ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কৃষি অন্ত হোক প্রাণ

প্রকাশিত: ০৩:৫০, ৪ মার্চ ২০১৮

কৃষি অন্ত হোক প্রাণ

কৃষিতেই রয়েছে বাঙালীর প্রাণপ্রবাহ। গোলাভরা ধানের স্বপ্ন দেখে এদেশের কৃষক আদিকাল থেকেই। আর আবাদি জমিজুড়ে চায় ফসলের সোঁদা গন্ধ এবং রূপালি বাতাস। চাষাভুষা মানুষের দেশ বাংলাদেশ প্রাচীনকাল থেকেই। নিজ হাতে শস্য ফলিয়ে খাদ্য যোগান দিতেই আনন্দ কৃষিজীবী মানুষের। ধানের খেতে রৌদ্র ছায়ায় যে লুকোচুরি খেলা চলে, সেই খেলায় মেতে ওঠা কিষাণ শুধু স্বপ্ন বুনে যায়, অধিক ফসল ফলবে তার আবাদি জমিতে। আর সেই ফসল বিক্রি করে কিনবে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি। সংসারে তার বয়ে যাবে সুখের নহর। জীবনের গান প্রবাহিত হবে তার ভুবনজুড়ে। অবশ্য এদেশে অধিকাংশ কিষাণ-কিষাণীর স্বপ্ন থেকে যায় অধরা। ফসলের ঘ্রাণ এবং গান তাকে উতলা করে তোলে। কিন্তু খরা, বৃষ্টি, বন্যায় তার সবকিছু ভেসে যায় দুর্ভোগের সমান তালে। বাঙালীর জীবন-জীবিকায় কৃষিই সব। কৃষি কাজে সম্পৃক্ত অর্ধেকের বেশি জনগোষ্ঠী। সারা বছর বীজ বুনে, ফসল ফলায় আবার কর্তন করে গোলা ভরে কিংবা বেচাকেনায় হয় নিমগ্ন। এক মণ ধান বেচে সংসারের জন্য দরকারি জিনিস কেনা বাঙালী মধ্যবিত্ত কৃষকের পুরনো চর্চা। তবে ভূমিহীন কৃষকের পক্ষে যা দুষ্কর। দেশে জনসংখ্যা বাড়ছে কিন্তু কৃষি জমি বাড়ছে না। ফলে উৎপাদন চাহিদার যোগান দিতে পারছে না। এমনিতে কৃষি জমি সুরক্ষিত নয়। স্থাপনা-সড়ক ইত্যাদিতে কৃষি জমি কমে যাচ্ছে। এক ফসলি বা তিন ফসলি জমির পরিমাণ বাড়ছে না। কিন্তু চাষাবাদ বন্ধ করে কলখারখানা, শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপন, ইটভাঁটিসহ নানাবিধ কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে এসব জমি। ফলে আবাদি জমি হ্রাস পাচ্ছে। ফসলি জমিকে অন্য কাজে ব্যবহার বন্ধ করা না গেলে ফসল উৎপাদন হ্রাস পাবে। তীব্র হবে খাদ্য সঙ্কট। তা নিরসনে হতে হবে আমদানিনির্ভর। ব্যয় হবে বিদেশী মুদ্রা। যা দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির সহায়ক নয়। অনাবাদি জমিতে শিল্পায়ন বা অন্য স্থাপনা প্রতিষ্ঠিত করা গেলেও দেখা গেছে কৃষি জমিগুলোই এখাতে ব্যবহৃত হচ্ছে বেশি। অপরিকল্পিতভাবে এসব জমি ব্যবহার করার কারণে ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছে। দেশে খাদ্য উৎপাদন বাড়ানো জরুরী। স্বল্প পরিমাণ জমিতে অধিক খাদ্য উৎপাদনের জন্য করণীয় পদক্ষেপ গ্রহণ সঙ্গত। এ জন্য কৃষি গবেষণার কাজে মনোযোগী হতে হবে। প্রয়োজনে শিক্ষার্থীর জন্য কৃষিতে ব্যবহারিক শিক্ষার ওপর জোর দিতে হবে। শিক্ষিতরা কৃষি কাজকে যাতে অপছন্দ না করে সেজন্য তাদের সচেতনতা বাড়াতে হবে। কৃষকের সন্তান শিক্ষিত হলে আর কৃষি কাজে আন্তরিক হতে চায় না। অথচ কৃষি বিষয়ক শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে কৃষি