকু প্রসারিত? আমরা কেন পাটের সুদূরপ্রসারী অমিত সম্ভাবনার বাজার তৈরি করতে সক্ষম হচ্ছি না? বিশ্ববাজারের যে অফুরন্ত চাহিদা আছে তা উপলব্ধি ও কব্জা করতে পারছি না কেন তা নিয়ে ভাবতে হবে।

অতি সম্ভাবনাময় খাতগুলো নিয়ে কেন দ্রুত অগ্রসর হওয়া যাচ্ছে না? দেশীয় খাতে খোদ বিমান ও রেলের মতো একটি সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ মুখ থুবড়ে পড়ে আছে দূরদর্শী চিন্তা ও উপযুক্ত ব্যবস্থাপনার অভাবে।
একমাত্র গার্মেন্টসের ওপর নির্ভর করে বসে থাকলে চলবে না। এই বাজারের স্থায়িত্ব কতকাল? তুমুল প্রতিযোগিতার বাজারে এক সময় আমরা পিছিয়ে পড়ে হারাতে পারি বিপুল এ বাজার। কাপড় মানুষ প্রতিদিন কেনেন না। কিন্তু শপিং ব্যাগ মানুষ বাজারে গেলেই কেনেন। পরিবেশবান্ধব পাটের ব্যাগের চাহিদা অফুরন্ত। অনেক দেশই বিরামহীন গবেষণায় সফলতা অর্জনের মধ্য দিয়ে পরিবেশবান্ধব ব্যাগ বাজারজাত করায় বাণিজ্যের নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে ইউরোপে।

সময়ের ব্যবধানে এক পর্যায়ে গোটা বিশ্বের মানুষের ঘরে ঘরে সুবিস্তৃত হবে এই চাহিদা। জার্মানির নাম এখানে উল্লেখযোগ্য। সারাবিশ্বে ব্যাপক চাহিদাসম্পন্ন এই পণ্যের স্থায়ী বাজারটি ধরতে পারলে গার্মেন্টসের এই অস্থায়ী বাজারকে পেছনে ফেলে পাটের পণ্য বাংলাদেশকে যে আরেক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে তাতে সন্দেহ নেই। প্রয়োজন শুধু কালবিলম্ব না করে বাজার ধরার জন্য কোমর বেঁধে মাঠে অবিলম্বে নেমে পড়া।

লেখক : সুইডেন প্রবাসী সাংবাদিক
স্টকহোম, ২ নভেম্বর, ২০২২
[email protected]

×