ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০১ আগস্ট ২০২৫, ১৭ শ্রাবণ ১৪৩২

পিআর পদ্ধতিতে সদস্য মনোনয়ন, জুলাই সনদ নিয়ে হয়নি ঐকমত্য ॥ বিএনপিসহ কয়েকটি দলের আপত্তি সত্ত্বেও ঐকমত্য কমিশনের সিদ্ধান্ত

উচ্চকক্ষ হবে ১০০ আসনের

বিশেষ প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ২৩:২৭, ৩১ জুলাই ২০২৫; আপডেট: ২৩:২৯, ৩১ জুলাই ২০২৫

উচ্চকক্ষ হবে ১০০ আসনের

পিআর পদ্ধতিতে ১০০ আসনের উচ্চকক্ষ গঠনের সিদ্ধান্ত জানিয়েছে কমিশন

‘জুলাই সনদ’ নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি রাজনৈতিক দলগুলো। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্টের ব্যাপারে একমত হলেও উচ্চকক্ষের নির্বাচন প্রক্রিয়া আসনের ভিত্তিতে নাকি ভোটের আনুপাতিকহারে হবে- এ নিয়েও বড় দলগুলো পাল্টাপাল্টি অবস্থান নিয়েছে। তবে বিএনপিসহ অন্যদের ‘নোট অব ডিসেন্ট’ (আপত্তি)সহ পিআর পদ্ধতিতে ১০০ আসনের উচ্চকক্ষ গঠনের সিদ্ধান্ত জানিয়েছে কমিশন। যেখানে সদস্যরা নি¤œকক্ষে প্রতিটি দলের প্রাপ্ত ভোটের শতাংশ অনুযায়ী সংখ্যাগত প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতিতে মনোনীত হবেন।  জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দেওয়া বা না দেওয়া নিয়েও মতবিরোধ রয়েই গেছে। 
জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫ বাস্তবায়নের দায়িত্ব রাজনৈতিক দলগুলোর এবং প্রয়োজনে এ নিয়ে আবারো আলোচনা হবে বলে জানিয়েছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ। তবে, এই সনদের আইনি ভিত্তি ও বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছে জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। আর বিএনপি দাবি করেছে, সংস্কার প্রস্তাবের আইনি ভিত্তি দেওয়া নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে।
সংসদের উচ্চকক্ষে প্রতিনিধি নির্বাচনে পিআর পদ্ধতি এবং সংবিধান সংশোধনে উচ্চকক্ষের ক্ষমতা নিয়ে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো আপত্তি জানিয়েছে। সিপিবিসহ কয়েকটি দল উচ্চকক্ষ গঠনের বিরোধিতা করেছে। এ নিয়ে আলোচনায় সংলাপে উত্তেজনা দেখা দেয়। তারপর বিএনপিসহ অন্যদের ‘নোট অব ডিসেন্ট’ (আপত্তি)সহ পিআর পদ্ধতিতে ১০০ আসনের উচ্চকক্ষ গঠনের সিদ্ধান্ত জানিয়েছে কমিশন।