উৎপাদন বাড়ানো যায়। শিক্ষা ব্যবস্থায় কৃষির ব্যবহারিক শিক্ষা থাকা বাঞ্ছনীয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও কৃষি বিষয়ে ব্যবহারিক শিক্ষা পাঠ্যক্রমে থাকার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। তিনি বলেছেন, মাটিতে হাত দিয়ে চারা রোপণ করলে বা কাজ করলে লজ্জার কিছু নেই। বরং নিজের হাতে বাগান করলে; সেই বাগানে যখন একটা ফল হয়, সেটা ছিঁড়ে খেতে আরও বেশি গর্ববোধ হয়। বাড়ির ছাদে বাগান চর্চার ব্যাপক প্রসার ঘটেছে শহর, গঞ্জ, গ্রামেও। কৃষিকে যান্ত্রিকীকরণ করার কাজ বিস্তৃত হলে ফসল উৎপাদন বাড়বে। অব্যবহৃত জমি সমবায়ের ভিত্তিতে আবাদ করা গেলে খাদ্যাভাব হ্রাস পাবে। জমি চাষ, ফসল কাটা, ফসল আলাদা করা সবই মেশিন দিয়ে করা গেলে উৎপাদন শ্রম হ্রাস পাবে। পাশাপাশি কৃষি পণ্য প্রক্রিয়াজাত শিল্প গড়ে তোলা জরুরী। নতুন প্রজন্মকে কৃষি কাজে আগ্রহী করে তোলা গেলে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ থাকবে দেশ। অর্থনীতি কৃষিনির্ভর যে দেশ, সে দেশে কৃষিকে গুরুত্বহীন পর্যায়ে রাখা যায় না। গুরুত্বপূর্ণ করা গেলে কৃষি থেকে ধীরে ধীরে শিক্ষায়ও উন্নত হবে দেশ। কৃষিই দেবে কাঁচামালের যোগান। সমাজজীবনের প্রতিটি স্তরে কৃষিকে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে হবে, যাতে এ খাত স্বনির্ভর থাকে সবসময়। মিয়ানমার সীমান্তে অস্থিরতা শুক্রবার পুনরায় মিয়ানমার সীমান্তে উত্তেজনা বিরাজ করে। বাংলাদেশের নাইক্ষ্যংছড়ি এলাকার সীমান্তে মিয়ানমার হঠাৎ করেই ভারি অস্ত্রশস্ত্র ও সেনা মোতায়েন শুরু করে। সেখানে নোম্যানস ল্যান্ড বা শূন্যরেখায় থাকা সাত হাজার রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে ঢুকে যাওয়ার জন্য ভয়ভীতি দেখাতে থাকে। ফাঁকা গুলিও বর্ষণ করে। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ বা বিজিবিকে সতর্ক অবস্থানে রাখা হয়। যে কোন পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য তৈরি থাকতে নির্দেশ দেয়া হয়। ফলে সীমান্ত এলাকায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। এই উত্তেজনা ও অস্থিরতা এমন সময়ে মিয়ানমার সৃষ্টি করল যখন বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে দুই দেশের মধ্যে চুক্তি হয়েছে, তালিকা হস্তান্তর করা হয়েছে এবং শীঘ্রই তাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু হবে বলে আশা প্রকাশ করা হয়েছে। তাই এটা আর অস্পষ্ট নয় যে, ওই উত্তেজনা সৃষ্টির পেছনে সুনির্দিষ্ট অভিসন্ধি রয়েছে মিয়ানমারের। তারা রোহিঙ্গা ফেরত নেয়ার ব্যাপারে নানা টালবাহানা করবে। ওই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে অবশ্য বাংলাদেশ মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে তলব করে কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছে। বিজিবির