ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কার দোষে ডেঙ্গুর প্রকোপ

ডাঃ মোঃ আবদুল মজিদ ভূঁইয়া

প্রকাশিত: ২০:৩৫, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২২

কার দোষে ডেঙ্গুর প্রকোপ

চলতি বছর বিশ্বজুড়ে চলছে ডেঙ্গুর আক্রমণ

চলতি বছর বিশ্বজুড়ে চলছে ডেঙ্গুর আক্রমণ। এশিয়ায় চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্তের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ইন্দোনেশিয়া (আক্রান্ত প্রায় ৫৩০০০, মৃত্যু ৪৫০), ফিলিপিন্স (আক্রান্ত প্রায় ৬৫০০০, মৃত্যু ২৭৫), তিমুর (আক্রান্ত প্রায় ৫০০০, মৃত্যু ৫৬), ভিয়েতনাম (আক্রান্ত প্রায় ১০৫০০, মৃত্যু ৩৭), মালয়েশিয়া (আক্রান্ত প্রায় ২৭০০০, মৃত্যু ২০), লাওস (আক্রান্ত প্রায় ৭০০০, মৃত্যু ১৩), কম্বোডিয়া (আক্রান্ত প্রায় ৪০০০, মৃত্যু ১১), বাংলাদেশ (আক্রান্ত প্রায় ১১৫৬৯, মৃত্যু ৪৫), শ্রীলঙ্কা (আক্রান্ত প্রায় ৩৩০০০, মৃত্যু শূন্য), সিঙ্গাপুর (আক্রান্ত প্রায় ২২০০০, মৃত্যু শূন্য) এবং থাইল্যান্ড (আক্রান্ত প্রায় ৯৫০০, মৃত্যু শূন্য)। মোট ১১টি দেশের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বাংলাদেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি নাজুক নয়। অথচ হৈচৈয়ের দিক থেকে বাংলাদেশ এগিয়ে।

বিশ্বের গ্রীষ্মম-লীয় অঞ্চলে অনেক দেশেই ডেঙ্গুর আক্রমণ ঘটছে। পৃথিবীর অর্ধেকের বেশি মানুষ ডেঙ্গু ঝুুঁকির মধ্যে রয়েছে। ডেঙ্গুর আক্রমণের সঙ্গে পরিবেশের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার একটা নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। বিশ্ব পরিবেশ সংস্থার মূল্যায়ন অনুযায়ী সিঙ্গাপুর পরপর তিনবার বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। অথচ সেই সিঙ্গাপুরে ডেঙ্গুর আক্রমণ বাংলাদেশের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ।
ঢাকা শহরের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে আমরা সবাই ওয়াকিবহাল। তারপরও সিঙ্গাপুরের চেয়ে ডেঙ্গুর আক্রমণ অনেক কম। এতে প্রমাণ হয় যে, ডেঙ্গুর আক্রমণের সঙ্গে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ছাড়াও আরও অনেক বিষয় জড়িত রয়েছে। এডিস মশা নিধনের জন্য রাসায়নিক ছিটালেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে এমন ভাবনাও সঠিক নয়। সিঙ্গাপুরে এডিস মশা নিধনের জন্য কার্যক্রম শতভাগ আন্তরিকতার সঙ্গে সম্পন্ন করা হয়। তারপরও সেখানে ডেঙ্গুর আক্রমণ বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বেশি। ওপরে বর্ণিত দেশগুলোতে ডেঙ্গুর আক্রমণের জন্য কেউ কাউকে দোষারোপ করছে না বা কেউ নিজের দায়িত্ব পালন না করে অন্যের ঘাড়ে দায়িত্ব চাপানোর চেষ্টা করছে না, যেমনটা বাংলাদেশে ঘটছে। বরং সবাই প্রত্যকের অবস্থান থেকে ডেঙ্গুর আক্রমণ প্রতিরোধের জন্য দায়িত্ব পালন করে চলেছে। প্রত্যেকে দেশপ্রেমের পরিচয় দিয়ে চলেছে।

অথচ বাংলাদেশে চলছে দায়িত্ব এড়ানোর প্রতিযোগিতা, পাল্টাপাল্টি দোষারোপের প্রতিযোগিতা, দায়িত্বহীনতার প্রতিযোগিতা। অভিযোগ রয়েছে ঢাকার মশার ওষুধ অকার্যকরী। তাই কাজ হয়নি এবং মশাও মরেনি। সিঙ্গাপুরের মশার ওষুধ নিশ্চয়ই কার্যকরী ছিল, সেখানে নিশ্চয়ই ন্যায্যভাবে মশার ওষুধ ছিটানো হয়েছে। তাহলে সিঙ্গাপুরে ডেঙ্গুর আক্রমণ বাংলাদেশের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি কেন? পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন প্রজাতির এডিস মশা রয়েছে। তাদের আচার-আচরণ, ডিম দেয়ার প্রয়োজনে রক্ত সংগ্রহকরণ যেমন মানুষ থেকে রক্ত সংগ্রহ করবে নাকি পশু থেকে রক্ত সংগ্রহ করবে সে পার্থক্য, অপ্রতিকূল পরিবেশে বংশ বিস্তারের স্থান পরিবর্তন ইত্যাদি পার্থক্যের কারণে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ কঠিন। বাংলাদেশও সেই ব্যতিক্রমের উর্ধে নয়। বাতাসের তাপমাত্রা ২৫ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেডের নিচে চলে গেলে এডিস মশার কামড়ানোর মাত্রা অনেক কমে যায়।