একইভাবে বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর আপত্তি সত্ত্বেও পিএসসি-দুদক-সিএজি ও ন্যায়পাল নিয়োগের বিধান সংবিধানে যুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এছাড়া তিন বাহিনী ও দুই গোয়েন্দাপ্রধান নিয়োগ সরাসরি রাষ্ট্রপতির হাতে রাখার প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, দুই কক্ষের সদস্যদের ভোটে নির্বাচিত হবেন রাষ্ট্রপতি।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় ধাপের ২৩তম দিনের আলোচনায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সংলাপে সরকারি কর্মকমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক এবং ন্যায়পাল নিয়োগ বিধান সম্পর্কিত বিধান; উচ্চকক্ষের গঠন, সদস্য নির্বাচনের পদ্ধতি, এখতিয়ার; রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি, ইলেকটোরাল কলেজ; রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্ব; তত্ত্বাবধায়ক সরকার; নাগরিকের মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ সম্পর্কিত প্রস্তাব এবং রাষ্ট্রের মূলনীতি নিয়ে আলোচনা হয়। 
ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজের সভাপতিত্বে ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দারের সঞ্চালনায় সংলাপে উপস্থিত ছিলেন কমিশনের সদস্য বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ড. ইফতেখারুজ্জামান, ড. বদিউল আলম মজুমদার, সফর রাজ হোসেন ও ড. মো. আইয়ুব মিয়া। সংলাপে ৩০টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা অংশ নেন।
ঐকমত্য কমিশন সূত্র জানায়, একশ’ আসনের একটি উচ্চকক্ষ গঠন করা হবে, যেখানে সদস্যরা নিম্নকক্ষে প্রতিটি দলের প্রাপ্ত ভোটের শতাংশ অনুযায়ী সংখ্যাগত প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতিতে মনোনীত হবেন। এর আগে দীর্ঘ আলোচনা সত্ত্বেও দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য না হওয়ায় এবং ভিন্নমত থাকায়, বিষয়টি কমিশনের ওপর ন্যস্ত করা হয়েছিল। সেই দায়িত্ব পালনের অংশ হিসেবে কমিশন এ সিদ্ধান্ত জানায়। 
জানা  গেছে, সংসদের উচ্চকক্ষের নিজস্ব কোনো আইন প্রণয়নের ক্ষমতা থাকবে না। তবে, অর্থবিল ব্যতীত অন্য সব বিল নিম্নকক্ষ ও উচ্চকক্ষ উভয়কক্ষে উপস্থাপন করতে হবে। উচ্চকক্ষ কোনো বিল স্থায়ীভাবে আটকে রাখতে পারবে না। এক মাসের বেশি বিল আটকে রাখলে, সেটিকে উচ্চকক্ষ কর্তৃক অনুমোদিত বলে গণ্য করা হবে। নিম্নকক্ষ কর্তৃক প্রস্তাবিত বিলসমূহ পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করবে উচ্চকক্ষ এবং নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে তা অনুমোদন অথবা প্রত্যাখ্যান করতে হবে।

যদি উচ্চকক্ষ কোনো বিল অনুমোদন করে, তবে উভয়কক্ষে পাস হওয়া বিল রাষ্ট্রপতির সম্মতির জন্য পাঠানো হবে। আর যদি উচ্চকক্ষ কোনো বিল প্রত্যাখ্যান করে, তাহলে তা সংশোধনের সুপারিশসহ নিম্নকক্ষে পুনর্বিবেচনার জন্য পাঠানো হবে। নিম্নকক্ষ সেই সংশোধনসমূহ আংশিক বা পূর্ণভাবে গ্রহণ কিংবা প্রত্যাখ্যান করতে পারবে।
তবে বিএনপি এবং তাদের মিত্র জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, ১২ দলীয় জোট, এনডিএম ও এলডিপি দাবি জানিয়েছে, উচ্চকক্ষে আসন বরাদ্দ নিম্নকক্ষে প্রাপ্ত আসনের ভিত্তিতে দিতে হবে। তারা উচ্চকক্ষের এখতিয়ার নিয়েও আপত্তি তুলেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ এবং জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম উচ্চকক্ষ গঠনের বিরোধিতা করেছে। তারা বলছে, দেশের বর্তমান সামাজিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতায় উচ্চকক্ষের কোনো প্রয়োজন নেই।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় ধাপের ২৩তম দিনের আলোচনার শুরুতে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে কথা বলেন সংলাপের সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। আলোচনার এক পর্যায়ে গণঅধিকার পরিষদের মুখপাত্র ফারুখ হাসান সনদের ভূমিকায় ২০১৮ সালের কোটা আন্দোলনের বিষয়টি যুক্ত করার দাবি জানান। পরবর্তীতে অন্যরা কথা বলতে চাইলে তাদেরকে সুযোগ দেওয়া হয়নি। তবে সংলাপের বিরতিতে বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন।
পিএসসি-দুদক-সিএজি ও ন্যায়পাল নিয়োগের বিধান থাকবে সংবিধানে ॥ সরকারি কর্মকমিশন (পিএসসি), দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), মহা-হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক (সিএজি) ও ন্যায়পাল নিয়োগের বিধান সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানিয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। তবে বিষয়টিতে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দেবে বিএনপিসহ পাঁচটি দল ও জোট। আলোচনায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দীন আহমেদ নিয়োগের জন্য শক্ত আইন করার পক্ষে মত দেন।

