বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
১৯৪৭-এর ভারত বিভক্তি এবং পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশের রাজধানী ঢাকা হওয়ায় নতুন করে সাংস্কৃতিক চর্চা শুরু হয় বিশেষ করে ভারতের বিভিন্ন স্থান থেকে আগত মুসলিম উদ্যোক্তাদের সহযোগিতায়। আব্দুল জব্বার খান ১৯৫৪ সালে মুখ ও মুখোশ ছবির কাজ শুরু করেছিলেন। এটি মুক্তি পায় ৩ আগস্ট, ১৯৫৬ সালে, যা বাংলা সিনেমার জগতে একটি উজ্জ্বল পদক্ষেপ বলে বিবেচিত। সবাক চলচ্চিত্র হিসেবে যদি এটিকে ভিত্তি ধরা হয় তবে ৬০ বছর অতিক্রম করেছে দেশের চলচ্চিত্র শিল্প। সেই সময় প্রয়োজন দেখা দিল একটি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর। যুক্তফ্রন্ট তখন পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক সরকারের ক্ষমতায় আসীন, যার বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রী ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
১৯৫৭ সালের কথা। যখন এদেশের মাত্র কয়েকজন মানুষ চলচ্চিত্র নির্মাণে চিন্তা-ভাবনা শুরু করছিলেন, বঙ্গবন্ধুও তাদের সহযাত্রী ছিলেন। পাকিস্তান শাসনামলে চলচ্চিত্র সচেতন কয়েক ব্যক্তি দেশের চলচ্চিত্র সম্পর্কে নানা সমস্যার প্রসঙ্গ উত্থাপনপূর্বক বঙ্গবন্ধুর কাছে চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা প্রতিষ্ঠার অনুরোধ করছিলেন। ফলে চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা প্রতিষ্ঠাও অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। বঙ্গবন্ধু এই অনিবার্যতাকে উপলব্ধি করেই চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তৎকালীন আগ্রহী অন্যদের মতোই উৎসাহী হয়েছিলেন। যারা বঙ্গবন্ধুর কাছে চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা প্রতিষ্ঠার তদবির করতে গিয়েছিলেন, তাদের অবাক করে দ্রুত সংশ্লিষ্টদের বসিয়ে ওয়ার্কিং পেপার প্রস্তুত করে দিতে বলেছিলেন তিনি। চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে এই উত্তেজনায় তারা দ্রুতই ওয়ার্কিং পেপার বঙ্গবন্ধুর কাছে জমা দিয়েছিলেন।
এফডিসি প্রতিষ্ঠার জন্য যাদের অদম্য আগ্রহ ছিল তাদের অন্যতম ছিলেন নাজির আহমদ। তিনি লিখেছেন- আমার স্পষ্ট মনে আছে অধিবেশনের শেষদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইপিএফডিসি প্রতিষ্ঠার জন্য বিল পরিষদে অনুমোদনের জন্য পেশ করেছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে বিনা বাধায় বিলটি পাস হয়ে যায়। তখন উৎফুল্লিত শেখ সাহেব বলেছিলেন ‘এফডিসি তো হয়ে গেল, আসগর আলী শাহকে চেয়ারম্যান বানিয়ে দিয়েছি ও আবুল খায়েরকে এমডি। এখন চলচ্চিত্রেরে জন্য কাজ করুন গিয়ে।’ তাঁর উৎসাহ না থাকলে বোধ হয় দেশে এফডিসির জন্ম হতো না। আর হলেও হতো অনেক দেরিতে।
বর্তমান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীও চলচ্চিত্র ভালবাসেন। বঙ্গবন্ধুও ভালবাসতেন। জাতির পিতার হাতেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এফডিসি। বাঙালীর নিজস্ব শিল্প-সংস্কৃতি চর্চায় তাঁর বৈচিত্র্যময় উদ্যোগে এফডিসি প্রতিষ্ঠা। এফডিসি প্রতিষ্ঠার পর ফতেহ লোহানী পরিচালিত প্রথম ছবি আকাশ আর মাটি (১৯৫৯) ও দ্বিতীয় ছবি আসিয়া মুক্তি পায় ১৯৬০ সালে, যা তদানীন্তন পাকিস্তানে শ্রেষ্ঠ বাংলা ছবি হিসেবে পুরস্কৃত হয়েছিল।
এফিডিসি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এদেশে চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু হলেও শিল্পটি সর্বদা সঠিক পথে চলতে পারেনি। স্বাধীন দেশের চলচ্চিত্র শিল্প নিয়েও বঙ্গবন্ধুর উদ্বিগ্নতা আমরা দেখেছি। তবে দুষ্ট ব্যবসায়ী বুদ্ধির বিপরীতে স্বাধীন দেশের চলচ্চিত্র শিল্পও স্বাধীনভাবে বিকশিত হতে পারেনি।
