ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শারদীয় উপলব্ধি

অধ্যাপক ডাঃ মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)

প্রকাশিত: ২০:৩১, ৫ অক্টোবর ২০২২

শারদীয় উপলব্ধি

শারদীয় উপলব্ধি

বুধবার বিষণ্ণ সুরে পালিত হয়েছে শুভ বিজয়া দশমী। ভক্তের বিসর্জনে দেবী প্রত্যাবর্তন করেছেন স্বর্গলোকে। যে দেশে গরিষ্ঠ মানুষ ধারণ করে যে, ধর্মটা যার যার হলেও উৎসবটা সবার, সে দেশে আরও একটি শারদীয় উৎসবের আনন্দটা যখন তুঙ্গে, স্বস্তিটাও সঙ্গত কারণেই তখন খুব বেশি। তারপরও এর সঙ্গে থাকছে চাপা একটা দুশ্চিন্তাও। বর্তমানের এই অনুভূতিটা এদেশের ধর্ম নির্বিশেষে সংখ্যাগরিষ্ঠ আর সব মানুষের বেলাতেই বোধকরি প্রযোজ্য। কারণ, আমাদের স্মৃতিতে গত বছরের ‘অষ্টমীকা-’ এখনও একেবারে জ্বলজ্বলে।

আমরা ভুলে যাইনি আজ থেকে গুনে-গুনে ঠিক এক বছর আগে কিভাবে একদল নরপশু সনাতন ধর্মাবলম্বীদের শারদীয় উৎসবকে কলঙ্কিত করতে গিয়ে অবমাননা করেছিল আমাদের পবিত্রতম ধর্মগ্রন্থটিকে। কিভাবে এর জেরে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়েছিল এক ম-প থেকে আরেকটিতে, আর এক জেলা থেকে আরেক জেলায়। কিভাবে সাম্প্রদায়িক সঙ্ঘাতে নিরীহ পুরোহিত বলি হয়েছিলেন নোয়াখালীতে। শঙ্কা ছিল এবারও। ঘটতে পারত গতবারের চেয়েও বেশি কিছু। ঘটেনি। স্বস্তিটা তাই। তাই বলে ঘটার সময় কিন্তু এখনও পেরিয়ে যায়নি। সামনেই দীপান্বিতা ও শ্যামাপূজা। চাপা অস্বস্তিও সে কারণেই।
যে কোন উৎসব, তা সে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের শারদীয় দুর্গোৎসব হোক কিংবা আমাদের ঈদ, হোক তা খ্রিষ্টীয় ধর্মানুসারীদের বড়দিন, কিংবা আমাদের সবার বর্ষবরণ- কেন অসাম্প্রদায়িকতার মূলমন্ত্রকে ধারণ করে, ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তস্তাত আর তিন লাখ বীরাঙ্গনার সর্বোচ্চ ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশ নামক জাতি রাষ্ট্রটিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিককে জিম্মি হতে হবে গুটিকয়েক কুলাঙ্গারের হাতে? বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠার সুবর্ণজয়ন্তীতে এসে আজ এই প্রশ্নটি তাড়া করে ফেরে যখনই আবারও দরজায় কড়া নাড়ে বাঙালীর আরও কোন উৎসব।

যে দ্বিজাতিতত্ত্বকে অসাড় প্রমাণিত করে বাংলাদেশের জন্ম, সেই দ্বিজাতিতত্ত্বের সেবাদাস, সেই বাংলাস্তানীরা বরাবরই সক্রিয় থেকেছে দেশটিকে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র প্রমাণে। এদের হাতে অকালে আমরা সপরিবারে হারিয়েছিলাম আমাদের সর্বকালের শ্রেষ্ঠতম মানুষটিকে পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্টে। এরাই নানা নামে আর নানা বেশে রাষ্ট্র ক্ষমতায় টানা আসীন থেকে সরাসরি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় পেলেপুষে পুষ্ট করেছে সাম্প্রদায়িক শক্তিকে। এরা এতটাই দুর্বিনীত যে, দ-প্রাপ্ত ফিউজিটিভকে নেতা মেনে এরা ক্ষমতায় ফেরার স্বপ্নে বিভোর হয়ে আবারও অরাজকতার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। পত্রিকার পাতায় আর ভার্চুয়াল দুনিয়ার এর আলামতগুলো ইদানীং স্পষ্ট। নির্লজ্জের মতো এদের প্রকাশ্যে বলতে বাধে না যে, পাকিস্তানটাই নাকি বেজায় ভাল ছিল!
সম্প্রীতি বাংলাদেশ নামক সংগঠনটির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার কারণে পেশার পাশাপাশি অসাম্প্রদায়িক একটা বাংলাদেশের খোঁজে আমাদের ঘোরাঘুরি আর ঘাঁটাঘাঁটি বিস্তর। আর দু’চারজনের চেয়ে হয়ত সে কারণেই এ বিষয়ে আমাদের আগ্রহ, জানা আর বোঝাটাও খানিকটা বেশি। সপ্তমীর দিন সম্প্রীতি বাংলাদেশের হয়ে ঘুরেছি ঢাকার বেশ কটি বড় ম-পে। এবারের অনুভূতিটা অবশ্য অন্যবারের চেয়ে কিছুটা ভিন্ন। কদিন আগে কলকাতায় যেতে হয়েছিল। মহালয়ার দিন সেখানে বিবেকানন্দ সোসাইটির মিলনায়তনের দুর্গাপূজায় বিশেষ অতিথি হিসেবে আমন্ত্রিত ছিলাম। পুরো কলকাতায় দেখেছি পূজাকে ঘিরে কেমন যেন একটা দারুণ ভাইভ। একটা উৎসবময়তা আকাশে-বাতাসে-অন্তরীক্ষে।

