ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধু জাদুঘরে কিছুক্ষণ

ওয়ালিউর রহমান

প্রকাশিত: ২১:৪৩, ১৬ আগস্ট ২০২২

বঙ্গবন্ধু জাদুঘরে কিছুক্ষণ

বঙ্গবন্ধু জাদুঘরে কিছুক্ষণ

অশ্রুসিক্ত ও বিচলিত ইউসুফ এ হারুন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ বন্ধুতিনি সস্ত্রীক, আরও কয়েকজন সঙ্গীকে নিয়ে আমাদের অতিথি হয়ে এসেছিলেন বাংলাদেশ দেখতেদেখতে এসেছিলেন জননেত্রী শেখ হাসিনাকেভিজিটরস বুক এ (Visitors Book) মন্তব্য লিখতে গিয়েই থমকে দাঁড়ালেন ইউসুফ হারুনকম্পিত হাতে চোখ মুছলেন

আমাকে বললেন, ‘করাচী পৌঁছেই আমার লেখনী আমি পাঠিয়ে দেববাংলাদেশ ডেপুটি হাই কমিশনারের মাধ্যমে পাঠাবসঙ্গের অন্য সবাইও লিখলেন সুন্দরভাবেমোহাম্মদ তারেক খান, স্পেশাল এ্যাসিস্ট্যান্ট টু চীফ মিনিস্টার ইন পেশোয়ারতিনি শামসুর রহমান খানের সমসাময়িকঢাকায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে অনেকবার সাক্ষাত হয়েছেপাকিস্তান শাসকদের কাছে তিনি কয়েকবার তিরস্কৃত হয়েছিলেনআরও লিখলেন সিনেটর আব্বাস সরফরাজ খানবয়সে অনেক ছোট কিন্তু ক্ষুরধার তীক্ষèতাতারা অনেক প্রশ্ন করলেন

অনেক উত্তর পেলেন, কিন্তু সব উত্তর তো পেলেন নাপাওয়ার কথাও নয়দ্য গলের কথায় এসব মুহূর্তে অনেক কিছু বুঝে নিতে হয়ফরাসী রাষ্ট্রনায়ক দ্য গল যখন স্বাধীন মুক্ত ফ্রান্সে ফিরে এলেন লন্ডন থেকে তিনি সবচেয়ে বিপাকে পড়েছিলেন তাদের নিয়ে, নাসীদের সঙ্গে যারা সহযোগী হিসেবে জার্মান সৈন্যদের সাহায্য করেছিল; বিশেষ করে ঠরপযু সরকারের প্রধান Marshall Petain কে নিয়েতাকে তিনি ফাঁসির রজ্জুতে না ঝুলিয়ে যাবজ্জীবন কারাবন্দী করলেনসেখানেই তার মৃত্যু হয়ফরাসী রাষ্ট্রপ্রধান তখন এই কথাগুলো বলেছিলেন

ইউসুফ হারুন সাহেবের স্ত্রীর চোখও অশ্রুসজলবঙ্গবন্ধুর স্মৃতি বিজড়িত জাদুঘরে একের পর এক যখন কিউরেটর ছিদ্দিকুর রহমান সাহেব বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন আঙ্গিকে, বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছিলেন, তখন সবাই মুগ্ধ হয়ে শুনছিলেনজুলফিকার আলী ভুট্টো, যাকে ইউসুফ হারুন খুর ভালভাবে চিনতেন, জানতেন, তার একটি ছবির কাছে এসেই থমকে দাঁড়ালেনঅর্থপূর্ণভাবে একটি অঙ্গুলি প্রদর্শন করলেন তার দিকে, আর বললেন- এই তো তিনিই সবকিছুর জন্য দায়ী

বঙ্গবন্ধুর টিভি রুমে গিয়ে যখন দাঁড়ালাম তখন বেগম হারুন আমাকে আস্তে করে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এত সাধারণভাবে তিনি রিলাক্স করতেনকিছু বলার আগেই ইউসুফ হারুন সাহেব বললেন, ‘তুমি জান না যে বঙ্গবন্ধুর শোবার ঘরেও কোন এয়ারকন্ডিশনার নেই! তিনি একজন বড় নেতা ছিলেন, বড় মানুষ ছিলেনদেশকে স্বাধীন করে তিনি মানুষের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার উন্নতি করতে চেয়েছিলেনতিনি নিজের দৈনন্দিন জীবনের উদাহরণ দিয়ে মানুষকে উজ্জীবিত করতে চেয়েছিলেন

