
.
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সারাদেশের সর্বস্তরে দল গোছাচ্ছে উজ্জীবিত বিএনপি। নির্বাচনের আগেই সব কমিটি পুনর্গঠনের কাজ শেষ করে ভোটের মাঠে শক্তি বৃদ্ধির কৌশল নিয়েছে দলটি। এ জন্য দলের সিনিয়র নেতারা তৎপর। অধিকাংশ সিনিয়র নেতাই দায়িত্বপ্রাপ্ত এলাকার কমিটি পুনর্গঠনের কাজ এগিয়ে নিতে মাঠে সক্রিয় রয়েছেন।
সূত্র মতে, ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে নির্বাচনের টার্গেট করে সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করছে বিএনপি। এ জন্য এ বছর ডিসেম্বরের মধ্যেই সারাদেশের সকল পর্যায়ের দলীয় কমিটি পুনর্গঠনের কাজ শেষ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
উল্লেখ্য, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলন দীর্ঘদিন রাজনৈতিকভাবে বেকায়দায় থাকা বিএনপিকে ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ করে দিয়েছে। এ আন্দোলনের কারণে গতবছর আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ দলের সর্বস্তরের কারাবন্দি নেতাকর্মীরা মুক্তি পেয়েছেন। এছাড়া যারা দীর্ঘদিন আত্মগোপনে কিংবা বিদেশে ছিলেন, তারাও রাজনীতিতে ফিরে এসেছেন। এক পর্যায়ে তারা সবাই দলীয় রাজনীতিতে সক্রিয় হয়েছেন। সম্প্রতি রাজধানীতে বড় ধরনের সমাবেশ করে দলের রাজনৈতিক শক্তিও প্রদর্শন করেছে বিএনপি।
সূত্র জানায়, বিএনপির সামনে এখন প্রধান লক্ষ্য দল গুছিয়ে পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি জোরদার করা। এ জন্য যা যা করণীয় তাই এখন দলের নেতাকর্মীরা করছেন। দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটির নেতাকর্মীদের মনোবল এখন চাঙ্গা। তাই দলের যে কোনো কর্মসূচিতে এখন তাদের সরব উপস্থিতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
এদিকে সারাদেশে পুরোদমে দল গোছানোর কাজ এগিয়ে চলায় বিএনপির অধিকাংশ নেতাকর্মী চায় জাতীয় কাউন্সিলের মাধ্যমে যেন দলের নতুন নির্বাহী কমিটি গঠন করা হয়। তবে দলীয় হাইকমান্ড কি চান, তার ওপর নির্ভর করবে সংসদ নির্বাচনের আগে জাতীয় কাউন্সিল হবে কি হবে না, আর হলেও কখন হবে। দলের একটি অংশ চায় আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই যেন বিএনপির জাতীয় কাউন্সিল হয়। কারণ, প্রায় সাড়ে ৯ বছর ধরে বিএনপির জাতীয় কাউন্সিল হচ্ছে না।
বিএনপির গঠনতন্ত্র অনুসারে ৩ বছর পর পর জাতীয় কাউন্সিলের মাধ্যমে নতুন কমিটি গঠনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। আরপিও (গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ) অনুসারেও ৩ বছরের মধ্যে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর জাতীয় কাউন্সিল করার বিধান রয়েছে। কিন্তু প্রায় সাড়ে ৯ বছর আগে জাতীয় কাউন্সিল করা হলেও তারপর আর কাউন্সিল করা হয়নি। দল পুনর্গঠনের জন্য জাতীয় কাউন্সিল একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া। বিভিন্ন কারণে জাতীয় কাউন্সিল করতে না পারায় এখনো মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি দিয়েই চলছে বিএনপি। তবে মাঝেমধ্যেই ৫৯২ সদস্যের আগের কমিটিতে শূন্য থাকা পদগুলোর বিপরীতে কিছু পদ পূরণ করা হয়। আরও কিছু পদ পূরণের জন্যও কিছু নেতার নাম সামনে এসেছে বলে জানা যায়।
বিএনপি নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ অনুষ্ঠিত সর্বশেষ জাতীয় কাউন্সিলের পর দলের যে কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হয়, সে কমিটির দুই শতাধিক নেতা এক পর্যায়ে দলে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। যদিও আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগের পর এখন তাদের মধ্যে কেউ কেউ আবার দলে সক্রিয় হয়েছেন। তবে দল পুনর্গঠনের অংশ হিসেবে জাতীয় কাউন্সিল হলে নতুন নির্বাহী কমিটিতে আগের কমিটির শতাধিক নেতা বাদ পড়বেন। এ ছাড়া প্রায় ৫০টির মতো পদ এখনো শূন্য রয়েছে। তাই নতুন কমিটিতে দেড় শতাধিক পদে স্থান পাওয়ার সুযোগ পাবে অন্য নেতারা। তবে জাতীয় কাউন্সিল না হলে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বর্তমান কমিটির বিভিন্ন শূন্য পদে আরও কিছু নেতাকে স্থান দেওয়া হতে পারে বলে সূত্র জানায়।