আপনি হিন্দু হন, কি মুসলমান, পূজারি হন, কি নাস্তিক, উৎসবের এই আবেশ আপনাকে ছুঁয়ে যাবেই যাবে। সেই ভাইভটাই এবার পেয়েছি ঢাকার প্রধান পূজা ম-পগুলোর আশপাশে। পূজারি আর পথচারী সবার মাঝেই কেমন যেন একটা ফুর্তি-ফুর্তি ভাব। একেই বোধহয় বলে, ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’। আবার ঢাকেশ্বরী মন্দিরে ঢোকার মুখেই সোয়াতের রায়ট কার আর সশস্ত্র সোয়াত সদস্যদের সতর্ক নজরদারি আশ্বস্ত করলেও স্বস্তি দেয়নি। স্বস্তি পেতাম যদি দেখতাম সোয়াত-পুলিশ ছাড়াই পূজার উৎসবের ভাইভটা ছড়াচ্ছে ম-প থেকে ম-পে আর ম-পের চারপাশে। স্বস্তি পেতাম যদি দেখতাম মঙ্গল শোভাযাত্রায় প্রয়োজন পড়ে না সোয়াত পাহারার। কিংবা ঈদের জামাতের আগে জাতীয় ঈদগাহে র‌্যাবের সন্ধানী কুকুরকে বোমার খোঁজে আতিপাতি উঁকিঝুঁকি দিতে হয় না।
বিশ্বাস করি আমাদের উৎসবগুলোর ভাইভের সঙ্গে র‌্যাব-সোয়াতের এই যে ‘নিউ নরমাল’ রিমিক্স কালচারে আমরা ক্রমশই অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি, তার সঙ্গে এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কোন যোগাযোগ নেই। কারণ, গরিষ্ঠ জনগণকে কখনই র‌্যাব-পুলিশের বাঁধনে জড়িয়ে উৎসবে বাধ্য করা যায় না। আমাদের আজকের এই যে অদ্ভুতুড়ে উৎসবমুখরতা, ঢাকে বাড়ি দিতে আজ সোয়াতের বন্দুক এই যে আমাদের অবশ্য অনুষঙ্গ, এর জন্য দায়ী সেই সব সংখ্যালঘু বাংলাস্তানীরা যারা একাত্তরের ১৭ ডিসেম্বর থেকেই কোমরে কাছা বেঁধে নেমেছে এদেশটাকে ব্যর্থ প্রমাণের জেহাদে। আমরা নানা সময় নানাভাবে এদের ওপর আপাত জয় পেয়েছি। আর তারপর চূড়ান্ত জয় নিশ্চিত না করেই নিশ্চিন্ত থেকেছি। নিজেকে বোকার মতো বুঝিয়েছি যে, ওরা হেরে গেছে।
সপ্তমীর রাতে দেশের একটি নামকরা টিভি চ্যানেলের টকশোতে আলোচনার ফাঁকে-ফাঁকে মাথায় এসব কথাই ঘুরপাক খাচ্ছিল আর ভাবছিলাম, ‘বেশ তো, কিন্তু সমাধানটা কোথায়?’ এক সময় মনে হলো সমাধানটা তো আপনার-আমার হাতেই। শুধু সরকারের দিকে তাকিয়ে না থেকে আমরা কি পারি না সরকারের জন্য ক্ষেত্রটা তৈরি করে দিতে? আর আমরা যদি তা করতে পারি, সরকার তো বাকিটুকু করার জন্য গলাটা বাড়িয়ে দিয়ে বসেই আছে। এই আমরাই যখন একদিন গণজাগরণ মঞ্চে সোচ্চার হয়েছিলাম, তখন সরকার তো প্রতিপক্ষ হয়নি।

বরং আদালতের কাঠগড়ায় প্রতিধ্বনিত হয়েছিল কোটি বাঙালীর প্রাণের দাবি। আজ আমরা যারা অসাম্প্রদায়িকতা আর প্রগতিশীলতার ধ্বজাধারী, তারা যদি নিজেদের চাওয়া আর পাওয়ার হিসাবের খাতা বন্ধ করে আর যার-যার আভিজাত্যটুকু একটু একপাশে সরিয়ে রেখে, এই একটি বিষয়ে একটুখানি এক হতে পারি, আমরা নিশ্চিত সেক্ষেত্রে র‌্যাব-সোয়াতমুক্ত উৎসবময় বাংলাদেশে ফিরে যেতে আমাদের খুব বেশি একটা সময় লাগবে না।


লেখক : ডিভিশন প্রধান, ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যোল বিশ্ববিদ্যালয় ও
সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ

×