ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশের গণহত্যার স্বীকৃতি

মোঃ সাখাওয়াত হোসেন

প্রকাশিত: ২১:৪২, ৬ অক্টোবর ২০২২; আপডেট: ১৩:৫৮, ৭ অক্টোবর ২০২২

বাংলাদেশের গণহত্যার স্বীকৃতি

বাংলাদেশের গণহত্যার স্বীকৃতি

স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে বিশেষ করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পরে সেনাশাসিত ও স্বৈরশাসিত সরকারগুলো বাংলাদেশ জন্মের ইতিহাসকে ভিন্ন দিকে পরিচালনার ক্ষেত্রে দক্ষতা দেখিয়েছে। তারা ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে জাতির পিতার হত্যাকাণ্ডের বিচারকে চিরতরে বন্ধ করে দিয়েছিল, যারা হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল তাদের বিভিন্নভাবে পুরস্কৃত করেছিল।

বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা রাষ্ট্রক্ষমতায় আসার পরে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারকাজ শুরু হয়, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৭ সালে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে ২৫ মার্চকে জাতীয়ভাবে গণহত্যা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়? ২৫ মার্চ বাঙালী জাতির জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। ২৫ মার্চের নৃশংস হত্যাকা-ের সঙ্গে যারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত তাদের দোসররা এখনও বাংলাদেশে সক্রিয় রয়েছে।

তাদের চরিত্রকে বর্তমান প্রজন্মের সামনে তুলে ধরা দায়িত্বশীলদের অবশ্য কর্তব্য। কেননা, তারা দেশ ও জাতির চিরশত্রু এবং জাতির উন্নতির পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী। ২৫ মার্চের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির বিষয়টিও বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর অনেকাংশে বর্তায়। কেননা, এ দলটিই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেছে এবং এ দলের ওপর সাধারণ মানুষের প্রত্যাশাও অনেক বেশি।  
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাত থেকে ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে কাপুরুষোচিতভাবে বাংলাদেশে গণহত্যা শুরু করে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী। কোন ধরনের পূর্ব ঘোষণা ব্যতিরেকে অতর্কিতে নিরীহ বাঙালীর ওপর হত্যা নির্যাতন শুরু করে পাকিস্তানীরা এবং তাদের এ দেশীয় দোসররা। বর্বর ও পৈশাচিকভাবে এক রাতেই ৫০ হাজার নিরীহ বাঙালীকে হত্যা করে। 

৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ বাঙালী শহীদ হন, তিন লাখ নারী নিপীড়ন, যৌন নির্যাতন ও ধর্ষণের শিকার হন। কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ৫০ বছরেও সেই গণহত্যার কোন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়া যায়নি। ফলে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা গেলেও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর যুদ্ধাপরাধী ১৯৫ জনকে বিচারের আওতায় আনা যায়নি। আর এখনও পাকিস্তান দাবি করে যে, তারা বাংলাদেশে কোন গণহত্যা চালায়নি।

অন্যদিকে বিশ্বে যাতে গণহত্যা বন্ধ হয় সে জন্যও এই স্বীকৃতি প্রয়োজন। কিছুদিন আগে পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, পূর্ব বাংলায় হত্যাকা- ও নির্যাতন সম্বন্ধে তারা ওয়াকিবহাল ছিলেন না, কেননা, ওই সময়ের পাকিস্তানের মিডিয়াগুলো এ সংক্রান্ত কোন খবর পত্রিকার পাতায় ছাপাত না।  
গণহত্যার স্বীকৃতি আদায়ের জন্য বিভিন্ন দেশের সংসদে ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস পাস করাতে হবে। গঠন করতে হবে বিশ্ব জনমত। এরপর জাতিসংঘে এটা নিয়ে ব্যাপকভাবে এগোতে হবে। আর এজন্য সরকার, প্রবাসী বাংলাদেশী এবং বিভিন্ন সংগঠনকে নিয়ে একযোগে কাজ করতে হবে। এটা করতে গেলে পাকিস্তান তো আছেই, সেইসঙ্গে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যেসব দেশ বিরোধী অবস্থানে ছিল তাদের বিরোধিতার মুখোমুখি হতে হবে।

সেটা কাটানোর জন্য ব্যাপক কূটনৈতিক উদ্যোগ ও তৎপরতা প্রয়োজন। আমাদের বাংলাদেশে এখনও যারা পাকিস্তানের দোসর হিসেবে কাজ করে, তারাও চাইবে না বাংলাদেশ গণহত্যার স্বীকৃতি আদায় করতে সক্ষম হোক। কেননা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সময় আমরা দেখেছি, বিচারকাজকে বাঁধাগ্রস্ত করতে প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীগুলো লবিস্ট নিয়োগ করেছিল।
রোহিঙ্গা গণহত্যার স্বীকৃতি দিয়েছে আমেরিকা। তাহলে আমাদের ইতিহাসের এক বর্বরোচিত অধ্যায় ২৫ মার্চ কেন স্বীকৃতি পাবে না? জাতিসংঘের কফি আনান কমিশন তো ওটাকে এথনিক ক্লিনজিং বলেছে। কিন্তু তার চেয়ে তো শতভাগ বেশি গণহত্যা হয়েছে বাংলাদেশে। মার্কিন পত্রপত্রিকায়ই সেসব প্রতিবেদন আছে। তখনকার সিনেটর, কংগ্রেসম্যানদের বক্তব্যও আছে। জাতীয়ভাবে বিষয়টিকে আমরা আলোচনায় নিয়ে আসতে পারিনি।
দুর্ভাগ্য আমাদের, জাতির পিতার হত্যাকাণ্ডের পর অবৈধভাবে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসা সরকারগুলো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে সকল ধরনের অপচেষ্টা চালিয়েছে। সে কারণেই বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সরকারকেই ২০১৭ সালে ২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস ঘোষণা করতে হয়। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক আফসান চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশে গণহত্যা ও গণহত্যার শিকার কয়েক হাজার ডকুমেন্টেশন আছে।

