১৯৭১ সালের ২৯ জুলাই দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ অবস্থা সম্পর্কে বিশ্বের দৃষ্টিকে বিভ্রান্ত করার যত অপচেষ্টাই পাকিস্তানী সামরিক শাসক করুক, কিন্তু যা সত্য তাকে ধামাচাপা দিয়ে রাখা সম্ভব নয়। বিশ্বের প্রভাবশালী পত্র-পত্রিকায় নিয়মিতই বাংলাদেশের ঘটনাবলীর খবরাখবর প্রকাশিত হচ্ছে। সমগ্র বাংলাদেশে মুক্তি বাহিনীর প্রতিরোধ অভিযান ক্রমেই জোরদার হচ্ছে। পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর বর্বরোচিত কার্যকলাপের বিরুদ্ধে জাগ্রত মুক্তি সংগ্রামীদের অভিযান বাংলাদেশের সর্বত্রই অব্যাহত রয়েছে। মুক্তিবাহিনীর গেরিলাদের আক্রমণে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে পাকবাহিনীর মনোবল ভেঙ্গে পড়েছে। বাংলার মুক্তিকামী মানুষের সপক্ষে গড়ে উঠেছে বিশ্বজনমত। এইদিন ১১নং সেক্টরের আফছার ব্যাটালিয়নের কোম্পানি কমান্ডার চাঁন মিয়ার নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধা দল পারুলদীয়া বাজারে পাকবাহিনীর গুপ্তচরদের এ্যামবুশ করে। এই এ্যামবুশে পাকবাহিনীর তিনজন সহযোগী নিহত হয়। কুমিল্লায় লেঃ হেলাল মুর্শেদের নেতৃত্বে এক কোম্পানি যোদ্ধা পাকবাহিনীর মুকুন্দপুর-হরশপুর রেলস্টেশন ঘাঁটি আক্রমণ করে। এই আক্রমণে পাকসেনাদের বেশ ক্ষতি হয়। আক্রমণ শেষে মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদে নিজ ঘাঁটিতে ফিরে আসে। সুনামগঞ্জে মুক্তিযোদ্ধা ইপিআর আবদুল হাই, জগৎজ্যোতি দাস ও মুজাহিদ মিয়ার নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর তিনটি দল পাকবাহিনীর সাচনা ও জামালগঞ্জ ঘাঁটি আক্রমণ করে। মুক্তিবাহিনীর ত্রিমুখী আক্রমণে পাকসেনারা তাদের সাচনা ও জামালগঞ্জ ঘাঁটি পরিত্যাগ করে দুর্লভপুর অভিমুখে পালিয়ে যায়। মুক্তিবাহিনীর বীরযোদ্ধা সিরাজ সাচনা বাজার যুদ্ধক্ষেত্রে পাকবাহিনীর গুলিতে শহীদ হন। সিলেটের মোহাম্মদপুরের তেলিয়াপাড়ায় এক অতর্কিত আক্রমণে ৩৫-৪০ জন সেনা নিহত হয়। একই আক্রমণে একজন অফিসার দু’জন জেসি ও একজন এনসিও নিহত হয়। মাইন বিস্ফোরণে দুরমানগরে একজন রাজাকার নিহত হয়। একই এলাকায় শত্রুর অবস্থানে অতর্কিত হামলা চালানো হয়। আরেকটি অতর্কিত আক্রমণে দুধপাতিল থানার চুনারুঘাটে ৯ জন সেনা নিহত হয়। দাউদকান্দির বাতাকান্দিতে বেতারকে বিপর্যস্ত করে গেরিলাবাহিনী। কুমিল্লায় বেশ কিছু ঘটনায় বিব্রত হবার পর পাকসেনারা সেখানে তাদের শক্তি বৃদ্ধির জন্য নৌকায় করে প্রচুর সৈন্য সমাবেশ করার চেষ্টা করছিল। মুক্তিফৌজের ধারাবাহিক বিতারণের জবাবে পাকসেনারা তাদের সর্বাত্মক চেষ্টা করছিল। ৩০০ সৈন্যের ৭টি নৌযান জলপথে যাচ্ছিল। কুমিল্লার জাফরগঞ্জে মুক্তিবাহিনী