বঙ্গবন্ধু জাদুঘরে কিছুক্ষণ
অশ্রুসিক্ত ও বিচলিত ইউসুফ এ হারুন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তিনি সস্ত্রীক, আরও কয়েকজন সঙ্গীকে নিয়ে আমাদের অতিথি হয়ে এসেছিলেন বাংলাদেশ দেখতে। দেখতে এসেছিলেন জননেত্রী শেখ হাসিনাকে। ভিজিটরস বুক এ (Visitors Book) মন্তব্য লিখতে গিয়েই থমকে দাঁড়ালেন ইউসুফ হারুন। কম্পিত হাতে চোখ মুছলেন।
আমাকে বললেন, ‘করাচী পৌঁছেই আমার লেখনী আমি পাঠিয়ে দেব। বাংলাদেশ ডেপুটি হাই কমিশনারের মাধ্যমে পাঠাব।’ সঙ্গের অন্য সবাইও লিখলেন সুন্দরভাবে। মোহাম্মদ তারেক খান, স্পেশাল এ্যাসিস্ট্যান্ট টু চীফ মিনিস্টার ইন পেশোয়ার। তিনি শামসুর রহমান খানের সমসাময়িক। ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে অনেকবার সাক্ষাত হয়েছে। পাকিস্তান শাসকদের কাছে তিনি কয়েকবার তিরস্কৃত হয়েছিলেন। আরও লিখলেন সিনেটর আব্বাস সরফরাজ খান। বয়সে অনেক ছোট কিন্তু ক্ষুরধার তীক্ষèতা। তারা অনেক প্রশ্ন করলেন।
অনেক উত্তর পেলেন, কিন্তু সব উত্তর তো পেলেন না। পাওয়ার কথাও নয়। দ্য গলের কথায় ‘এসব মুহূর্তে অনেক কিছু বুঝে নিতে হয়।’ ফরাসী রাষ্ট্রনায়ক দ্য গল যখন স্বাধীন মুক্ত ফ্রান্সে ফিরে এলেন লন্ডন থেকে তিনি সবচেয়ে বিপাকে পড়েছিলেন তাদের নিয়ে, নাৎসীদের সঙ্গে যারা সহযোগী হিসেবে জার্মান সৈন্যদের সাহায্য করেছিল; বিশেষ করে ঠরপযু সরকারের প্রধান Marshall Petain কে নিয়ে। তাকে তিনি ফাঁসির রজ্জুতে না ঝুলিয়ে যাবজ্জীবন কারাবন্দী করলেন। সেখানেই তার মৃত্যু হয়। ফরাসী রাষ্ট্রপ্রধান তখন এই কথাগুলো বলেছিলেন।
ইউসুফ হারুন সাহেবের স্ত্রীর চোখও অশ্রুসজল। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি বিজড়িত জাদুঘরে একের পর এক যখন কিউরেটর ছিদ্দিকুর রহমান সাহেব বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন আঙ্গিকে, বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছিলেন, তখন সবাই মুগ্ধ হয়ে শুনছিলেন। জুলফিকার আলী ভুট্টো, যাকে ইউসুফ হারুন খুর ভালভাবে চিনতেন, জানতেন, তার একটি ছবির কাছে এসেই থমকে দাঁড়ালেন। অর্থপূর্ণভাবে একটি অঙ্গুলি প্রদর্শন করলেন তার দিকে, আর বললেন- ‘এই তো তিনিই সবকিছুর জন্য দায়ী’।
বঙ্গবন্ধুর টিভি রুমে গিয়ে যখন দাঁড়ালাম তখন বেগম হারুন আমাকে আস্তে করে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এত সাধারণভাবে তিনি রিলাক্স করতেন’। কিছু বলার আগেই ইউসুফ হারুন সাহেব বললেন, ‘তুমি জান না যে বঙ্গবন্ধুর শোবার ঘরেও কোন এয়ারকন্ডিশনার নেই! তিনি একজন বড় নেতা ছিলেন, বড় মানুষ ছিলেন। দেশকে স্বাধীন করে তিনি মানুষের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার উন্নতি করতে চেয়েছিলেন। তিনি নিজের দৈনন্দিন জীবনের উদাহরণ দিয়ে মানুষকে উজ্জীবিত করতে চেয়েছিলেন।’