এখনও সারাদেশে গবেষণার মাধ্যমে আরও ডকুমেন্টস উদ্ধার করার সুযোগ রয়েছে। অর্থাৎ, গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতে যত রকমের তথ্য-উপাত্তের প্রয়োজন রয়েছে, সকল কিছুরই যোগান সংস্থাগুলোকে সরবরাহ করা সম্ভব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, রুয়ান্ডার গণহত্যার ব্যাপারে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে একটি প্রস্তাব পাস হয়েছে। আমরা সেই প্রক্রিয়ায় এগোতে পারি।

সার্বিকভাবে ৯ ডিসেম্বরকে ২০১৫ সালে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবসের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। তাই ওই দিনটিকে ২৫ মার্চ দিয়ে রিপ্লেস করার আবেদন করা যায়। উল্লেখ্য, গণহত্যা নিয়ে সবচেয়ে বড় সংগঠন ‘জেনোসাইড ওয়াচ’তো বাংলাদেশের গণহত্যার স্বীকৃতি দিয়েছে। তারা জাতিসংঘকে এ ব্যাপারে চিঠিও দিয়েছে।
জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনের একজন জ্যেষ্ঠ কূটনীতিক এ বিষয়ে বলেন, গণহত্যার স্বীকৃতি অর্জনের লক্ষ্যে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। যেসব দেশের সঙ্গে ইতোমধ্যে যোগাযোগ করা হয়েছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে রুয়ান্ডা, আর্মেনিয়া ও লিখটেনস্টাইন। এই তিনটি দেশেই গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে।

বর্তমান সরকারের লক্ষ্য হচ্ছে বেশি সংখ্যক রাষ্ট্র বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া গণহত্যার স্বীকৃতি দেবে, সহমর্মিতা জানাবে- সে বিষয়ে আন্তর্জাতিক পরিসরে কাজ চালিয়ে যাওয়া। গণহত্যা প্রতিরোধ মর্মে জাতিসংঘের যে উইংটি কাজ করে, সেখানে বাংলাদেশের ১৯৭১ সালের গণহত্যার প্রসঙ্গ টেনে বিবদমান রাষ্ট্র ও গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি উপস্থাপন করা যেতে পারে।
একাত্তরের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের লক্ষ্যে বর্তমান সরকার বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় বৈঠকগুলোতে বিষয়টি জোরালোভাবে তুলে ধরেছে। এরই অংশ হিসেবে ২০১৭ সালের এপ্রিলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের দিল্লী ও ভুটানের থিম্পু সফরের সময় একাত্তরে গণহত্যার প্রসঙ্গটি তোলেন। তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও ভুটানের প্রধানমন্ত্রী শেরিং টোবগে গণহত্যার স্বীকৃতি আদায়ে বাংলাদেশকে সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দেন। ২০১৭ সালের জুলাইয়ে ঢাকা সফরের সময় একই রকম আশ্বাস দিয়েছেন শ্রীলঙ্কার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিপালা সিরিসেনা।
মুক্তিযুদ্ধের গবেষক ও সংশ্লিষ্টদের মতে, ২৫ মার্চের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য জাতিসংঘ এবং নেদারল্যান্ডসের হেগে অবস্থিত আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে যাওয়ার সুযোগ আছে। তবে এই দাবি জোরালোভাবে তুলে ধরতে বাংলাদেশকে যথেষ্ট প্রামাণ্য দলিল উপস্থাপন করতে হবে। সে জন্যই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের স্মৃতি নিয়ে কাজ করা গবেষকদের মাধ্যমে দলিল-দস্তাবেজ সংগ্রহ করা হবে সহজ। এ বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক বলেন, জাতীয়ভাবে ২৫ মার্চ আমরা গণহত্যা দিবস পালন করছি। আন্তর্জাতিকভাবে দিবসটি পালনের জন্য বিশ্ব সম্প্রদায়কে সংবেদনশীল করার উদ্যোগ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে ব্যাপক জনমত।  
বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেই গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের লক্ষ্যে যাবতীয় কাজ করতে হবে। তিনি ইতোমধ্যে বিভিন্নভাবে জনমত তৈরিতে উদ্যোগ নিয়েছেন আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে। বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণ প্রত্যাশা করে, বঙ্গবন্ধু কন্যার দূরদর্শী নেতৃত্বেই বাংলাদেশ গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাবে।

অবশ্য এজন্য সমূহ বাধা বিপত্তিকে মোকাবেলা করেই এগিয়ে যেতে হবে। কেননা, পাকিস্তান ও তাদের দোসররা সরাসরি এ বিষয়টির বিরোধিতা করবে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশেরও অনেকেই যারা পাকিস্তানপন্থী, তারাও বিভিন্ন ফোরামে এটির বিরোধিতার করার চেষ্টা করবে। তবু আমরা প্রত্যাশা করি, বঙ্গবন্ধু কন্যার নেতৃত্বেই বাঙালী জাতির ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের গণহত্যা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাবে অচিরেই।  

লেখক : সহকারী অধ্যাপক ও সভাপতি
ক্রিমিনোলজি এ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

×