স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে যদি আমরা বিশ্লেষণ করি, তা হলে একটি মিশ্র ফলাফল লক্ষ্য করি। বিচার, বিশ্লেষণে সত্তরের দশকটি ছিল এই শিল্পের সোনালি যুগ। এই পর্বে অনেক ভাল ছবি তৈরি হয়েছে। যেমন- আদম সুরত, মাটির ময়না, আগুনের পরশমণি, শ্রাবণ মেঘের দিন, ওরা এগারোজন, গেরিলা, সংশপ্তক, নীল আকাশের নিচে, গোলাপী এখন ট্রেনে, বিন্দু থেকে বৃত্ত ইত্যাদি। বাংলাদেশ-ভারত যৌথ প্রযোজনায়ও অনেক ভাল ছবি তৈরি হয়েছে। যেমন- পালঙ্ক, তিতাস একটি নদীর নাম, পদ্মা নদীর মাঝি, মনের মানুষ, শঙ্খ চিল, দহন ইত্যাদি। এর পরও সঙ্কট কাটেনি বিভিন্ন অনিয়ম-অব্যবস্থার কারণে, যা কোনভাবেই আমাদের শিল্প সংস্কৃতির সঙ্গে সহায়ক ছিল না। ফলে দর্শকরা সিনেমা হলমুখী না হয়ে ঘরমুখী হয়েছে।
বাংলাদেশের চেয়ে দুর্বল অর্থনীতির দেশ নেপালেও ১৮০টি সিনেমা হলের মধ্যে ৫৮টি সিনেপ্লেক্স রয়েছে। বাংলাদেশে ১৯৯০ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ১২০০টি সিনেমা হল ছিল, যা ২০২০ সালে দাঁড়িয়েছে ১৯৪টিতে (সূত্র : ইউএনবি নিউজ, সেপ্টেম্বর, ২০২০)। সরকার ২০১২ সালের ২ এপ্রিল এক নির্বাহী আদেশে চলচ্চিত্রকে শিল্প ঘোষণা করেছে; যাতে উল্লেখ আছে, অন্যান্য শিল্পের মতোই যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা পাবে এই শিল্প। কিন্তু এই শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যন্ত্রপাতি আমদানি করার কোন সুযোগ-সুবিধাই পাওয়া যাচ্ছে না। চলচ্চিত্র শিক্ষায় সঙ্কট এই শিল্পের বড় দুর্বলতা। সম্প্রতি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বিষয়ে পাঠদান ও গবেষণা মাত্র শুরু হয়েছে। যার সুফল পেতে আমাদের অনেকদিন অপেক্ষা করতে হবে।
কারণ, এসব শিক্ষার্থীর কতজনইবা এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত থাববে, তা ভেবে দেখার বিষয়। সরকারের ফিল্ম আরকাইভস ও এ ইনস্টিটিউট কি কাজ করছে তা বোঝা যায় না। দেশের নায়ক-নায়িকারা, যারা বর্তমানে এই শিল্পে কাজ করছে, তাদের অনেকেরই প্রাতিষ্ঠানিক কোন প্রশিক্ষণ নেই বললেই চলে। ঢাকার কবিরপুরে বঙ্গবন্ধু ফিল্ম ইনস্টিটিউট করার কথা সরকারের রয়েছে। যেখানে ভারতের পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউটের আদলে যদি করা যায় তাহলে চলচ্চিত্র শিক্ষা ও গবেষণায় অনেক গতি আসবে। কারণ, চলচ্চিত্র হচ্ছেÑ সঙ্গীত, সাহিত্য, চিত্রকলা, আলোকচিত্র ইত্যাদির মৌলিক শিল্প মাধ্যমের একটি রূপ।
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চলচ্চিত্র শিল্পের উন্নয়নের জন্য এক হাজার কোটি টাকার তহবিল ঘোষণা করেছেন। চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট অবকাঠামো নির্মাণ এবং উন্নয়নের জন্য অল্প সুদে এই তহবিল ব্যয়িত হবে। চলচ্চিত্র নির্মাতারা প্রধানমন্ত্রীর উপদেশ যদি মেনে চলেন, তাহলেই হয়ত গতি আসবে চলচ্চিত্র শিল্পে। এখনকার সিনেপ্লেক্সগুলোতে মানুষ যখন যায় তখন বাংলা থেকে ইংরেজী সিনেমাই বেশি দেখতে যায়। কারণ, সিনেপ্লেক্সে খুব কম বাংলা সিনেমা দেখানো হয়। আর হলেও অত টাকা খরচ করে বাংলা সিনেমা দেখতে ইচ্ছা করে না। কারণ, একটা বাংলা সিনেমা শুরু হলে গল্পের শেষে কী হবে তা আগেই আঁচ করা যায়। আমাদের ভাল কনটেন্টের অভাব প্রকট।
দেশের সুস্থ ধারার চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে একটি বড় অংশজুড়ে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক চলচ্চিত্র। ওরা ১১ জন, সংগ্রাম, একাত্তরের যীশু, হাঙ্গর নদী গ্রেনেডে যেমন উঠে এসেছে যুদ্ধের ভয়াবহতা, তেমনি আছে মাতৃভূমিকে ভালবাসার এক অকৃত্রিম দেশপ্রেম। শিশুদের জন্য সিনেমা নির্মাণ হওয়াও সময়ের দাবি। শিশুতোষ চলচ্চিত্র বা এ্যানিমেশনের অভাবে আমাদের সোনামণিরা বিদেশী এ্যানিমেশন বা কার্টুন-গেমসে আসক্ত হয়ে পড়ছে। তাতে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম আরও চলচ্চিত্রবিমুখ হবে বলেই মনে করা হচ্ছে। বাংলা চলচ্চিত্রের অতীতের সোনালি ইতিহাসকে সামনে রেখে এখন দেশের বিভিন্ন সরকারী ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চলচ্চিত্র, সঙ্গীত ও নাট্যকলা বিভাগ খোলার কাজ অব্যাহত রয়েছে। সেখান থেকে প্রশিক্ষিত শিক্ষার্থীরা দেশের চলচ্চিত্র অঙ্গনকে অচিরেই দেশে-বিদেশে প্রতিযোগিতায় নিয়ে যাবে, এই প্রত্যাশা রইল।
লেখক : অধ্যাপক ও ডিন, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা