
আলোচনায় ডলার
আমদানি খরচ বাড়ায় গত মে মাস থেকে দেশে ডলারের সঙ্কট চলছে। ব্যাংক থেকে জানা যায়, তাদের কাছে ১ কোটি ১০ লাখ নগদ ডলার মজুত আছে। অন্য সময়ে থাকে ৩ কোটি ডলারের বেশি। এসব ডলার দেওয়া হয় তাদের নিজস্ব গ্রাহকদের। পাশাপাশি কার্ডে ডলার খরচের বিষয়ে গ্রাহকদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। ফলে যে কোন নাগরিকের ব্যাংক থেকে ডলার দেওয়ার সুযোগ কম।
চলতি মাসের প্রথম সাত দিনে ৫৫ কোটি ডলার প্রবাসী আয় এসেছে। আমদানি কমায় এবং প্রবাসী ও রফতানি আয় বাড়ায় ডলার-সঙ্কট কেটে যাওয়ার আশা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে ছয় শীর্ষ ব্যাংকের ট্রেজারি প্রধানদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে যেতে পারে। কারণ, ট্রেজারি প্রধানরাই ডলার সংগ্রহে প্রধান ভূমিকা রাখেন। ট্রেজারি প্রধানদের ছাড়া ব্যাংকের কার্যক্রম কীভাবে চলবে, এ নিয়েও জটিলতায় পড়েছে ব্যাংকগুলো। করোনার প্রকোপের আগে চীন রফতানি সক্ষমতা ধরে রাখতে তাদের মুদ্রার বড় ধরনের অবমূল্যায়ন করেছিল।
২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত চীন অবমূল্যায়ন করেছিল ৩৩ শতাংশ। চীনের সেই সিদ্ধান্তের কারণে প্রতিযোগী দেশগুলোও একই পথে হাঁটতে বাধ্য হয়েছিল। তখন তাকে বলা হয়েছিল মুদ্রাযুদ্ধ। ব্যতিক্রম ছিল বাংলাদেশ। তখনও কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকার মূল্যমান ধরে রাখে। রফতানিকারকের পক্ষ থেকে টাকার অবমূল্যায়নের দাবি উঠলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকার মান ধরে রাখার নীতিতেই অটল ছিল। অথচ অর্থনীতি ছিল যথেষ্ট স্বস্তিদায়ক অবস্থায়।
সেই টাকা ঠিকই অবমূল্যায়ন করতে বাংলাদেশ ব্যাংক বাধ্য হলো কঠিন এক সময়ে। গত সাত মাসে টাকার দর কমেছে ডলারপ্রতি ৮ টাকা ৯০ পয়সা। তারপরও সঙ্কট মিটছে না। আগে থেকেই অল্প অল্প করে অবমূল্যায়ন করা হলে এখনকার সঙ্কট এত বড় হতো না।
করোনাপরবর্তী চাহিদার কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রায় সব ধরনের পণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। দেশের ভেতরেও পণ্যের চাহিদা বেড়েছে। ফলে বেড়েছে আমদানি। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে আমদানি ব্যয়ের বড় অংশই মেটানো হয়। ফলে রিজার্ভের ওপর হঠাৎ করে চাপ বেড়ে গেছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিতে কখনও এখনকার মতো পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়নি। বিশেষ করে ডলার নিয়ে অনিশ্চয়তায় ব্যবসা চালানো এখন কঠিন হয়ে পড়ছে।
ডলারের দর কাল কত হবে, তার কোন নিশ্চয়তা নেই। এমন অবস্থায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিতে খরচ কত হবে, বাজারে দাম পাওয়া যাবে কি না, বিক্রি করে ব্যাংকের টাকা শোধ করা যাবে কিনা তার হিসাব মেলানো যাচ্ছে না। এ অবস্থায় বাধ্য হয়ে আমদানি কমিয়ে ফেলতে হচ্ছে। এ তো গেল ডলারের দামে অস্থিরতা। কাস্টমস কর্তৃপক্ষ আগস্ট মাসের ডলারের নতুন বিনিময় হার প্রকাশ করেছে। বিনিময় হার বৃদ্ধি পাওয়ায় পণ্যের এবার শুল্ক-করও বাড়তি দিতে হবে। আমদানি নিয়ন্ত্রণ করে ডলার-সঙ্কট কাটানো যাবে না।
তার চেয়ে বিলাস পণ্যে বরং কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা উচিত। সরকার বিলাসপণ্য ও অপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করতে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। এটা খুবই ভাল উদ্যোগ। আরও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হোক। তবে শিল্পের কাঁচামালের ঋণপত্র যাতে সহজে খোলা যায়, সে জন্য সরকারের তদারকি থাকা দরকার। কারণ, কাঁচামাল আমদানি স্বাভাবিক না থাকলে সামনে কারখানার উৎপাদন ব্যাহত হবে। এজন্য ডলারের দাম যাতে স্থিতিশীল থাকে, সে জন্য সরকারের দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
