ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

একটি সংবাদেই সবকিছু স্মৃতি

ওবায়দুল কবির

প্রকাশিত: ২৩:১৭, ২ অক্টোবর ২০২২

একটি সংবাদেই সবকিছু স্মৃতি

.

তোয়াব ভাইকে প্রথম দেখেছিলাম ৫৫ মতিঝিল তৎকালীন জনকণ্ঠ অফিসে। সময়টা সম্ভবত ১৯৯২ সালের ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ। আমরা জনকণ্ঠে শিক্ষানবিস রিপোর্টার হিসেবে যোগদান করেছিলাম একই সালের ১৫ নবেম্বর। জনকণ্ঠ প্রকাশের সময় নির্ধারিত ছিল ’৯২ সালের ১৬ ডিসেম্বর। অফিসে একদিন অগ্রজ সাংবাদিক মোস্তাক মোবারকী ভাই সংবাদ দিলেন, তোয়াব ভাই জনকণ্ঠে যোগদান করছেন। মোবারকী ভাই তখন জনকণ্ঠে। তিনি আরও বললেন, ‘তোমরা খুবই ভাগ্যবান। আমার শিক্ষকেরও শিক্ষক তোয়াব ভাই। তোমরা তাঁর কাছে কাজ শেখার সুযোগ পাচ্ছ।’ মোবারকী ভাইয়ের  সেই কথা পরবর্তী সাংবাদিকতা জীবনে মর্মে মর্মে অনুভব করেছি। একটানা ২৮ বছর তাঁর তত্ত্বাবধানে কাজ শিখেছি। এখন মনে হয়, তোয়াব ভাইয়ের কাছে কাজ শেখার জন্য ২৮ বছরই যথেষ্ট নয়। আরও অনেক কিছু শেখা বাকিই রয়ে গেল।  
শিক্ষক তোয়াব ভাইয়ের সঙ্গে দীর্ঘ সময়ের অনেক স্মৃতি। সবকিছুই আজ হৃদয়ে বাজছে শানাইয়ের করুন সুরের মতো। ৩২ বছরের সাংবাদিকতা জীবনে জনকণ্ঠের সাবেক সম্পাদক, বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত মোহাম্মদ আতিকউল্লাহ খান মাসুদের কাছে পেশায় বিকাশ লাভ করার সুযোগ, প্রেরণা উৎসাহ পেয়েছি। এক যুগ ধরে সেই সময়ের প্রধান প্রতিবেদক প্রয়াত খালেক ভাইয়ের কাছে হাতে কলমে শিখেছি সংবাদ পরিবেশন। তোয়াব ভাইয়ের কাছে শিখেছি সাংবাদিকতা, পেশার বিশালত্ব ও গভীরতা। তারা তিন জনই এখন অতীত। চলে গেছেন আমাদের ছেড়ে। সাংবাদিকতা পেশা সমৃদ্ধ করতে রেখে গেছেন অনেক কিছু।   
একজন সাংবাদিক কতটা পেশাদার হতে পারেন তোয়াব ভাই ছিলেন তার অনন্য দৃষ্টান্ত। তাঁকে কাছ থেকে দেখলে আর কাউকেই দেখারই প্রয়োজন নেই। শুধু পেশা নয়, তাঁর শখ, আহ্লাদ, ধ্যান, জ্ঞান, সাধনা, গবেষণা সবই ছিল সাংবাদিকতা ঘিরে। সাংবাপত্র এবং সাংবাদিকতার বাইরে তাঁর আর কোন জগত ছিল না। সামাজিক জীবন দূরের কথা পারিবারিক জীবনও ছিল সাংবাদিকতার কাছে তুচ্ছ। সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রথম পত্রিকার পাতায় চোখ রাখা থেকে শুরু হতো তাঁর দিন।