আহ্বানে শুক্রবার বিকেলেই দুই দেশের সীমান্ত কর্তৃপক্ষের মধ্যে পতাকা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে মিয়ানমার গুলিবর্ষণের কথা অস্বীকার করে। সীমান্তে সেনাসদস্য বৃদ্ধির ব্যাপারে অজুহাত দেয় যে, অভ্যন্তরীণ কাজে নিরাপত্তার প্রয়োজনে তারা বান্দরবানের তুমব্রু সীমান্তের ওপারে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করেছে। পতাকা বৈঠক শেষে বিজিবি প্রতিনিধি দলের প্রধান গণমাধ্যমের কাছে বলেন, ভবিষ্যতে সীমান্ত এলাকায় ফাঁকা গুলি ছোড়ার আগে বাংলাদেশকে অবহিত করার কথা বলেছে মিয়ানমার সীমান্ত কর্তৃপক্ষ। একই সঙ্গে শূন্যরেখায় অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের যে কোন সময় নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারেও অঙ্গীকার করেছে। রোহিঙ্গাদের ওপর অমানবিক নির্যাতনের মাধ্যমে তাদের দেশছাড়া করার ফলস্বরূপ মিয়ানমার বিশ্বে নিন্দিত হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে তারা আবার নতুন করে কোন দুরভিসন্ধি আঁটছে যাতে বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণকারী লাখ লাখ রোহিঙ্গা নিজ দেশে ফিরতে না পারে। বলাবাহুল্য, সীমান্তে উত্তেজনা তৈরির মাধ্যমে তারা উস্কানি দিচ্ছে। বাংলাদেশ সরকারও সম্পূর্ণ সচেতন, তাদের ফাঁদে পা দেয়ার কোন প্রশ্নই ওঠে না। সীমান্তে অবাঞ্ছিত ও আন্তর্জাতিক রীতিনীতিবিরুদ্ধ আচরণের মধ্য দিয়ে মিয়ানমার যে দৃষ্টান্ত রাখল গত শুক্রবার, পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে সে উদ্বেগজনক অস্থির পরিস্থিতির আপাত প্রশমন ঘটলেও মিয়ানমারের ওপর কূটনৈতিক চাপ অব্যাহত রাখার কোন বিকল্প নেই। সেইসঙ্গে সীমান্তে বাংলাদেশকে আরও বেশি সতর্ক অবস্থানে থাকতে হবে। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা অবস্থান করছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য তা এক মারাত্মক আঘাতস্বরূপ। তা ছাড়া উদ্ভূত পরিস্থিতি স্থানীয় সামাজিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশেরও ব্যাপক ক্ষতি করছে। এই অবস্থা যত দীর্ঘায়িত হবে ক্ষতির পরিমাণ তত বাড়বে। অন্যদিকে আসন্ন বর্ষায় রোহিঙ্গাদের জন্য যে বিপর্যয়কর অবস্থা নেমে আসবে, তাকে সামাল দেয়াও কঠিন হয়ে পড়বে। এ অবস্থায় যত দ্রুত সম্ভব রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন সম্পন্ন করতে হবে। মিয়ানমার সরকারকে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিতে হবে, এ ধরনের পদক্ষেপ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সুষ্ঠু প্রত্যাবর্তন ছাড়াও সৎ প্রতিবেশীসুলভ সহাবস্থানের অন্তরায়। রোহিঙ্গা শরণার্থী আগমন প্রক্রিয়ার শুরু থেকেই বাংলাদেশ ধৈর্য ধরে আসছে। নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে বাংলাদেশ সব সময় দৃঢ় অবস্থানেই রয়েছে।
×