প্রসঙ্গত, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া অসুস্থ থাকায় দলের সার্বিক কর্মকা- এখন নিয়ন্ত্রণ করছেন লন্ডন প্রবাসী ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনি নিয়মিত দলের বিভিন্ন স্তরের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য যাচাই-বাছাই করে এবং স্থায়ী কমিটির সদস্যদের পরামর্শ নিয়ে তারেক রহমান দলের জন্য বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এ ছাড়া দল গোছানোর অংশ হিসেবে তিনি এখন সারাদেশের সকল পর্যায়ের নেতার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন বলে জানা যায়।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দলের জন্য বৈরী পরিবেশ বিরাজ করায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান আগে জাতীয় কাউন্সিলের বিষয়ে তেমন আগ্রহী না হলেও দেশের বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তিনিও এখন কাউন্সিলের বিষয়ে আগ্রহী হবেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়। তাই কাউন্সিলের আগে সারাদেশে দলের সর্বস্তরের কমিটি পুনর্গঠন কাজ এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে দলের জাতীয় কাউন্সিল হবে ধরে নিয়ে বর্তমান কমিটিতে না থাকা বিএনপির পরবর্তী কমিটিতে স্থান পেতে আগ্রহী দুই শতাধিক নেতা দৌড়ঝাঁপ করছেন বলে জানা যায়।
তবে জাতীয় কাউন্সিল হোক আর না হোক ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সর্বস্তরে নেতাকর্মীদের চাঙা করতে সারাদেশের সকল ইউনিটে কমিটি পুনর্গঠনের কাজ চলছে বলে দলীয় নেতাকর্মীরা জানিয়েছেন। প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোনো না কোনো ইউনিট কমিটি পুনর্গঠন করা হচ্ছে। অধিকাংশ ইউনিট কমিটি প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমেই করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান জনকণ্ঠকে জানান, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে এখন আমাদের প্রধান কাজ দল গোছানো। সর্বস্তরে দল গুছিয়ে পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি জোরদার করতে হবে। তাই সর্বস্তরে দল পুনর্গঠনের কাজ পুরোদমে চলছে।
বিএনপির আরেক স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী জনকণ্ঠকে বলেন, দলের কমিটি পুনর্গঠনের কাজ এগিয়ে চলছে। যথাসময়েই সারাদেশের সকল পর্যায়ে দলের কমিটি পুনর্গঠনের কাজ শেষ হবে।
অভিজ্ঞ মহলের মতে, ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ছেড়ে আসার পর থেকেই বিভিন্ন কারণে রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা ছিল বিএনপি। বিএনপির নেতাকর্মীদের ওপর ওয়ান-ইলেভেনের সরকারের বৈরী আচরণের কারণে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিলেও কাক্সিক্ষত সফলতা অর্জন করতে পারেনি। যে কারণে এ নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলেও জাতীয় সংসদের বিরোধী দলের আসনে থাকতে হয় বিএনপিকে। ওয়ান-ইলেভেন সরকারের ধারাবাহিকতায় আওয়ামী লীগ সরকারও বিএনপির ওপর বৈরী আচরণ শুরু করে। এ কারণে রাজপথে আন্দোলন করতে গিয়ে ভালোভাবে দল গোছানোর কাজ করতে পারেনি বিএনপি। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে আওয়ামী লীগ সরকারের আরও বেশি রোষানলে পড়ে বিএনপি। আর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিলেও দিনের ভোট আগের দিন রাতে নিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উত্থাপন করে ভোটের দিন নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেয় বিএনপি। এ নির্বাচনের পর বিএনপির ওপর তৎকালীন সরকারের মামলাসহ বিভিন্নভাবে হয়রানি বৃদ্ধি পেলেও সব উপেক্ষা করে বিএনপি আস্তে আস্তে আন্দোলন জোরদার করতে সক্ষম হয়। গতবছর জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে বিএনপিও রাজপথে অধিকতর সক্রিয় হয়। উত্তাল আন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে প্রায় ১৯ বছর পর বিএনপির জন্য রাজনৈতিক পরিবেশ অনুকূল হয়। তাই বর্তমান পরিস্থিতিতে সর্বস্তরে দল গুছিয়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি জোরদার করছে বিএনপি।
প্যানেল