বেগম হারুন ছোটখাটো মানুষ। ছিমছাম-ফিটফাট। সোজা বঙ্গবন্ধুর বেডরুমের দিকে নজর দিলেন। সবাই এক সঙ্গে। সিদ্দিকুর রহমান সাহেব খুব মর্মস্পর্শীভাবে বললেন, কিভাবে ঘাতকরা একের পর এক পাঁচজনকে ওখানে হত্যা করল! বুলেটের ছিদ্র চারদিকে ছড়িয়ে আছে জিঘাংসার চিহ্ন হিসেবে। আবার ওরা যেন অতন্দ্র প্রহরী। এক একজন দর্শককে বলে দিচ্ছে, এই যে বাংলার ইতিহাস! জাতির পিতাকে কিভাবে এই শতাব্দীর ঘৃণ্য মীরজাফরের দল হত্যা করল। এক একটি বুলেট যেন এক একটি শতাব্দীর সাক্ষী।
বঙ্গবন্ধু বাঙালী জাতিকে বিশ্বাস করতেন। তিনি নিজে ছিলেন আত্মবিশ্বাসী। বাঙালীকেও দিতে চেয়েছেন সেই আত্মবিশ্বাস। তিনি প্রমাণ করেছিলেন যে, বাঙালীর গর্ব আছে, তার ইতিহাস আছে, আছে একটি সভ্যতা এবং নিজস্ব সত্তা। ইংরেজ লর্ড মেকলে ও কিপলিংকে তিনি প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন মিথ্যাবাদী। সেই গর্বেই তিনি বাঙালী জাতিকে দিয়েছিলেন প্রগাঢ় আস্থা ও বিশ্বাস।
শিশু রাসেলকে নির্মমভাবে হত্যা করল, তার বর্ণনা করলাম। কিভাবে সে বলেছিল, ‘আমাকে মায়ের কাছে নিয়ে চল’- আর কিভাবে তার জবাব দিল নরপশুরা! আমি কথা শেষ করার আগেই দেখলাম সবার হাতে রুমাল, চোখ ছলছল করছে। বাইরে বেরিয়েই সেই সোপনাবলী, সেই সিঁড়ি যার ওপরে বাংলার শ্রেষ্ঠ সন্তান জাতির পিতা শেখ মুজিবের বুলেট-বিদ্ধ লাশ পড়েছিল। রক্তলাল রঙের ছিটেফোঁটা এখনও আছে। হায়েনার থাবার চিহ্ন ক্ষত-বিক্ষত দেয়ালে।
কিছুক্ষণের জন্য যেন সেই লাশ আর সিঁড়ির সঙ্গে সারা বাংলার আকাশ, বাতাস আর মাটি একাকার হয়ে গেল। ইউসুফ হারুন সাহেব বঙ্গবন্ধুর খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। শেষ দেখা হয় তার অটোয়ায় কমনওয়েলথ সামিটে। ১৯৭৩ এর আগস্টে। সেখান থেকে ফেরার পথে তিনি ৪৮ ঘণ্টা জেনেভায় থেমেছিলেন। বাংলাদেশের প্রথম ঊহাড়ুং ঈড়হভবৎবহপব করেন।
খুনীদের বিচার হয়েছে শুনে সবাই জিজ্ঞেস করলেন, ‘এত দেরিতে কেন’? আমি তার উত্তর দিলাম। ১৯৭৫, ১৫ আগস্টের পর যারা ক্ষমতায় ছিলেন তারা এ বিচার চায়নি, তারা সবাই আগস্টের ঘটনার ভোগদখলকারী। শুধু তাই নয়, খন্দকার মোশতাক ওহফবসহরঃু ঙৎফরহধহপব-৫০ পাস করলেন ২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭৫-এ। যাতে খুনীদের কোন বিচার না যায়। পরে তাদেরকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কূটনীতিবিদ হিসেবে প্রেরণ করে। এই কুখ্যাত অর্ডিন্যান্স সংসদে রদ হয়েছে ১৪ নবেম্বর ১৯৯৬ সালে।
আর আমাদের সুপ্রীম কোর্টের এ্যাপিলেট ডিভিশন এ ৎবঢ়বধষ কে সমর্থন করেছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার সম্পন্নসহ দোষীদের যথাযথ শাস্তিও হয়েছে। বিদায়ের আগে ইউসুফ হারুন বললেন, এই বাসভবনটিই বাঙালীর জাদুঘর, বাঙালীর তীর্থস্থান। কারণ, এখান থেকেই বঙ্গবন্ধু স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের ঘোষণা দিয়েছিলেন ১৯৭১-এর ২৬ মার্চ-এ।
লেখক : সাবেক সচিব