তবে সংবিধানের নিয়োগ কমিটির বিধান যুক্ত করার বিরোধিতা করেন তিনি। পরে কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ জানান, এ বিষয়গুলোতে বিএনপি, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, ১২ দলীয় জোট, এনডিএম ও আমজনতার দল নোট অব ডিসেন্ট দেবে।
তিন বাহিনী ও দুই গোয়েন্দাপ্রধান নিয়োগ রাষ্ট্রপতির হাতে ॥ তিন বাহিনীর প্রধান এবং দুটি প্রধান গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান নিয়োগের ক্ষমতা সরাসরি রাষ্ট্রপতির হাতে তুলে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে ঐকমত্য কমিশন। এই প্রস্তাবে সংবিধানের চতুর্থ ভাগের প্রথম পরিচ্ছেদের ৪৮ (৩) অনুচ্ছেদ সংশোধনের সুপারিশ করা হয়েছে। বর্তমান সংবিধানের ৪৮ (৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগ ব্যতীত রাষ্ট্রপতি তাঁর অন্য সব দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কার্যনির্বাহ করেন। তবে, ঐকমত্য কমিশনের সংশোধিত খসড়া প্রস্তাবে এই ক্ষমতা আরো বিস্তৃত করার কথা বলা হয়েছে।
প্রস্তাবিত সংশোধিত খসড়া অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি নিম্নলিখিত বিষয়াবলিতে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ ছাড়াই কার্যনির্বাহ করতে পারবেন: অ্যাটর্নি জেনারেল নিয়োগ, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের নিয়োগ, তথ্য কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের নিয়োগ, বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান নিয়োগ, আইন কমিশনের চেয়ারম্যান নিয়োগ, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের নিয়োগ, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের নিয়োগ, এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের নিয়োগ, বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশনস রেগুলেটরি কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের নিয়োগ, সশস্ত্র বাহিনীসমূহের (সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী) প্রধানদের নিয়োগ, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) মহাপরিচালক নিয়োগ এবং জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দার (এনএসআই) মহাপরিচালক নিয়োগ। এই প্রস্তাব  কার্যকর হলে দেশের গুরুত্বপূর্ণ নিয়োগ প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রপতির ভূমিকা আরো শক্তিশালী হবে বলে কমিশনের পক্ষ থেকে আশা প্রকাশ করা হয়।
রাজনৈতিক দলগুলোর বক্তব্য ॥ সংলাপ শেষে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ঐকমত্যের কমিশনে কিছু দল জটিল পরিস্থিতি  তৈরি করছে। তারা শুধু পিআর পদ্ধতির কথা বলছে। আমরা চাই, সংসদের উচ্চকক্ষের প্রতিনিধি নির্বাচিত হবেন নিম্নকক্ষের আসনের ভিত্তিতে। আর সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগও আইনের মাধ্যমে করতে চাই।

তিনি বলেন, ৩১ দফা কর্মসূচিতে আমরাই প্রথম সংসদের উচ্চকক্ষের প্রস্তাব দিয়েছি; যেখানে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখা বিশিষ্ট ও প্রতিভাবান ব্যক্তিরা থাকবেন। তবে তারা নির্বাচিত হবেন নিম্নকক্ষের আসনের ভিত্তিতে। আর তারা সংবিধান সংশোধনের সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না। কারণ তারা নির্বাচিত নন। এ ক্ষেত্রে নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই আইন  তৈরি করবেন।
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নিয়োগের বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই সদস্য বলেন, কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী এসব প্রতিষ্ঠানের নিয়োগে একটি বাছাই কমিটি হবে। যেখানে পিএসসি, দুদক, মহা হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক এবং মানবাধিকার কমিশনের প্রধানের নিয়োগ হবে সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায়। আমরা মনে করি, এ পদগুলো নির্বাহী আইনের ভিত্তিতে হলে ভালো। কারণ এতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। তাই এটি সরকারের হাতে থাকা উচিত। নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক নিয়োগ নিয়ে আমরা কোনো আপত্তি করিনি।
পিএসসির বিষয়ে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বিগত দিনে পিএসসির প্রশ্ন ফাঁস ও দুর্নীতির মূল কারণ ছিল, ৫৬ শতাংশ কোটা। এখন আর তা নেই। মাত্র সাত শতাংশ কোটা আছে। আমরা বলেছি, সেটিও সংসদে আলোচনা ও আইনগত নিয়মে থাকা উচিত। আমরা পিএসসির ভাইভা ২০০ এর পরিবর্তে ৫০ নম্বর করার কথা বলেছি। সেখানে কোনো ধরনের  বৈষম্য করা যাবে না। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়োগ নিয়ে বিএনপি ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছে।