রিপোর্ট, সম্পাদকীয়, ফিচারসহ সাংবাদিকতার নতুন নতুন ধারণা নিয়ে কাটত সারা দিন। দেশ থেকে প্রকাশিত অখ্যাত পত্রিকাসহ সকল সংবাদপত্রের পাতায় চোখ বুলাতেন মনোযোগ দিয়ে। নিয়মিত পড়তেন এদেশে পাওয়া যায় এমন সকল বিদেশী পত্রিকা। এই পাঠাভ্যাস থেকে ধারণা নিয়ে কাজে লাগাতেন পত্রিকায় পাতায়। রাতে ঘুমাতেন হয়তো বিবিসি, সিএনএন অথবা কোন সংবাদ চ্যানেলের পর্দায় চোখ রেখে। প্রায় নব্বই বছরের একজন মানুষের জীবনধারা কিভাবে এমন হতে পারে এটি ছিল এক বিস্ময়।
৯২ সালে তোয়াব ভাই জনকণ্ঠে যোগদান করেছিলেন উপদেষ্টা সম্পাদক হিসেবে। তখন আমাদের পত্রিকার ড্যামি কপি বের হতো। দেখে শুনে তোয়াব ভাই বললেন, ১৬ ডিসেম্বর পত্রিকা বের করা যাবে না। আরও প্রস্তুতি প্রয়োজন। পত্রিকার সম্পাদক আতিকউল্লাহ খান মাসুদ তা মেনে নিলেন। পরবর্তী দীর্ঘ সময় দেখেছি, পত্রিকা নিয়ে সম্পাদক কখনও তোয়াব ভাইকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করতেন না। বাংলাদেশে এত স্বাধীনতা নিয়ে কোন সাংবাদিক পত্রিকা বের করতে পেরেছিলেন কিনা আমার জানা নেই। জনকণ্ঠে যোগদান করার দিনই শুরু হয় তোয়াব ভাইয়ের নতুন চিন্তা ভাবনার প্রতিফলন। সকালে সাংবাদিকদের সঙ্গে মিটিং করে সারা দিনের পরিকল্পনা করার রীতি তিনিই পত্রিকায় চালু করেছিলেন। তাঁর কাছ থেকে আসতে থাকে নতুন নতুন আইডিয়া। আমাদের শেখাতে শুরু করেন রিপোর্ট কি, কিভাবে রিপোর্ট লিখতে হয়, কোথায় রিপোর্ট পাওয়া যায় ইত্যাদি। তোয়াব ভাইয়ের আইডিয়া নিয়ে আমরা ছুটতে থাকি চারদিকে। তিনি সন্তুষ্ট হওয়ার পর সিদ্ধান্ত নেয়া হয় ১৯৯৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবসে জনকণ্ঠ বাজারে আসবে। সেই থেকে যাত্রা শুরু।
সাংবাদিক হিসেবে তোয়াব ভাইকে যতই দেখেছি ততই বিস্মিত হয়েছি। একজন মানুষের জানার পরিধি কতটা বিস্তৃত হতে পারে তা তোয়াব ভাইকে কাছ থেকে না জানলে কেউ ভাবতেই পারবে না। তাঁর সাংবাদিকতা শুরু হয়েছিল সেই পঞ্চাশ দশকে। এই দেশের অনেক ইতিহাসের সাক্ষী ছিলেন তিনি। দেশের তৎকালীন প্রায় সকল প্রধান সংবাদপত্রে কাজ করেছেন তিন। মুক্তিযুদ্ধের সময় ছিলেন দৈনিক বাংলায়। ওখান থেকে পালিয়ে ভারতে গিয়ে কলম ও শব্দ সৈনিক হয়ে ওঠেন অনন্য মেধায়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তাঁর রচনা ও উপস্থাপনায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ‘পিন্ডির প্রলাপ’ মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল এবং মুক্তিপাগল বাঙালীর অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। দেশ স্বাধীন হবার পর তিনি প্রথমে দৈনিক বাংলার সম্পাদক, পরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রেস সচিব, আরও পরে রাষ্ট্রপতি এইচএম এরশাদ এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারে প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদের প্রেস সচিব, প্রধান তথ্য কর্মকর্তা, প্রেস ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক এবং আবারো দৈনিক বাংলার সম্পাদক হিসেবে বিশাল অভিজ্ঞতার ভা-ার অর্জন করেন। ’৯১ সালে খালেদা জিয়ার শাসনামলে তাঁকে দৈনিক বাংলার সম্পাদক পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। এর পরই তিনি যোগদান করেন জনকণ্ঠের উপদেষ্টা সম্পাদক হিসেবে। এই পত্রিকায় তিনি একনাগাড়ে দীর্ঘ ২৮ বছর অতিবাহিত করেন। এই সময় তিনি শুধু জনকণ্ঠ নয়, দেশের সংবাদপত্র জগত এবং রাষ্ট্রের জন্য রেখেছেন অনেক অবদান। মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং সাম্প্রদায়িতকার সঙ্গে তিনি কখনও আপোস করেননি। এজন্য তাঁকে জেলে পর্যন্ত যেতে হয়েছিল। সাংবাদিকতায় অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ২০১৬ সালে তাঁকে একুশে পদকে ভূষিত করা হয়।
বয়সের দীর্ঘ ব্যবধানেও তোয়াব ভাইয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশতে, কাজ করতে সমস্যা হয়নি। শিক্ষানবিস রিপোর্টার থেকে শুরু করে তাঁর হাত ধরে স্টাফ রিপোর্টার, সিনিয়র রিপোর্টার, বিশেষ সংবাদদাতা, প্রধান প্রতিবেদক (টানা ১৫ বছর) এবং ডেপুটি এডিটর পদে উন্নীত হয়েছি। অগ্রজ, বস, শিক্ষক ছাড়িয়ে কখন যে তাঁর অভিভাবকত্বের ছায়ায় আশ্রয় নিয়েছি টেরই পাইনি। পত্রিকার সম্পাদক আতিকউল্লাহ খান মাসুদের পাশাপাশি তোয়াব ভাই জড়িয়ে গিয়েছিলেন আমাদের ব্যক্তিগত জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নায়। পেশার পাশাপাশি তিনি খোঁজ খবর রাখতেন তাঁর সহকর্মীদের ব্যক্তি জীবনের। সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতেন কারও সঙ্কট-সমস্যায়। সহকর্মীদের জন্যে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করা, কর্মস্থলে সহকর্মীদের সুবিধা-অসুবিধা দেখা ছিল তার পেশাগত দায়িত্বের অধীন। এই দায়িত্ব তিনি পালন করেছেন জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত।
তোয়াব ভাই এমন একজন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ ছিলেন যার নির্দেশ অমান্য করা, সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন না করা কিংবা পরামর্শ উপেক্ষা করা ছিল অসাধ্য। দীর্ঘ ১৫ বছর প্রধান প্রতিবেদকের দায়িত্ব পালনের সময় তাঁর সঙ্গে অনেক বিষয় নিয়ে মতবিরোধ হয়েছে। বিতর্কও হয়েছে অনেক। এই বিতর্ক কিংবা মতবিরোধ কখনও বেয়াদবির পর্যায়ে যায়নি। তাঁর একটি অসাধারণ গুণ ছিল, কারও প্রতি তিনি কখনোই প্রতিহিংসাপরায়ণ হতেন না। তর্ক বিতর্কে তিনি হয়তো