একটি সফল এ্যামবুশ করে তাদের উপরে। ৭ টার মধ্যে ৪টা নৌকা মুক্তিবাহিনীর আয়ত্তের কাছে এলে তারা মর্টার, এলএমজি ও এসএমজি দিয়ে আক্রমণ শুরু করে। এতে প্রায় ১২৫ জন সেনা ছিল, প্রায় সবাই ডুবে মারা যায় বা নিহত হয়। কিন্তু বাকি ৩টি নৌকা তাদের আর্টিলারির সাহায্য নিয়ে তাদের পূর্বের স্থানের দিকে পালিয়ে যায়। প্রায় একই সময়ে কুমিল্লার মান্দাভাগে মুক্তিফৌজ মেশিনগান, মর্টার দিয়ে শত্রুদের আক্রমণ করে প্রায় ৩০ জনকে হত্যা করে। সম্প্রতি কুমিল্লা ও তার আশপাশের এলাকায় ঘটে যাওয়া ঘটনায় পাকসেনাদের মনোবল ধ্বংসের পথে। তারা ভয়ে কুমিল্লার সরকারী বাসভবন ছেড়ে চান্দিনায় চলে যায়। মুক্তিবাহিনী ঘাটুকিয়া নদীপথে যাতায়াতকারী পাকসেনাবাহী লঞ্চে আক্রমণ করে। ৪৫ মিনিট চলা বন্দুকযুদ্ধে শত্রুবাহিনীর ৫ জন নিহত এবং ১০ জন আহত হয়। রাত সাড়ে ৮টায় মুক্তিসেনাদের ভোমরা ডিফেন্সে শত্রুরা আক্রমণ করে। সাতক্ষীরা টাউন, শেরপুর, দেবহাটা ও কালিগং থেকে অনেক সৈন্য ভোমরাতে আসে। মুক্তিসেনাদের গেরিলারা ৩ ইঞ্চি মর্টার ও আর্টিলারি দিয়ে তাদের আক্রমণ করে। অসংখ্য পাকসেনা নিহত হয়। মধুপুরে রাজাকার আর তাদের সহযোগীদের প্রচুর লাশ পড়ে থাকতে দেখা যায়। তারা পথের পাশে পড়ে পচতে থাকে। শত্রুরা তাদের লাশ সংগ্রহ করে কবর দিতে আসেনি। বিহারিদের লাশ ও রাস্তার পাশে পরে ছিল। মুক্তাঞ্চল থেকে ডাকটিকিট প্রকাশ করে ডাক বিভাগ মুক্তিযুদ্ধে খ্যাতি অর্জন করেছেন। এই দিন প্রবাসী সরকার মুক্তাঞ্চল থেকে বাংলাদেশের প্রথম ৮টি ডাকটিকিট প্রকাশ করে। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং নয়াদিল্লীতে বলেন, নিরাপত্তা পরিষদে বাংলাদেশ সমস্যা উত্থাপন করার কোন ইচ্ছা বর্তমানে ভারতের নেই। তিনি জানান, বাংলাদেশ সঙ্কট সম্পর্কে বিবেচনা করার উদ্দেশ্যে জাতিসংঘ মহাসচিব উ থান্ট নিরাপত্তা পরিষদের কোন আনুষ্ঠানিক বা ঘরোয়া বৈঠক আহ্বানের পরামর্শ দেননি। পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো করাচীর প্রেসিডেন্ট ভবনে ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসক ও গবর্নর টিক্কা খান মুক্তিবাহিনীর মোকাবেলা করার জন্য পাকিস্তানের আদর্শে বিশ্বাসী রাজনৈতিক দলের কর্মীদের প্রতি মুজাহিদ বাহিনী গড়ে তোলার আহ্বান জানান। জামায়াতে ইসলামীর প্রাদেশিক আমির গোলাম আযম ভবিষ্যত বংশধরদের খাঁটি পাকিস্তানী করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে পাঠ্যপুস্তক থেকে অবাঞ্ছিত অংশ বাদ দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণে লেঃ জেনারেল টিক্কা খানকে অভিনন্দন জানান। তিনি বলেন, জাতীয় আদর্শভিত্তিক নতুন সিলেবাস ভবিষ্যত নাগরিকদের