ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১

পোশাক ও শাঁখা-সিঁদুর!

মমতাজ লতিফ

প্রকাশিত: ২০:৫৫, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২২

পোশাক ও শাঁখা-সিঁদুর!

পোশাক ও শাঁখা-সিঁদুর

নিজেকে নিজে জিজ্ঞেস করি- এটা কোন শতাব্দী? আর যাই হোক, এই শতাব্দী বিজ্ঞানের যেমন প্রচণ্ড উল্লম্ফনের কাল, তেমনি এ জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের ফলে উন্নয়নের তুঙ্গ অবস্থানে পৌঁছে পৃথিবীর জনগণকে গলন্ত গ্লেসিয়ার দ্বারা বন্যা-জোয়ারের পানিতে ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়াকে পর্যন্ত পর্যুদস্ত হওয়ার অদৃষ্টপূর্ব দৃশ্য দেখিয়েছে! উক্ত তিন মহাদেশে অতি উষ্ণতার ফলে মাইলকে মাইল অরণ্য বার বার ভস্মীভূত হতেও দেখা যাচ্ছে। টর্নেডো-সাইক্লোন যেসব পশ্চিমা ধনী দেশ কখনও প্রায় দেখেনি, তারা এখন এসব নিয়মিত প্রাকৃতিক কাণ্ডে হাজার হাজার ঘরবাড়ি যেমন ধ্বংস হতে দেখছে, তেমনি বিদ্যুত বিচ্ছিন্ন হয়ে দীর্ঘ সময় কাটাচ্ছে অন্ধকারে।

অবশ্য এসব ঘটনা আমাদের জন্য জলভাত, কেবল দাবানল ছাড়া। এর মধ্যেই আমরা যেমন বঙ্গবন্ধু উপগ্রহ উৎক্ষেপণ করেছি, তেমনি নাসাও মহাকাশ গবেষণার ক্ষেত্রে অকল্পনীয় অগ্রগতি করেছে। নাসার বিজ্ঞানীরা সূর্যের গবেষণায় যেমন যান পাঠিয়েছে, তেমনি শনি গ্রহ, এর উপগ্রহ, মঙ্গল, চাঁদ এবং মহাকাশে মহাবিশে^র জন্মের রহস্য উদঘাটনের লক্ষ্যে পাঠিয়েছে এমন মহাকাশ যান, যার একটি গ্যালাক্সি, নীহারিকা, মিল্কিওয়ে পেরিয়ে আমাদের সৌরজগৎ ছাড়িয়ে চলে গেছে সৌরজগতের বাইরে। বিজ্ঞানীরা এখন চাঁদে একটি স্টেশন তৈরির কাজ করছে।

এর পাশে যখন দেখি- নরসিংদী রেলস্টেশনে টপ-প্যান্ট পরা তরুণীর পোশাক নিয়ে টানাহেঁচড়া করা, তাকে গালমন্দ করা, দৈহিক লাঞ্ছনা করছে একজন হিজাবধারী নারী, তার সঙ্গে এগিয়ে এসেছে একদল তরুণ হামলাকারী, তখন প্রশ্ন আসে মনে- এই ’হিজাব ধারী কেন হিজাব পরছে?’ ‘হিজাব’ কস্মিনকালেও বাঙালী নারীর পোশাক নয়। বর্তমানে বোরখা, আলখাল্লা জাতীয় পা পর্যন্ত ঢাকা ঢোলা একরকম পোশাক পরতে দেখা যাচ্ছে বাঙালী নারীদের! দেখে ভাবি, সৌদি প্রধানমন্ত্রী সালমান বছর পাঁচেক আগে এক বক্তব্যে বলেছিল- ‘নারীদের যে পুরো অঙ্গ ঢাকা পোশাক পরতে হবে তা ঠিক নয়, এমন অনেক মুসলিম দেশ আছে যেখানে মুসলিম নারীরা এসব পোশাক পরে না, মাথাও ঢাকে না, এতে কোন ক্ষতি নেই।’

তখন আমাদের মনে হয়েছিল বাংলাদেশের সুন্দর শালীন শাড়ি পরা, সেলোয়ার-কামিজ পরা মাথা না ঢেকে চুল ছেড়ে চলা বাঙালী নারীদের তিনি সপ্রশংস দৃষ্টিতে লক্ষ্য করেছেন। কিন্তু হায়! বিগত পাঁচ-ছয় বছরে বাঙালী নারী নিজেদের মাথা হিজাবে বেঁধে, আরব দেশীয় পোশাক ঢোলা আলখাল্লায় নিজেদের বন্দী করেছে  দেখে সৌদি প্রধানমন্ত্রী সালমান অবশ্যই হতাশ হয়েছেন। রাস্তাঘাটে এসব নারী দেখে বাঙালী মনে হয় না। সৌদি প্রধানমন্ত্রী সালমান নারীদের কিছু স্বাধীনতা দিতে চান এবং দিয়েছেনও।
বর্তমান শতাব্দীতে একটি কথা পোশাকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। পোশাক শুধু গাত্রাচ্ছাদন থেকে  বেরিয়ে এসে ফ্যাশন বা স্টাইলের একটি অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে উঠেছে। সুতরাং পোশাকে অঞ্চলের আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য যেমন প্রচলিত থাকবে, তেমনি পোশাকে ফ্যাশন যুক্ত হয়ে এটি আন্তর্জাতিক রূপ লাভ করেছে। শাড়ি, লুঙ্গি, সেলোয়ার-কামিজ, পাগড়ি-হিজাব ইত্যাদি আঞ্চলিক পরিধান যেমন প্রচলিত থাকবে ঐ অঞ্চলে, তেমনি টপস-প্যান্ট, ভিন্ন ধরনের লেহেঙ্গা, গারারা, ম্যাক্সিসহ নানা রকম পোশাকও এর পাশে থাকবে প্রচলিত।
পোশাক বা ফ্যাশনের বিষয়ে ভাল না লাগলেও সবাইকে ব্যক্তির পছন্দ ও রুচিকে মান্যতা দিতে হবে। তবে দেখা যায় ফ্যাশন শোতে প্রচলিত মডেলবৃন্দ যেসব ফ্যাশনের পোশাক পরে থাকে বাস্তবে সেসব কাউকে পরতে দেখা যায় না। মেয়েরা কি পোশাক পরবে সেটা যেমন সরকার ঠিক করতে পারে না, তেমনি পুরুষ, তার স্বামী বা পিতা হলেও তারা তা ঠিক করতে পারে না। পুরুষের পোশাক কি কোন পুরুষ ঠিক করে দেয়?
মুসলিম পুরুষ ব্রিটিশ যুগে কিছুতেই বাঙালী হতে চায়নি। মাতৃভাষা বাংলা, ব্রিটিশের ভাষা ইংরেজী থেকে মুখ ফিরিয়ে আরবী-উর্দুতেই আবদ্ধ থাকতে পছন্দ করত! একই সঙ্গে বেগম রোকেয়ার লেখনী বলে দিচ্ছে- অলঙ্কার ও বোরখায় বন্দিনী নারী রেললাইনে পড়ে গিয়ে আর উঠে দাঁড়াতে না পারায় রেলগাড়ি তাকে চাপা দিয়ে চলে গেছে! এ যুগের আধুনিক পুরুষ নিজে শার্ট-জিন্স পরলেও পাশে বউ-প্রেমিকাকে হিজাবে বন্দী রাখতে পছন্দ করছে! যা আশ্চর্যজনক লাগে আমাদের দৃষ্টিতে।

কারণ, পুরুষ যদি নারীর বন্দিত্ব পছন্দ করে তাহলে অধিকাংশ নারী ঐ বন্ধনকে যে মান্য করতে পছন্দ করবে তাতে সন্দেহ নেই। নারীর একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, সে সঙ্গী-স্বামী পুরুষের ভালবাসা পাওয়ার জন্য এমন কিছু নেই, যা সে ত্যাগ করতে পারে না।
এবার আসি সাম্প্রতিক এসএসসি পরীক্ষার দুই হিন্দু কিশোরী পরীক্ষার্থীকে সিঁদুর এবং শাঁখা পরে আসার কারণে পরীক্ষার হলে ঢুকতে দিচ্ছিল না যে দুই অতি-মুসলিম নারী শিক্ষক সে বিষয়ে! ঘটনাটি বিস্ময়কর! অস্বাভাবিক এবং অদৃষ্টপূর্ব! পাঠক, ভাবুন, আমরা ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিতে যাচ্ছি, ভয়ে হাঁটতে পারছি না, গণিত-ইংরেজী পরীক্ষার দিন তো খাওয়া-দাওয়া প্রায় বন্ধ। মায়েরা, বাবারা, ভাইরা টিফিন টাইমে ডাব কেটে স্কুল গেটে দাঁড়িয়ে। পরীক্ষার্থীও তাদের দিকে একটু অগ্রসর হয়ে প্রথম পরীক্ষা কেমন হয়েছে, সেটি জানিয়ে কোন ডাব না খেয়ে দৌড়ে পেছনে লুকিয়ে পরের পরীক্ষার বই-খাতা দেখায় ব্যস্ত হতো। ডাব বা কিছু মুখে দিতে পেরেছে, এমন কাউকে দেখা যেত না। সেটি হতো ২য় পত্রের পরীক্ষা শেষে। আমি তো বাড়ি ফিরে মার ওপর এমন রাগ করেছিলাম, কেন দুপুরে ডাব, খাবার নিতে হবে!

সেক্ষেত্রে এই দুজন পরীক্ষার্থীর কেমন লেগেছিল যখন ওদের সিঁদুর, শাঁখার জন্য হলে প্রবেশে বাধা পেয়েছিল? ভালই বুঝতে পারছি, ওদের অনুভূতি কি ছিল! দুর্ভাগ্য, এ যুগের শিক্ষক-শিক্ষিকারা পরীক্ষার্থীদের অনুভূতি বোঝা দূরে থাক, তাদের অতি হিন্দু-বিদ্বেষও আমাদের বিপন্ন করে তুলেছে। এ বাংলাদেশকে আমরা চিনি না। এ বাংলাদেশকে কখনও চাইনি আমরা।
অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের লালন সাঁই বা শাহ আবদুল করিম, কিংবা হাছন রাজা- তাদের গান, তাদের অসাম্প্রদায়িক উদার মহৎ আদর্শ, চিন্তা-ভাবনার বিন্দুমাত্রও এই দু’জন শিক্ষক শোনেনি এবং তাদের বদ্ধ মনে হিংসা-বিদ্বেষ ছাড়া মনে হয় না আর কিছুর অস্তিত্ব রয়েছে। আশ্চর্য এই যে, নিশ্চয় ঐ স্কুল গেটে বহু লোক, শিক্ষক-কর্মকর্তা অবস্থান করছিল। তাদের সামনে ঐ দুটি ভীতসন্ত্রস্ত বালিকাকে সিঁদুর মুছে, শাঁখা খুলে তারপর পরীক্ষার হলে ঢুকতে হয়েছিল- এ কিভাবে সম্ভব হলো? সিঁদুর-শাখা হিন্দু ধর্মীয় রীতির অপরিহার্য অংশ- তাহলে ঐ দুই শিক্ষিকার ধর্ম অবমামনার জন্য চাকরিতে বহাল থাকার কোন যৌক্তিকতা থাকে কি? ধর্ম অবমাননার জন্য তাদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল আইন প্রয়োগ হবে কি? তারা আর যে পেশাই হোক না কেন, শিক্ষকতার মতো মহান, উদার, মানবিক পেশার জন্য একেবারেই উপযুক্ত নয়।
বাংলাদেশে বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের জোট ক্ষমতায় দীর্ঘদিন থাকা সত্ত্বেও অনেক বেশি সাম্প্রদায়িক, ধর্মান্ধতায় আক্রান্ত ব্যক্তি রয়েছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে, যা আশঙ্কার বিষয়। মুক্তিযুদ্ধের ধর্মনিরপেক্ষ উদার মানবতাবাদকে রক্ষা করতে মনে হয় আরও অনেক কিছু আমাদের করতে হবে। নক্ষত্রের মতো অসংখ্য দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক নেতা মুক্তিযোদ্ধাদের স্বীকৃতি, তাদের অবদান, মুক্তিযুদ্ধে তাঁদের যোদ্ধা ও সংগঠকের ভূমিকা এখনও যথার্থ স্বীকৃতির অপেক্ষায়।

প্রতি শ্রেণীর পাঠ্যবইতে এক একজনের সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা লিখিত থাকলে, টিভিতে জাতীয় দিবসগুলোতে তাদের সম্পর্কে আলোচনা, তাদের স্মৃতি বিজড়িত স্থানে কোন ‘স্মারক’ তৈরি এবং জাতীয় দিবসে স্থানীয় স্কুলের ছাত্রছাত্রী, নেতৃবৃন্দ তাদের স্মৃতিচারণ করে অনুষ্ঠান করলে তাদের অবদানকে স্বীকৃতি দেওয়া হবে। প্রত্যেক জেলার জেলাওয়ারি বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা করা দরকার। জেলাওয়ারি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনা করে সেগুলোকে সহ-পাঠ হিসেবে শ্রেণীকক্ষে পড়ানো হলে ভাল হবে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও খেলাধুলার প্রতিযোগিতা মানব মনকে উদার করে। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়- বঙ্গবন্ধুকে রক্ষা করতে যাওয়া কর্নেল জামিল যে স্থানে নিহত হন সেখানে একটি স্মারক দরকার, যা জনগণকে ১৫ আগস্টের কলঙ্কজনক ঘটনা স্মরণ করিয়ে দেবে।
দুর্গা পূজা এসে গেছে। আমাদের প্রস্তাব- পূজা শুরুর এক সপ্তাহ আগে থেকে পরের এক সপ্তাহ পর্যন্ত স্থানীয় যুবলীগ, ছাত্রলীগ, অন্য দলের তরুণদের ম-প পাহারা দেয়ার কাজে লাগালে ভাল হয়। এরা একটা হাতখরচ পাবে, যা তাদের তিন বেলার খাবার কেনায় ব্যবহার করা যাবে। ছাত্র রাজনীতির প্রধান লক্ষ্য-সমাজের ক্ষমতাহীনদের পাশে থেকে নিরপত্তা দেয়া। সেটির অনুশীলন এ কাজ থেকে হতে পারে। পুলিশ প্রশাসন প্রধান দায়িত্ব পালন করবে। স্থানীয় তরুণদের দ্বারা সেবা কমিটিরও তারাই তত্ত্বাবধান করবে। সমাজকে তরুণরাই মৌলবাদীমুক্ত করবে- এটা তাদেরই অন্যতম দায়িত্ব।

লেখক : শিক্ষাবিদ

×