সেজন্য শীতকালে যেমন নবেম্বর থেকে পরবর্তী বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এডিস মশার কামড়ানোর মাত্রা অনেক কমে যায়। সে কারণে ডেঙ্গুর আক্রমণও অনেক কমে আসে। প্রতি বছর মে হতে অক্টোবর মাস পর্যন্ত ডেঙ্গুর আক্রমণ ঘটে থাকে এবং জুলাই হতে সেপ্টেম্বর মাস ডেঙ্গুর আক্রমণ সবচেয়ে বেশি ঘটে থাকে। কারণ বাতাসের তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা উক্ত ৩ মাসে সবচেয়ে বেশি থাকে। মশা নিধনের ওষুধ বেশি বেশি প্রয়োগ করলে পরিবেশের ওপর তার বিরূপ পাশর্^প্রতিক্রিয়া হয়। মশার সঙ্গে পরিবেশের অন্যান্য উপকারী প্রাণী যেমন কীটপতঙ্গ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। এতে পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট হয়। সেজন্য বিজ্ঞানীরা কীটনাশক প্রয়োগের পরিবর্তে মশার বংশ বিস্তারের স্থান নির্মূলের জন্য পরামর্শ দেন।
ঘনবসতিপূর্ণ ঢাকা শহরে বিল্ডিং ও স্থাপনাগুলোর ভিতরে এডিস মশার বংশ বিস্তারের লাখ কোটি স্থান লুকিয়ে রয়েছে। যা নাগালের বাইরে এবং যা নির্মূল করা অত্যন্ত দুরূহ। সবচেয়ে কার্যকরী মশক নিধন ওষুধ ডিডিটি ব্যবহারের ওপর বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। কেননা উক্ত মশক নিধন ওষুধ প্রয়োগের পর এটা পরিবেশের মধ্যে স্থায়ীভাবে থেকে যায়, প্রাণীকুলের জীবনচক্রে ঢুকে যায় এবং বংশানুক্রমিকভাবে প্রাণীকুলের ভিতরে ডিডিটির মাত্রা বৃদ্ধি পেতে থাকে। তিন বংশ বা চার বংশ অতিক্রম করলে ডিডিটির মাত্রাও তিন বা চারগুণ বৃদ্ধি পায়, যাকে বলা হয় বায়োমেগনিফিকেশন। যা খুবই ভয়ঙ্কর। যে কারণে মশা নিধনে অত্যন্ত কার্যকরী ওষুধ হওয়া সত্ত্বেও বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা ডিডিটির ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। উক্ত মশক নিধন ওষুধ ব্যবহারের জন্য বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমতি লাগে এবং সহজে অনুমতি মিলে না।
রোগ জীবাণু নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য এ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। তেমনি মশাও নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় মশক নিধন ওষুধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। যে কারণে মশক নিধন ওষুধ অনেক ক্ষেত্রে কাজ করছে না। দৃশ্যমান ও নাগালের ভিতরের বংশ বিস্তারের স্থান ধ্বংস করা সহজ, কিন্তু নাগালের বাইরের বংশ বিস্তারের স্থান নির্মূল করা যায় না। এডিস মশা গাছগাছালির ভিতরে জমে থাকা পানিতেও ডিম দেয়, যা নির্মূল করা যায় না। কিন্ত এডিস মশার বংশ বিস্তারের স্থান ধ্বংস করার লক্ষ্যে গাছগাছালি কেটে ফেলা সম্ভব নয়। কেননা পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট হবে। বরং ডাবের খোসা ও পরিত্যক্ত টায়ারে জমে থাকা পানি ধ্বংস করা অনেক সহজ। এই বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ঢাকা শহরের হাজারো ডাব বিক্রেতা ও গাড়ি মেরামতের হাজারো ওয়ার্কশপের প্রচুর সংখ্যক কর্মীকে সিটি কর্পোরেশন কর্তৃক স্বাস্থ্য শিক্ষাদান ও প্রশিক্ষণ প্রদান করে এডিস মশার বংশ বিস্তারের সবচেয়ে পছন্দনীয় স্থানগুলো নির্মূল করা যেতে পারে।
সংক্রামক ব্যাধির কার্যকরী উপায় হলো ভেকসিন। টেকনিক্যাল কারণে বিজ্ঞানীরা ভেকসিন তৈরি করতে পারছেন না। প্রতিটি যুদ্ধের পূর্বে মানুষ যেমন প্রস্তুতি গ্রহণ করে থাকে ঠিক তেমনি জীবাণুরাও বড় আকারের আক্রমণ বা ইপিডেমিক ঘটানোর পূর্বে প্রস্তুতি গ্রহণ করে। জীবাণুদের সেই প্রস্তুতি পর্বকে সময়মতো শনাক্ত করে উপযোগী প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। সাধারণত গ্রীষ্মম-লীয় দেশগুলোতে ডেঙ্গুর আক্রমণ ঘটে থাকে। কেননা এডিস মশার বংশ বিস্তারের জন্য ১৫ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রার প্রয়োজন হয়। যে কারণে শীতপ্রধান দেশে ডেঙ্গুর আক্রমণ ঘটে না। তাই পরস্পরকে দোষারোপ না করে প্রত্যেকেই এডিস মশা নিধন কার্যক্রমে দলমত নির্বিশেষে সকলেই অংশগ্রহণ করতে পারেন। তাহলে ঢাকা ডেঙ্গুমুক্ত হয়ে যাবে। এটাই জনগণের সামনে দেশপ্রেম প্রদর্শনের উত্তম উপায়। মনে রাখতে হবে এডিস মশার বংশ বিস্তারের স্থান ধ্বংস করলে এডিস মশা থাকবে না। আর এডিস মশা না থাকলে ডেঙ্গুর আক্রমণও ঘটবে না।

 
লেখক : সাবেক পরিচালক  বিএসএমএমইউ
ব্রিগেঃ জেনাঃ (অব.)

×