খাঁটি মুসলিম হিসেবে গড়ে উঠতে সহায়ক হবে। দৈনিক হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকার এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, হিট এ্যান্ড রান কৌশল মুক্তি ফৌজ কমান্ডো বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল বিশেষ করে রংপুর ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় ব্যবহার তীব্রতর করেছে। কমান্ডো গ্রুপ ২৩ জুলাই সেনানিবাসের ৩টি এলাকায় অভিযান চালিয়ে প্রায় এক ডজন পাকসেনাকে হত্যা ও পাকবাহিনীর একটি গাড়ি ধ্বংস করে। একই দিন কমান্ডোরা আরও শক্তিশালী হ্যান্ড গ্রেনেড দিয়ে রংপুর শহরের উপকণ্ঠে আলমনগর উপশহর আক্রমণ করে এবং এক ডজনেরও বেশি পাকবাহিনীর সমর্থককে হত্যা করে। পরদিন নীলফামারী সেক্টর কমান্ডোদের সঙ্গে পাকবাহিনীর সমর্থকরা কিশোরগঞ্জ পুলিশ স্টেশনের কাছে একটি জায়গায় বৈঠক করছিল। এই স্থানে মুক্তিবাহিনীর কমান্ডোরা ঝটিকা আক্রমণ করে তাদের অনেককে হত্যা করে। দৈনিক যুগান্তর পত্রিকার রায়গঞ্জ সংবাদদাতার এক প্রতিবেদনে জানা যায়, দিনাজপুর জেলার ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, বোদা, তেঁতুলিয়া এবং দেবীগঞ্জ এখন বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর সম্পূর্ণ দখলে। এসব অঞ্চলের সরকারী ও বেসরকারী ভবনে বাংলাদেশের পতাকা উড়ছে। আমেরিকার বহুল প্রচারিত সাপ্তাহিক ‘নিউজ উইক’ পত্রিকার এক নিবন্ধে বলা হয়, ‘ইয়াহিয়ার জন্যে দুঃখ হয়, কেননা তিনি যা দাবি করেছেন প্রকৃত ঘটনা তার সম্পূর্ণ বিপরীত। সমগ্র বাংলাদেশে মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধ অভিযান ক্রমেই জোরদার হচ্ছে। এ অভিযান গোড়া থেকেই পরিচালিত হচ্ছে এবং উন্নত সমরসজ্জায় সজ্জিত পাকিস্তান সামরিক বাহিনী চরমভাবে ঘায়েল হচ্ছে। সম্প্রতি বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চল সফরকারী নিউজউইকের সংবাদদাতা লোরেন জেনকিন্স এখানে মুক্তিবাহিনীর হাতে দু‘জন দালালের ‘লালরঙা চিঠি’ প্রাপ্তি ও কড়া সামরিক পাহাড়াধীন থেকেও শোচনীয় মৃত্যুর খবর জানান। ‘লন্ডন টাইমস’ পত্রিকার সংবাদদাতা মাইকেল হর্নসবি জানান, বাংলাদেশে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী অহরহ মুক্তিবাহিনীর গেরিলাদের দ্বারা আক্রান্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বাংলাদেশের সকল শহরে বিশেষ করে ঢাকা শহরে গেরিলা বাহিনীর আক্রমণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে প্রতিহিংসা পরায়ণ পাকবাহিনী আশপাশের এলাকার বেসামরিক বাসিন্দাদের ওপর উৎপীড়ন চালাচ্ছে।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক
[email protected]