মাঝে মধ্যে উত্তেজিত হয়ে উঠতেন, আবার কিছুক্ষণ পরই স্বাভাবিক হয়ে যেতেন। সেই ভুবন ভুলানো হাসিতে ভুলিয়ে দিতেন একটু আগে যা হয়েছে। পেশাগত দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতা বা গাফিলতির কারণে তিনি কারও প্রতি বিরক্ত হতেন, প্রচ- বকা-ঝকা করতেন। এর প্রতিফলন কখনও ব্যক্তিগত জীবনে ঘটতে দিতেন না। ব্যক্তিগত জীবনে যাকে হয়তো তিনি সবচেয়ে পছন্দ করতেন তাকেও পেশাগত দৃষ্টিকোণ থেকে কোন ছাড় দিতেন না। ব্যক্তি সম্পর্ক এবং পেশার এই অপূর্ব সম্মিলন একমাত্র তোয়াব ভাইয়ের পক্ষেই সম্ভব ছিল। দীর্ঘ সময় ধরে তাঁর এই গুণটি আমার ব্যক্তিজীবনে ধারণ করার চেষ্টা করেছি। এর ফলও আমি পেয়েছি।
অতিসম্প্রতি আমি জনকণ্ঠের রিপোর্টিং ছেড়ে সম্পাদকীয় বিভাগে যোগদান করি। সূচনা হয় আমার লেখালেখির নতুন জগত। হাঁটি হাঁটি পা পা করে শুরু হয় সম্পাদকীয়, উপ-সম্পদকীয় লেখা। তোয়াব ভাই তখন জনকণ্ঠের সঙ্গে আর ছিলেন না। বেশিরভাগ সময় অসুস্থই থাকতেন। এর পরও তিনি নিয়মিত পড়তেন আমার লেখা উপ-সম্পাদকীয়। মাঝে মধ্যে ফোন করে প্রশংসা করতেন, আবার কিছু কিছু ভুলও ধরিয়ে দিতেন। সর্বশেষ তিনি রাজনীতি নিয়ে আমার একটি লেখার খুব প্রশংসা করেছিলেন। সম্ভবত এটিই তাঁর সঙ্গে আমার শেষ কথা। জনকণ্ঠে নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর আমাকেও রিপোর্টিং মিটিংয়ে ফিরতে হয়েছে। রিপোর্টিং মিটিং ছিল তোয়াব ভাইয়ের চালু করা এবং তাঁর খুবই পছন্দের। এই মিটিংয়ে রিপোর্টারদের দিকনির্দেশনা  দেয়ার পাশাপাশি তিনি বিশাল অভিজ্ঞতার ভা-ার থেকে সবাইকে সমৃদ্ধ করতেন। শনিবার (পহেলা অক্টোবর) তার এই প্রিয় রিপোর্টিং মিটিংয়ে বসেই মর্মান্তিক সেই সংবাদটি পেলাম। জনকণ্ঠের সাবেক প্রধান প্রতিবেদক রেজোয়ানুল হক রাজা ফোন করে জানালেন, ‘তোয়াব ভাই আর নেই’। কানে বার বার এই ক’টি শব্দ প্রতিধ্বনিত হতে থাকল। ফোনটি ছেড়ে মিটিংয়ে সবাইকে দুঃসংবাদটি জানালাম। সবাই স্তব্ধ হয়ে গেলেন। মুহূর্তে পাল্টে গেল মিটিংয়ের চিত্র। সাবেক সহকর্মীদের মধ্যে নেমে এলো বিষাদের ছায়া। একটি ফোনের সংবাদেই সবকিছু হয়ে গেল অতীত। তবুও জীবন থেমে থাকে না। কষ্ট করে হলেও মিটিংয়ের কাজ শেষ করা হলো। মিটিংয়ে আর একটি কথাও উচ্চারণ করতে পারলাম না। বার বার ঝাপসা হয়ে উঠছিল চোখের পাতা। একটি নয়, দুটি নয়, ২৮ বছরের পথ চলা। দীর্ঘ সময় ছাতার মতো মাথার ওপর ছায়া হয়ে থাকা তোয়াব ভাই  আর নেই। চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে। আর কোন দিন দরাজ গলায় প্রশ্ন করবে না, ‘কি খবর তোমার?’ আর বলবেন না, ‘লেখাটা ভাল হয়েছে, তবে আরও এই... দিকে নজর দিলে ভাল করতে।’
 লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, জনকণ্ঠ

 

×