ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধুর জীবনে রবীন্দ্রনাথ

গোলাম কুদ্দুছ

প্রকাশিত: ২২:৫০, ৫ আগস্ট ২০২২; আপডেট: ১০:৫৫, ৬ আগস্ট ২০২২

বঙ্গবন্ধুর জীবনে রবীন্দ্রনাথ

.

আপাদমস্তক দু’জন খাঁটি বাঙালীর নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। একজন বাঙালী জাতিরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা, আরেকজন বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির মূল স্তম্ভ। বঙ্গবন্ধুর জন্মের সাত বছর আগে নোবেল পুরস্কার অর্জন করে রবীন্দ্রনাথ বিশ্বসভায় বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির গৌরব ও মাহাত্ম্যকে তুলে ধরেছেন, আর বঙ্গবন্ধু তাঁর আটান্ন বছর পর বাঙালীর জাতিরাষ্ট্র ‘বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠা করে বাঙালী জাতিকে শিরদাঁড়া টানটান করা আত্মমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
রবীন্দ্রনাথের বাঙালীর দেশপ্রেম, সুন্দরের আরাধনা, প্রকৃতিপ্রেম, মানবিকবোধ বঙ্গবন্ধুকে ভীষণভাবে নাড়া দিত। আর সে কারণেই আমরা প্রত্যক্ষ করি যখনই বঙ্গবন্ধু কোন সঙ্কটে পড়েছেন তখনই তিনি রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করেছেন, তার থেকে শক্তি সঞ্চয় করেছেন। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু তখন পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর রোষানলে পড়ে কারাগারের অন্ধ পরাকাষ্ঠে বন্দী। বাঙালীর মুক্তি ও আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের দাবি করা তাঁর অপরাধ। বঙ্গবন্ধু কারাগারে বসে তাঁর ডায়ারিতে রবীন্দ্রনাথ থেকে কিভাবে শক্তি সঞ্চয় করেছিলেন সে বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন-
‘আমাকে প্রথম শ্রেণীর কয়েদি করা হয়েছে। রোজ খাবার আড়াই টাকার মতো পাব। একলা থাকি একলাই পাক করে খাই। কি করে চলবে! যারা আমার খানা পাক করে আর যারা আমার দেখাশোনা করে তাদের রেখে তো কোনদিন কিছু খাই না।
জামিন দিল না। আজ থেকে আমি সাজাপ্রাপ্ত কয়েদি। তবে দেশরক্ষা আইনে বিনা বিচারের আদেশও থাকবে যদি জামিন পাই। জজকোর্টে আপীল করার পরে আবার দেশরক্ষা আইনে বিনা বিচারে জেলে থাকতে হবে। আমার পক্ষে সবই সমান। আর একটা মামলায়ও আমার জেল আছে আড়াই বছর। সেটাও বক্তৃতা মামলা, হাইকোর্টে পড়ে আছে। কনফার্ম করেছে এক বছর খাটতে হবে যদি হাইকোর্ট থেকে মুক্তি না পাই। বুঝতে পারলাম আরও যে ছয়-সাতটা বক্তৃতার মামলা আছে সব মামলাই নিচের কোর্টে আমাকে সাজা দেবে। শুধু মনে মনে বললাম :
‘বিপদে মোরে রক্ষা কর/এ নহে মোর প্রার্থনা।/বিপদে আমি না যেন করি ভয়।’কবিগুরুর এ কথাটা আমার মনে পড়ল।’ [সূত্র : কারাগারের রোজনামচা- শেখ মুজিবুর রহমান- পৃষ্ঠা: ২৩০-৩১]
ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের চূড়ান্ত পর্যায়ে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান নিঃশর্তভাবে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে দায়েরকৃত ‘আগরতলা ষড়তন্ত্র মামলা’ প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হন। ২২ ফেব্রুয়ারি ’৬৯ বঙ্গবন্ধু বন্দীদশা থেকে বেরিয়ে এলেন। ২৩ ফেব্রুয়ারি ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমেদ বাঙালীর অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেন। সে বিশাল সমাবেশে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বলেন-‘... আমরা মির্জা গালিব, সক্রেটিস, শেক্সপীয়র, এরিস্টটল, লেনিন, মাও সে তুং পড়ি জ্ঞান আরোহণের জন্য। আর দেউলিয়া সরকার আমাদের পাঠ নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথের লেখা, যিনি একজন বাঙালী কবি ও বাংলায় কবিতা লিখে যিনি বিশ্বকবি হয়েছেন। আমরা এই ব্যবস্থা মানি না- আমরা রবীন্দ্রনাথের বই পড়বই, আমরা রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইবই এবং রবীন্দ্র সঙ্গীত এদেশে গীত হবেই।’
বঙ্গবন্ধু যখন কারাগারে তখন পাকিস্তান সরকার রবীন্দ্র সঙ্গীত নিষিদ্ধের ষড়যন্ত্র করেছিল। তাদের এই ষড়যন্ত্র বঙ্গবন্ধুকে কিভাবে নাড়িয়ে দিয়েছিল যে, মৃত্যুমুখ থেকে ফিরে এসে জনসম্মুখে প্রদত্ত প্রথম ভাষণেই বঙ্গবন্ধু এই প্রসঙ্গটিকে অতীব গুরুত্বসহকারে উপস্থাপন করেন। বস্তুতপক্ষে বঙ্গবন্ধুর চিন্তা-চেতনা এবং মননে রবীন্দ্রনাথের সুদূরপ্রসারী প্রভাব আমরা আরও বহুক্ষেত্রেই প্রত্যক্ষ করি।
১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করে লন্ডনে পৌঁছান। বঙ্গবন্ধু তাঁর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ঢাকা আসার পথে দিল্লী যাওয়ার কথা জানালেন। ভারতীয় দূতাবাসের নির্দেশে কূটনীতিক শশাঙ্ক এস ব্যানার্জী বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী হন। পরবর্তীতে মিস্টার ব্যানার্জী বিমানে বঙ্গবন্ধুর সহযাত্রী হয়ে লিখেছেন যে, বঙ্গবন্ধু বিমানে বসে ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ গাইতে শুরু করেন। তাঁর সঙ্গে মিস্টার ব্যানার্জীকেও গানটি গাইতে অনুরোধ করেন। মিস্টার ব্যানার্জী আরও লিখেছেন যে, গানটি গাইবার সময় বঙ্গবন্ধুর দুই চোখ ছিল অশ্রুসিক্ত। বঙ্গবন্ধু তাকে বলেছিলেন, এই গানটি বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হওয়া উচিত।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু যখন পাকিস্তানী কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে এলেন ঢাকা সেদিন এক আবেগঘন আনন্দ-বেদনার মিশ্রণে মেতে উঠেছিল। ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে জনস্রোত ঠেলে বঙ্গবন্ধু সরাসরি এলেন ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ যে মাঠে তিনি ঘোষণা করেছিলেন ‘... প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল... এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
তারপরের ইতিহাস আমাদের জানা। বঙ্গবন্ধুর কারাবন্দী জীবন, ৩০ লাখ মানুষের আত্মদান, কয়েক লাখ নারীর সম্ভ্রম হারানো, জীবন বাঁচাতে এক কোটি মানুষের বাস্তুভিটা ত্যাগ করে শরণার্থী জীবন গ্রহণ। সবই জানলেন বঙ্গবন্ধু। বাঙালীর আত্মত্যাগ, দেশপ্রেম আর সাহসিকতায় গর্বিত বঙ্গবন্ধু রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করে সেদিন বললেন-
“... কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন- ‘সাত কোটি সন্তানের হে মুগ্ধ জননী, রেখেছো বাঙালী করে মানুষ করোনি।’ কবিগুরুর সে আক্ষেপকে আমরা মোচন করেছি। বাঙালী জাতি প্রমাণ করে দিয়েছে যে, তারা মানুষ, তারা প্রাণ দিতে জানে।”
১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু এক রাষ্ট্রীয় সফরে ভারত যান। সেখানে কলকাতার ‘গড়ের মাঠে’ স্মরণকালের এক বিশাল সমাবেশে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বক্তব্য রাখেন। পাকিস্তান কর্তৃক তখনও বাংলাদেশ বিরোধী ষড়যন্ত্র সম্পর্কে হুঁশিয়ারি দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমার বললেন-
বিনা অস্ত্রে যদি আমার বাংলার মানুষ আমার অনুপস্থিতিতে সংগ্রাম করে স্বাধীনতা নিয়ে থাকতে পারে, আজ বাংলাদেশকে নিয়ে যদি ষড়যন্ত্র করতে চাও, আর কোন খেলা খেলতে চাও, মনে রেখ সাত কোটি বাঙালীর একটা প্রাণ বেঁচে থাকতে বাংলার মাটিতে ঢোকার ক্ষমতা তোমাদের নেই।
সেজন্য আমার কবিগুরুর একটা কবিতা পড়তে হয় যে-
‘নাগিনীরা চারদিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিঃশ্বাস,
শান্তির ললিতবাণী শোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস।/বিদায় নেবার আগে তাই/ডাক দিয়ে যাই/দানবের সঙ্গে যারা সংগ্রামের তরে প্রস্তুত হতেছে ঘরে ঘরে।’
১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক ভাষণ প্রদান করেন। সমকালীন বিশ্বে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর অস্ত্র প্রতিযোগিতা, অসম বাণিজ্যনীতি এবং আগ্রাসী দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনা করে বঙ্গবন্ধু বলেন-
‘... তোমরা অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধ করো। ওই সম্পদ দুনিয়ার দুঃখী মানুষকে বাঁচানোর জন্য ব্যয় করো। তাহলে দুনিয়ায় শান্তি ফিরে আসবে।’ এর পরেই বঙ্গবন্ধু উচ্চারণ করেন রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত উক্তি-
‘হে মোর দুর্ভাগা দেশ যাদের/করেছো অপমান/অপমানে হতে হবে তাদের/সবার সমান।’
বঙ্গবন্ধু ও রবীন্দ্রনাথের জীবনে আমরা মিল খুঁজে পাই তাঁদের দেশপ্রেম এবং স্বাধীনতার প্রশ্নে। ১৯০৫ সালে ব্রিটিশ সরকার বঙ্গভঙ্গ আইন পাস করে বাংলাকে ভাগ করলে তার বিরুদ্ধে আন্দোলনে সক্রিয় হলেন রবীন্দ্রনাথ। কলকাতার ‘মহাজাতি সদনে’ প্রতিবাদে নিজেই গাইলেন ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’। রচনা করলেন মাতৃভূমির বন্দনা করে ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’সহ অসংখ্য গান, কবিতা। মৈত্রির বন্ধনে বাঙালীকে আবদ্ধ করার জন্য সূচনা করলেন ‘রাখি বন্ধনের’। এ রাখি বন্ধনের মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ নারী-পুরুষ, হিন্দু-মুসলমান, বাঙালী-অবাঙালী নির্বিশেষে সকল মানুষের মধ্যে একটি মৈত্রীর বন্ধন গড়ে তুলতে চেয়েছেন। চূড়ান্ত বিচারে মানুষের মুক্তি, মানুষের কল্যাণই ছিল তাঁর সকল সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য।
বঙ্গবন্ধু সারাটি জীবন স্বদেশপ্রেমে আচ্ছন্ন থেকে অসাম্প্রদায়িক মানবিক সমাজ বিনির্মাণে রবীন্দ্রনাথের পথেই হেঁটেছেন। বাঙালী জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং মানবিকবোধ ও শৈল্পিক বিকাশে বঙ্গবন্ধু আপোসহীনভাবে লড়াই করেছেন। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েছেন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রিত্বের পদ প্রত্যাখ্যান করেছেন, বিপরীতে আঁকড়ে ধরেছেন মানুষ, মনুষ্যত্ব আর জাগতিক বিশ্বের সব সুন্দরকে। রবীন্দ্রনাথ আর বঙ্গবন্ধুর জীবনাদর্শ এক ও অভিন্ন স্রোতধারায় প্রবাহিত নদীর মতো।

রবীন্দ্রনাথের স্বদেশিকতা ও বিদেশী পণ্য বর্জন
এবং বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলন
বহুক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ এবং বঙ্গবন্ধুর চিন্তায় দার্শনিকভাব প্রত্যক্ষ করা যায়। আমরা যে কোন ঘটনা বা বক্তব্যের শুধু তাৎক্ষণিক বা বস্তুগত দিকটা দেখি। তার সুদূরপ্রসারী প্রতিক্রিয়া বা অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য বুঝতে ব্যর্থ হই। পরবর্তী প্রজন্ম বা গবেষকরা মহান ব্যক্তিত্বদের মৌলিক ভাবনাটি আবিষ্কারের চেষ্টায় ব্রতী হলে আমাদের ভাবনার জানালা খুলে যায় এবং নতুন ব্যাখ্যায় ব্যাখ্যায়িত করতে সমর্থ হই। এ নিয়ে ভিন্নমত হতেই পারে, কিন্তু এও তো সত্য যে, ভিন্নমত না থাকলে সত্যকে নিক্তি দিয়ে মাপা যায় না। যার কারণে আমার ধারণা ‘যুক্তি পরম সত্য, যুক্তির চাইতে বড় সত্য পৃথিবীতে আর কিছু নেই।’
১৯০৫ সালে বঙ্গ বিভক্তির পর এর রোধকল্পে রবীন্দ্রনাথ বহু কর্মসূচীতে অংশ নেন। তাঁর স্বদেশ পর্যায়ের বিখ্যাত গান-কবিতার অনেক সে সময়েই রচিত হয়। বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে ১৯০৫ সালের ৭ আগস্ট কলকাতার টাউনহলে সর্বস্তরের মানুষের এক সমাবেশ থেকে স্বদেশী আন্দোলন ও বিদেশী পণ্য বর্জনের ডাক দেয়া হয়। ২৫ আগস্ট অনুষ্ঠিত আরেক সমাবেশে রবীন্দ্রনাথ ‘অবস্থা ও ব্যবস্থা’ প্রবন্ধটি পাঠ করেন। এ প্রবন্ধে তিনি স্বদেশী আন্দোলন ও বিদেশী পণ্য বয়কট সংক্রান্ত বক্তব্যে অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য আবিষ্কারে সচেষ্ট হন। তাৎক্ষণিক আবেগ-উত্তেজনার লাগাম টেনে ধরা এবং বিতর্কের অবসানে এ প্রবন্ধের গুরুত্ব অপরিসীম।
১৯৭১ সালের ১ মার্চ পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান কর্তৃক নবনির্বাচিত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করলে বঙ্গবন্ধু লাগাতার অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। ঐতিহাসিক ৭ মার্চ ১৯৭১ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে প্রায় ১০ লক্ষ লোকের এক সমাবেশে বাঙালী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মূল নেতা, পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে বিজয়ী সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ঘোষণা করেন অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচী।
রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ এবং বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলনের ভাষণ যদি আমরা বিশ্লেষণ করি তাহলে এ দুইয়ের পরতে পরতে আছে বাঙালীর আত্মসচেতনতা, আত্ম আবিষ্কার ও স্বদেশপ্রেম। নিজেকে চেনা, কর্তব্য নির্ধারণ এবং দূর লক্ষ্য উভয়ের এক ও অভিন্ন। প্রায়োগিক ব্যাখ্যা আর অন্তর্নিহিত ভাব প্রায়শই আমরা বুঝতে ব্যর্থ হই। বঙ্গবন্ধু যখন বলেন আমরা ভাতে মারব, পানিতে মারব, তখন আমরা শুধু বর্তমানকে দেখি। বঙ্গবন্ধু যখন আবার বলেন তোমরা আমাদের ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাক, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না তখন ভিন্ন এক বঙ্গবন্ধুকে আমরা দেখতে পাই, যে বঙ্গবন্ধু নীলকণ্ঠ হয়ে সকল অন্যায় যন্ত্রণাকে মাহাত্ম্যের বিশালতায় ধারণ করতে পারেন। বঙ্গবন্ধু ও রবীন্দ্রনাথের চিন্তার বিশালতা এবং মানবিকবোধ আমাদের সমাজে কিছুটা ছায়া ফেলতে পারলে জাতির অশেষ মঙ্গল সাধিত হবে।

রবীন্দ্রনাথ ও বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত

জাতিসত্তার বিকাশে সাহিত্য ও সংস্কৃতির অবদান সবচাইতে বেশি। কারণ এর মধ্য দিয়েই জাতির বিকাশ, নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও সংগ্রামী চেতনার অভ্যুদয় ঘটে। বঙ্গভঙ্গ, স্বদেশী আন্দোলন, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াইÑ সকল ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ আমাদের নেতৃত্ব দিয়েছেন মনোবিকাশের মধ্য দিয়ে।
পাকিস্তানী প্রায় ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে বাঙালীর ২৩ বছরের লড়াইয়ে অন্যতম প্রেরণাদাতা ছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর সাহিত্যের নানা শাখা এবং সঙ্গীতের বাণী ও সুর-মূর্ছনা মানুষের হৃদয় তন্ত্রীতে যে অনুরণন ঘটাত তা ভালবাসা ও বিপ্লবী চেতনায় মানুষকে উজ্জীবিত করত। আমাদের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে তাঁর বিখ্যাত ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ গ্রহণ করার পেছনে মূল ভূমিকা রাখেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের ন্যায় এ সঙ্গীতের প্রতিটি শব্দ এবং অন্তরা দেশপ্রেম এবং ভালবাসার চাদরে আচ্ছাদিত। আর সে কারণে বঙ্গবন্ধু যেখানেই কোন বড় আয়োজন থাকত- শিল্পীরা থাকতেন, তিনি ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ গানটি গাইতে অনুরোধ করতেন। শিল্পী জাহিদুর রহীম ও অজিত রায় বহু জনসভায় বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে এ গানটি পরিবেশন করেন। অসহযোগ আন্দোলেনের সময় এ গানটি অলিখিতভাবে বাঙালীর আত্মপরিচয়ের প্রতীক হয়ে ওঠে।
বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছিলেন। বাঙালীর মুক্তি আর স্বাধীনতাই ছিল তাঁর লক্ষ্য। ১৯৭১ সালে যখন পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী সমগ্র পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিবকে ক্ষমতা না দেবার চক্রান্তের অংশ হিসেবে সদ্য অনুষ্ঠিত পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের উদ্বোধনী অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করে তখন উত্তাল হয়ে উঠে সারাদেশ, বিক্ষোভে ফেটে পড়ে বীর বাঙালী। সবাই বুঝে গেল আর না, স্বাধীনতাই একমাত্র মুক্তির পথ। এই উত্তাল সময়ে ৩ মার্চ ঢাকার ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আয়োজনে বিশাল সমাবেশে বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করা হয় এবং ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ গানটিকে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে ঘোষণা করে তা পরিবেশিত হয়। ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার প্রেক্ষাপটে পরবর্তীকালে গঠিত হয় বাংলাদেশের প্রথম সরকার, যা মুজিবনগর সরকার নামে পরিচিত। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল তৎকালীন কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে মুজিবনগর সরকার শপথ গ্রহণ করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী। এই অনুষ্ঠানে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ গাওয়া হয়। তারপর দীর্ঘ নয় মাস স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রসহ যুদ্ধকালীন সকল আনুষ্ঠানিক কর্মসূচীতে এ গানটি জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গীত হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা এবং কোটি কোটি মানুষের প্রেরণা হিসেবে পরিবেশিত হয় এই জাতীয় সঙ্গীত।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ কর্তৃক আমাদের জাতীয় সঙ্গীত রচনার ইতিহাস জানাটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জমিদারি কাজের জন্য ১৮৮৯-১৯০১ সাল পর্যন্ত পূর্ববঙ্গের শিলাইদহ এবং শাহজাদপুরে অবস্থান করেন। তখন তাঁর সঙ্গে আন্তরিক সম্পর্ক হয় স্থানীয় বাউলশিল্পী ও গীতিকার গগন হরকরাব ‘(গগন চন্দ্র সেন)’। গগন হরকরা ছিলেন শিলাইদহ ডাকঘরের ডাকপিয়ন। সে সময় ডাকপিয়নকে হরকরা বলা হতো। তার বাড়ি ছিল শিলাইদহের পার্শ্ববর্তী আড়পাড়া গ্রামে । রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে গগন হরকরার সখ্য গড়ে ওঠে, তাঁরা দুজনে সঙ্গীত বিষয়ে আলাপ-আলোচনা ও সঙ্গীতচর্চা করতেন এবং মাঝে মাঝে দু’জনে নৌভ্রমণে বের হতেন। রবীন্দ্রনাথ গগন হরকরার বাউল গানের ভক্ত হয়ে ওঠেন এবং তার বাউল আঙ্গিকের অনেক গানের সুর গগন হরকরার থেকে গ্রহণ করেন। রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ গানটির সুর গগন হরকরার বিখ্যাত বাউল গান ‘আমি কোথায় পাব তারে’ থেকে গ্রহণ করেন। গগন হরকরার গানটি ১৯০৫ সালে বঙ্গদর্শন এবং সঞ্জীবনী পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হলেও এর প্রকৃত রচনাকাল নিয়ে মতভেদ রয়েছে। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় রবীন্দ্রনাথ ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ গানটি রচনা করেন। রবিঠাকুর গগন হরকরার ‘আমি কোথায় পাব তারে’ গানটির সুরের সংমিশ্রণে এই গানটির সুরারোপ করে মহাজাতিসদনে নিজেই গেয়েছিলেন। রবিঠাকুর বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’সহ অনেক স্বদেশ পর্যায়ের গান রচনা করেন।
১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানী কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে এলে তাঁর নেতৃত্বে ১৯৭২ সালে ১৩ জানুয়ারি মন্ত্রিপরিষদের সভায় ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ গানটিকে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গ্রহণ করা হয় আনুষ্ঠানিকভাবে। তবে পুরো গান নয়- প্রথম দশ লাইন কণ্ঠসঙ্গীত এবং প্রথম চার লাইন যন্ত্রসঙ্গীতের জন্য নির্বাচন করা হয়।

লেখক : গবেষক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও ফেলো, বাংলা একাডেমি


 

×