ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৩ জুলাই ২০২৫, ১৯ আষাঢ় ১৪৩২

গুম কমিশনের প্রতিবেদনে চাঞ্চল্য

নারীদের ঝুলিয়ে উল্লাস করত বাহিনীর সদস্যরা

ফজলুর রহমান

প্রকাশিত: ২৩:২৩, ২ জুলাই ২০২৫

নারীদের ঝুলিয়ে উল্লাস করত বাহিনীর সদস্যরা

নারীদের ঝুলিয়ে উল্লাস করত বাহিনীর সদস্যরা

‘কখনো ঝুলিয়ে পেটানো হতো, কখনো আঙুলের নখ উপড়ে ফেলা হতো, আবার কখনো বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হতো। এতে অনেকে অজ্ঞান হয়ে যেতেন, বমি করে দিতেন, আবার কেউ কেউ চোখ বাঁধা অবস্থায় নিজের শরীরের মাংস পোড়া গন্ধ পেতেন। নির্যাতনের এই ভয়াবহতা থেকে রেহাই পেত না নারীরাও। তাদের ঝুলিয়ে বিকৃত উল্লাস করে অট্টহাসিতে ফেটে পড়তেন বাহিনীর সদস্যরা।

শিফটিং সিস্টেমে কয়েক ঘণ্টা পরপর বিভিন্ন পদ্ধতিতে নির্যাতন চালানো হতো তাদের ওপর। নির্যাতনের এসব ভয়াবহ পদ্ধতিগুলো ভুক্তভোগীদের কাছে নরক যন্ত্রণার মতোই। যার মধ্যে ঘূর্ণায়মান চেয়ার, বৈদ্যুতিক শট দেওয়ার যন্ত্র, র‌্যাবের টিএফআই সেলে মানুষ ঝুলিয়ে নির্যাতনের পুলি-সিস্টেম অন্যতম। প্রাকৃতিক প্রয়োজন মেটানোর সময়ও সিসিটিভির  নজরদারির মধ্যে থাকতে হতো তাদের।’ আওয়ামী লীগ শাসনামলে ‘সরকারবিরোধী যড়যন্ত্র’ সম্পর্কে জানতে টার্গেট করা ব্যক্তিদের বিশেষ সেলে গুম করার পর এমন ভয়াবহ নির্যাতন করা হতো।

বিশেষ করে র‌্যাব, সিটিটিসি ও একটি বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের বিভিন্ন পদ্ধতির লোমহর্ষক নির্যাতনের ভয়াবহতা ফুটে উঠেছে অনেক ভুক্তভোগীর বর্ণনায়। গুম থাকা অবস্থায় চলতে থাকা নির্যাতন ও দীর্ঘক্ষণ প্রহার থাকা, অমানবিক আবাসস্থল দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলেছে নির্যাতনের শিকার ভুক্তভোগীদের মধ্যে। অনেকেই মানসিক ভারসাম্যহীনভাবে জীবনযাপন করছেন। চিকিৎসা নিয়েও সুস্থ জীবনে ফিরতে পারেননি অনেকে। ভয়ানক নির্যাতনের স্মৃতি মনে করে আঁতকে ওঠেন বেশিরভাগ ভুক্তভোগী।