তিনি জানান, সংসদ সদস্যরা গোপন ব্যালটের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করবেন। এতে সকলেই একমত। কেউ ভিন্ন মত দেয়নি। তবে কিছু ক্ষমতা আমরা রাষ্ট্রপতিকে দিতে চাই; যাতে একটি ভারসাম্য থাকে। তিনি বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। মৌলিক অধিকারের বিষয়গুলোও নিশ্চিতের বিষয়ে আমরা জোর দিয়েছি। আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে দেশ গড়তে চাই।
জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা.  সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের বলেন, সাংবিধানিক বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়োগে সাংবিধানিক প্রক্রিয়া অনুসরণের পক্ষে অধিকাংশ দল। আর বিএনপিসহ কয়েকটি দল বিপক্ষে ছিল। তারপরও শেষ পর্যন্ত নোট অব ডিসেন্ট দিয়ে তারাও একমত হয়েছে। এ নিয়োগগুলো সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিয়েছে কমিশন।
সংসদের উচ্চকক্ষের বিষয় ডা. তাহের বলেন, আমরা উচ্চকক্ষ ও নিম্নকক্ষে পূর্ণাঙ্গ পিআর চাই, যা হবে রাজনৈতিক দলের প্রাপ্ত ভোটের ভিত্তিতে। কারণ বিগত দিনগুলোতে অংশগ্রহণমূলক ভোট হয়নি। রাতে ভোট হয়েছে। তাই গ্রহণযোগ্য প্রার্থী নির্বাচিত হয়ে আসতে পারেননি। আর পিআর পদ্ধতি তো অনেক দেশেই আছে। তাই আমরা মনে করি পিআর পদ্ধতি বাস্তবায়ন না করার কোনো কারণ নেই।
এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী রাজনৈতিক দলগুলোর ভোটের আনুপাতিক হারে সংসদের উচ্চ কক্ষের ১০০ সদস্য নির্বাচিত হবেন। এতে সমাজের পরিশীলিত ধারার কিছু ব্যক্তি নির্বাচিত হয়ে আসতে পারবেন। আমরাও এটির পক্ষে। কারণ নিম্নকক্ষের ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো তারা তুলে ধরবেন। এতে বহু দলের সমন্বয়ে দেশ গড়া সম্ভব হবে।  আমরা মনে করি, এতে চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স থাকবে।
তিনি বলেন, তবে জাতীয় নাগরিক পার্টির পক্ষ থেকে বারবার দাবি জানানো হয়েছে, সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে উচ্চকক্ষে টু-থার্ডস মেজরিটি নিশ্চিত করতে হবে। অনেকে বলছেন, পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচিতরা প্রকৃত নির্বাচিত প্রতিনিধি নন। কিন্তু সারা পৃথিবীতেই এফপিটিপি ও পিআর, উভয় পদ্ধতির মাধ্যমে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের  বৈধতা রয়েছে। উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতির মাধ্যমে নির্বাচিত প্রতিনিধিরাও জনগণের প্রতিনিধি।
সিপিবি সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ এদেশের আর্থ-সামাজিক ও ভূপরিবেশ বিবেচনায় উচ্চকক্ষ অনুকূলে না। বরং উচ্চকক্ষের প্রস্তাবনা এদেশের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় বিবেচনায় উচ্চবিলাষী। তাই ‘নোট অব ডিসেন্ট’ না, উচ্চকক্ষের আলোচনা প্রত্যাখ্যান করেছে সিপিবি, বাসদ গণফোরামসহ বামদলগুলো। তিনি বলেন, সব দল সব বিষয়ে একমত না। সুতরাং গুটিকয়েক দলের মতের ভিত্তিতে সার্বিক ঐকমত্য বলাটা যুক্তিযুক্ত না। 
বিএলডিপির চেয়ারম্যান ও ১২ দলীয় জোটের মুখপাত্র শাহাদাত হোসোন সেলিম বলেন, উচ্চকক্ষের নামে নখ-দন্তহীন একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে রাষ্ট্রের ব্যয় বিলাসী চিন্তা করা হচ্ছে। উচ্চকক্ষের নামে আগামীর সরকারকে হাত-পা বেঁধে সাঁতার কাটার পরিস্থিতি  তৈরিতে উচ্চকক্ষের আলোচনার বিরোধিতা করছি।
সংলাপে সূচনা বক্তব্যে অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ বলেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে প্রধান এবং মৌলিক দায়িত্বটা রাজনৈতিক নেতাদের। জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করতে হবে রাজনৈতিক দলগুলোকে। আমরা বিশ্বাস করি, যেসব বিষয়ে আপনারা একমত হয়েছেন, সেগুলো বাস্তবায়নের পথ আপনারা  তৈরি করতে পারবেন। সেখানে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন আনুষ্ঠানিক এবং অনানুষ্ঠানিকভাবে অনুঘটকের কাজ করবে।