ব্যাংকে ডলারের চাপ কমে আসার আশা করছেন ব্যাংক কর্মকর্তারা। কারণ, জুন মাসের তুলনায় জুলাই মাসে আমদানি ঋণপত্র খোলা কমেছে ৩১ দশমিক ৩২ শতাংশ। জুন মাসে ঋণপত্র খোলা হয়েছিল ৭৯৬ কোটি ডলারের, জুলাই মাসে যা কমে হয়েছে ৫৪৭ কোটি ডলার। আমদানি নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়ার পর কমেছে ঋণপত্র খোলা। করোনার ধাক্কা কাটার পর বিদেশে ঘোরাঘুরিও বেড়েছে, এতে বেড়েছে ভ্রমণ খরচ।
আবার বিদেশে চিকিৎসা ও শিক্ষার পেছনেও খরচ বেড়েছে। ফলে এসব খাতে ডলার খরচ বেড়ে গেছে। ফলে ২০২০-২১ অর্থবছরে এসব খাতে বাংলাদেশের যে ডলার খরচ হয়েছিল, গত ২০২১-২২ অর্থবছরে তার চেয়ে ৩৩ শতাংশ বেশি ডলার খরচ হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর অভিযানে নগদ ডলারের তেজ কিছুটা কমেছে। ডলারের দাম নিয়ে কারসাজির বিষয়টি অত্যন্ত উদ্বেগজনক।
বস্তুত অর্থনীতির নানা কারণে ডলারের দামের হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটা একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কিন্তু যখন এক্ষেত্রে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করা হয়, তখনই তা হয় বিপত্তির কারণ। ডলারের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির প্রভাব শুধু নিত্যপণ্যের বাজারেই পড়ছে না, এর অজুহাতে প্রতিটি সেবা ও সামগ্রীরই দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সার্বিকভাবে এটি দেশের অর্থনীতির জন্যই ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক অবশ্য রিজার্ভ থেকে ডলার ছেড়ে বাজার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। তবে এ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে ভাল উপায় হলো আমদানি ব্যয় কমানোর উদ্যোগ নেওয়া। ভোগ্যপণ্যের ক্ষেত্রে দ্রুততম সময়ে আমদানি ব্যয় কমানোর কাজটি কঠিন হলেও বিলাসী পণ্যের ক্ষেত্রে আমদানি ব্যয় কমানোর উদ্যোগ নেওয়া সহজেই সম্ভব। অবশ্য এ ব্যাপারে সরকার কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে ইতোমধ্যেই। এ সময়ে আমদানিনির্ভর নতুন বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করার বিষয়টিও বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে। এছাড়া রফতানি আয় এবং রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়া দরকার জোরেশোরে।
পুঁজিবাজারে অস্থিরতা এবং ব্যাংক আমানতের সুদের হার কম হওয়ায় অনেক সাধারণ মানুষও হয়তো ডলার কিনে মজুত করছেন পরে দামবৃদ্ধির আশায়। সামগ্রিকভাবে এর পরিমাণ হয়তো খুব বেশি নয়; তবে বিষয়টি মাথায় রেখে মানুষের সঞ্চয়ের সুযোগ আরও সম্প্রসারিত করা উচিত। অনাবাসী বৈদেশিক মুদ্রা হিসেবে ডলারে আমানত রাখলে তার ওপর এখন বেশি সুদ দেবে ব্যাংকগুলো।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই সুদের হার নির্ধারণ করে দিয়েছে। এতে করে ডলারে আমানতকারীরা ৪ থেকে ৫ শতাংশ পর্যন্ত সুদ পাবেন। এই আমানতে সুদের হার নির্ধারণের ফলে প্রবাসী বাংলাদেশীরা অনাবাসী বৈদেশিক মুদ্রা হিসেবে অর্থ জমা করতে আগ্রহী হবেন। এতে ব্যাংকগুলোর কাছে ডলারের আমানত বাড়বে। ডলারের বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক সর্বাত্মক পদক্ষেপ নেবে, এটাই কাম্য। চলমান ডলার সঙ্কটের কারণে গোটা অর্থনীতিতে এক ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে।
ডলার সঙ্কটের নাটকীয়তা, আর কতদিন? যা দীর্ঘ সময় ধরে চলতে পারে না। এই সঙ্কট কাটাতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। অর্থনীতিতে দীর্ঘ সময় ধরে তেমন অস্থির অবস্থা চলতে থাকলে তার প্রভাবে জটিলতার মাত্রা আরও বাড়বে বই কমবে না- এটা অনুধাবন করতে হবে এখনই।