বেগম হারুন ছোটখাটো মানুষছিমছাম-ফিটফাটসোজা বঙ্গবন্ধুর বেডরুমের দিকে নজর দিলেনসবাই এক সঙ্গেসিদ্দিকুর রহমান সাহেব খুব মর্মস্পর্শীভাবে বললেন, কিভাবে ঘাতকরা একের পর এক পাঁচজনকে ওখানে হত্যা করল! বুলেটের ছিদ্র চারদিকে ছড়িয়ে আছে জিঘাংসার চিহ্ন হিসেবেআবার ওরা যেন অতন্দ্র প্রহরীএক একজন দর্শককে বলে দিচ্ছে, এই যে বাংলার ইতিহাস! জাতির পিতাকে কিভাবে এই শতাব্দীর ঘৃণ্য মীরজাফরের দল হত্যা করলএক একটি বুলেট যেন এক একটি শতাব্দীর সাক্ষী

বঙ্গবন্ধু বাঙালী জাতিকে বিশ্বাস করতেনতিনি নিজে ছিলেন আত্মবিশ্বাসীবাঙালীকেও দিতে চেয়েছেন সেই আত্মবিশ্বাসতিনি প্রমাণ করেছিলেন যে, বাঙালীর গর্ব আছে, তার ইতিহাস আছে, আছে একটি সভ্যতা এবং নিজস্ব সত্তাইংরেজ লর্ড মেকলে ও কিপলিংকে তিনি প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন মিথ্যাবাদীসেই গর্বেই তিনি বাঙালী জাতিকে দিয়েছিলেন প্রগাঢ় আস্থা ও বিশ্বাস

শিশু রাসেলকে নির্মমভাবে হত্যা করল, তার বর্ণনা করলামকিভাবে সে বলেছিল, ‘আমাকে মায়ের কাছে নিয়ে চল’- আর কিভাবে তার জবাব দিল নরপশুরা! আমি কথা শেষ করার আগেই দেখলাম সবার হাতে রুমাল, চোখ ছলছল করছেবাইরে বেরিয়েই সেই সোপনাবলী, সেই সিঁড়ি যার ওপরে বাংলার শ্রেষ্ঠ সন্তান জাতির পিতা শেখ মুজিবের বুলেট-বিদ্ধ লাশ পড়েছিলরক্তলাল রঙের ছিটেফোঁটা এখনও আছেহায়েনার থাবার চিহ্ন ক্ষত-বিক্ষত দেয়ালে

কিছুক্ষণের জন্য যেন সেই লাশ আর সিঁড়ির সঙ্গে সারা বাংলার আকাশ, বাতাস আর মাটি একাকার হয়ে গেলইউসুফ হারুন সাহেব বঙ্গবন্ধুর খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেনশেষ দেখা হয় তার অটোয়ায় কমনওয়েলথ সামিটে১৯৭৩ এর আগস্টেসেখান থেকে ফেরার পথে তিনি ৪৮ ঘণ্টা জেনেভায় থেমেছিলেনবাংলাদেশের প্রথম ঊহাড়ুং ঈড়হভববহপব করেন

খুনীদের বিচার হয়েছে শুনে সবাই জিজ্ঞেস করলেন, ‘এত দেরিতে কেন’? আমি তার উত্তর দিলাম১৯৭৫, ১৫ আগস্টের পর যারা ক্ষমতায় ছিলেন তারা এ বিচার চায়নি, তারা সবাই আগস্টের ঘটনার ভোগদখলকারীশুধু তাই নয়, খন্দকার মোশতাক ওহফবসহরঃু ঙফরহধহপব-৫০ পাস করলেন ২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭৫-এযাতে খুনীদের কোন বিচার না যায়পরে তাদেরকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কূটনীতিবিদ হিসেবে প্রেরণ করেএই কুখ্যাত অর্ডিন্যান্স সংসদে রদ হয়েছে ১৪ নবেম্বর ১৯৯৬ সালে

আর আমাদের সুপ্রীম কোর্টের এ্যাপিলেট ডিভিশন এ বঢ়বধষ কে সমর্থন করেছেবঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার সম্পন্নসহ দোষীদের যথাযথ শাস্তিও হয়েছেবিদায়ের আগে ইউসুফ হারুন বললেন, এই বাসভবনটিই বাঙালীর জাদুঘর, বাঙালীর তীর্থস্থানকারণ, এখান থেকেই বঙ্গবন্ধু স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের ঘোষণা দিয়েছিলেন ১৯৭১-এর ২৬ মার্চ-এ

 

          লেখক : সাবেক সচিব

×