পরবর্তী সময়ে প্রয়োজনবোধে এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার জন্য সুনির্দিষ্টভাবে বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে ঐকমত্য কমিশন সবাইকে নিয়ে বসবে। কমিশনের পক্ষ থেকে যে সুপারিশগুলো দেওয়া হয়েছিল, ছয়টি কমিশনের সুপারিশের সারাংশ আপনাদের কাছে দেওয়া হয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ের আলোচনায় অনেক বিষয়ে একমত হওয়া গেছে এবং তার একটি তালিকাও আপনাদের সরবরাহ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, সনদের টেক্সট নিয়ে ইতোমধ্যে আপনাদের পরিবর্তন, সংশোধনবিষয়ক মতামতগুলো আমরা পেয়েছি এবং তা প্রতিফলনের ভিত্তিতে চূড়ান্ত টেক্সট  তৈরি করছি। সনদের দুটি দিক রয়েছে, একটি হচ্ছে পটভূমিসহ আমরা কী কী বিষয়ে একমত হয়েছি এবং অপরটি হচ্ছে ভবিষ্যতে আবার আলোচনায় বসার প্রতিশ্রুতি। আমরা আশা করছি, আজকের মধ্যে সব বিষয়ে নিষ্পত্তি করে আলোচনা শেষ করতে পারব।

যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে সেগুলো এবং যেসব বিষয়ে ভিন্নমত থাকবে সেগুলোর তালিকা আপনাদের জানানো হবে। সেই ভিত্তিতে একটি পূর্ণাঙ্গ দলিল  তৈরি করা হবে এবং সব দলের স্বাক্ষরের মাধ্যমে তাকে চূড়ান্ত রূপ দেওয়া হবে। চূড়ান্ত তালিকা  তৈরি করে আপনাদের জানাব এবং আশা করি সবাই তাতে স্বাক্ষর করবেন।
উচ্চকক্ষ নিয়ে কমিশনে উত্তপ্ত বিতর্ক, উত্তেজনা ॥ জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর ২৩তম দিনের সংলাপে বৃহস্পতিবার উচ্চকক্ষ নিয়ে আলোচনার এক পর্যায়ে জাতীয় দল ও এনসিপির প্রতিনিধিদের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়।  মধ্যাহ্ন বিরতির আগে এ সময় সভাস্থলে কিছু সময় বিতর্ক চলে, উত্তেজিত হয়ে পড়েন নেতারা।
আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বা পিআর নিয়ে বিএনপির অবস্থান ব্যাখ্যা করে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, তারা সংবিধান সংশোধনের ক্ষমতা উচ্চকক্ষের হাতে দিতে চান না। উচ্চকক্ষের প্রতিনিধিদের অনির্বাচিত আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, ‘পৃথিবীর কোনো দেশেই অনির্বাচিত ব্যক্তিদের হাতে সংবিধান সংশোধনের ক্ষমতা থাকে না।’
তাঁর বক্তব্য শেষ হওয়ার পর এনসিপির যুগ্ম-আহ্বায়ক জাবেদ রাসিন বলেন, ‘ভোটের সংখ্যানুপাতিক ভিত্তিতে উচ্চকক্ষ গঠিত হলে, সেটি তো জনগণের প্রতিনিধিত্বের প্রতিফলন হয়।’ তিনি এ বিষয়ে সালাহউদ্দিন আহমদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে সালাহউদ্দিন একটি ব্যাখ্যা দেন।
এ সময় জাতীয় দলের চেয়ারম্যান এবং ১২ দলীয় জোটের সমন্বয়ক  সৈয়দ এহসানুল হুদা মাইক ছাড়া জাবেদ রাসিনকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘২০২৩ সালে যখন আন্দোলন হচ্ছিল, তখন আপনারা কোথায় ছিলেন?’ তখনই জাবেদ রাসিন তার প্রতিবাদ করেন (মাইক ছাড়া) এবং সঙ্গে সঙ্গে সংলাপে উত্তেজনা  তৈরি হয়। তাদের দুজনকেই তখন মাইক ছাড়া পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দিতে দেখা যায়। 
তখন কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, ‘হুদা ভাই, এর আগেও আপনারা একজনের বক্তব্য নিয়ে আপত্তি জানিয়েছিলেন। তখন আমরা থামিয়েছিলাম। এখানে আমরা কে কেন এসেছি, সে প্রশ্ন তুললে বিপজ্জনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। কারণ আজ যদি তিনি প্রশ্ন করেন, তাহলে রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আমাকেও তিনি প্রশ্ন করতে পারেন। আমরা সে আলোচনায় যাচ্ছি না।’
এরপর এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, ‘তিনি (হুদা) এই কথা বলতেই পারেন না।’ এ সময় সালাহউদ্দিন তার পিঠ চাপড়ে থামতে অনুরোধ করেন। আখতার হোসেন তখন বলতে থাকেন, ‘আমরা বাচ্চাকাল থেকে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে আসছি।’
এ সময় আলী রীয়াজ বলেন, ‘কারও স্ট্যান্ডিং নিয়ে প্রশ্ন করার দরকার নেই। প্রত্যেকের স্ট্যান্ডিং আছে বলেই আমরা এই জায়গায় আসতে পেরেছি।’ তখন আখতার হোসেন বলেন, ‘গায়ের জোরে এসব প্রশ্ন করলে তো আমরা মানব না।’ আলী রীয়াজ তখন বলেন, ‘আমি তো হস্তক্ষেপ করলাম।’
আখতার হোসেন তখন আবার বলেন, ‘সবাইকে নিয়ে আমরা গণঅভ্যুত্থান করেছি। গোটা অভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতা মাঠে নেমে এসেছিল, সেটার অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন করা হয়েছে। এটার জন্য তার (হুদার) ক্ষমা চাওয়া উচিত।’ এ সময় সালাহউদ্দিনকে বলতে শোনা যায়, ‘আচ্ছা হুদা ভাই, আপনি স্যরি বলেন।’
এসময় গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি এ বিষয়ে কথা বলতে উঠে দাঁড়ালে, আলী রীয়াজ তাকে অনুরোধ করে বসিয়ে দেন। সাকি কিছু একটা বলার চেষ্টা করলেও, মাইক ছাড়া তা শোনা যায়নি। পরে সালাহউদ্দিন হুদাকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘কেউ যদি মনে কষ্ট পেয়ে থাকে, তার জন্য স্যরি বলেন।’
তখন এহসানুল হুদা মাইক নিয়ে বলেন, ‘আমি বলতে চেয়েছিলাম ২০২৩ সালে আমরা উচ্চকক্ষের প্রস্তাব দিয়েছিলাম, তখন সে প্রস্তাবটি (পিআর) কোথায় ছিল। তারপরও কেউ যদি আঘাত পেয়ে থাকে, আমি দুঃখিত।’ এর পরপরই আলী রীয়াজ মধ্যাহ্নভোজের বিরতির ঘোষণা দেন।
বিরতির সময় হুদাকে আবার আখতারের কাছে তার বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিয়ে তার সঙ্গে কোলাকুলি করতে দেখা যায়। তখন হুদাকে বলতে শোনা যায়, ‘আমার অনুরোধ আমরা এটা নিয়ে আর সিন ক্রিয়েট না করি। আমার আপনাদেরকে নিয়ে প্রশ্ন করার কোনো ইনটেনশন ছিল না।’ পাশ থেকে একজনকে বলতে শোনা যায়, ‘আপনার এটা নিয়ে প্রশ্ন করা ঠিক হয়নি।’ পরে আখতার হোসেন হুদাকে জাবেদ রাসিনের সঙ্গে কোলাকুলি করিয়ে দেন।

প্যানেল হু

×