একই সঙ্গে এসব ভুক্তভোগীদের অনেকেই মিথ্যা মামলায় জর্জরিত হয়ে আর্থিক ক্ষতিতে পড়ে নিঃস্ব হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে গুম কমিশনের দাখিল করা দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৫ আগস্টের পূর্বে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বাংলাদেশে চালু থাকা গুম ও নির্যাতনের সংস্কৃতি র‌্যাব, সিটিটিসি ও একটি বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে বাস্তবায়িত হতো। প্রমাণ ধ্বংসের চেষ্টা সত্ত্বেও কমিশন এমন উপাদান সংগ্রহ করেছে- যা ভুক্তভোগীদের সাক্ষ্যের সঙ্গে মিলে যায়। বিশেষ করে র‌্যাব-২ এবং সিপিসি-৩ এ ব্যবহৃত ঘূর্ণায়মান চেয়ার,  টিএফআই সেলের মানুষ ঝুলিয়ে রাখার জন্য ব্যবহৃত পুলি-সিস্টেম এবং একাধিক স্থানে শব্দনিরোধক ব্যবস্থা, যা নির্যাতনের সময় ভুক্তভোগীদের চিৎকার বাইরের কেউ যাতে না শুনতে পারে সে জন্য ব্যবহৃত হতো।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীদের গুম করা হতো। অর্থাৎ তাদের আটকের কোনো আনুষ্ঠানিক রেকর্ড থাকত না। এর ফলে নিরাপত্তা বাহিনীগুলো দায়মুক্তভাবে নির্যাতন চালাতে পারত। পরবর্তীতে জনসম্মুখে হাজির করার আগে নির্যাতনের চিহ্ন লুকাতে কিছু ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীদের ওষুধ বা মলম দেওয়া হতো, যাতে ক্ষতচিহ্ন সহজে নজরে না আসে। অনেক ক্ষেত্রে নির্যাতনের চিহ্ন মুছে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করেই তাদের মুক্তি দেওয়া হতো। তবে অনেক ভুক্তভোগী ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির হয়েছিলেন স্পষ্ট নির্যাতনের চিহ্নসহ, যদিও সেসব উপেক্ষা করা হয়েছিল। 
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১৮ সালে ২৫ বছর বয়সী এক নারীকে অপহরণ করে পুলিশ। ২৪ দিন নিখোঁজ ছিলেন ওই নারী। গুম কমিশনকে তিনি বলেছেন, অনেকটা ক্রুসবিদ্ধ হওয়ার মত করে হাত দুই দিকে বেঁধে ঝুলিয়ে রেখেছে। ওরা আমাদের ওড়না নিয়ে নিছিল করেছে। আমার গায়ে ওড়না ছিল না। আর যেহেতু জানালার দিকে মুখ করা ছিল, অহরহ পুরুষ মানুষ যে কতগুলা আসছে দেখার জন্য এটা বলার বাহিরে। মানে তারা একটা মজা পাচ্ছে।

বলাবলি করতেছিল যে, ‘এমন পর্দাই করছে, এখন সব পর্দা ছুটে গেছে। তিনি আরও বলেন, আমার পিরিয়ড হওয়ার ডেট ছিল অনেক লেটে। কিন্তু যেই টর্চার করে তাতে আমি এত পরিমাণ অসুস্থ হয়ে যাই যে, সঙ্গে সঙ্গে আমার পিরিয়ড আরম্ভ হয়ে যায়। তারপর উনাদেরকে বলি যে, আমার তো প্যাড লাগবে- এটা নিয়ে অনেক হাসাহাসি করে। 
৩৯১ দিন গুম ছিলেন ৪৬ বছর বয়সী এক ব্যক্তি। তিনি জানিয়েছেন, পুরুষ ভুক্তভোগীদের জন্য সেলের ভেতরে গোপনীয়তার অভাব ছিল বিশেষভাবে নির্মম। সেলগুলো ছিল ক্ষুদ্র ও সংকীর্ণ। সেলে টয়লেট ব্যবহারের জন্য নিচু বিল্ট-ইন প্যান বসানো ছিল। তবে, মাঝে কোনো দেওয়াল না থাকায়, ভুক্তভোগীরা যখন শুয়ে থাকতেন, তখন তাদের শরীর প্রায়শই ওই প্যানের উপরেই পড়ে থাকত। যার ফলে তারা ময়লা, প্রস্রাব ও মলের অস্বাস্থ্যকর অবস্থার মধ্যে থাকতে বাধ্য হতেন।

আরও ভয়াবহ ছিল, এসব সেলে স্থাপন করা সিসিটিভি ক্যামেরা, যা প্রতিটি কর্মকা- পর্যবেক্ষণ করত। ফলে ভুক্তভোগীদের সবচেয়ে ব্যক্তিগত মুহূর্তেও, যেমন প্রাকৃতিক কাজের জন্য টয়লেট প্যান ব্যবহারের সময়ও, চরম অপমান ও লজ্জার মধ্যে থাকতে হতো। ঠিকমতো ঘুমাতেও দিত না নিরাপত্তা প্রহরীরা। যা ছিল চরম অমানবিক।
২০২৩ সালে সিটিটিসি কর্তৃক ১৬ দিন গুম ছিলেন ৪৭ বছর বয়সী এক ব্যক্তি। তিনি বলেছেন, চোখে কখনো গামছা দিয়ে, কখনো ওই যে জম টুপি, এগুলো দিয়ে বাঁধা থাকত। হাত কখনো সামনে, কখনো পেছনে। আর যখন বেশি মারবে, তখন এই হাত পেছনে দিয়ে রাখত আর আমার এই কনুইগুলো, দুই হাঁটু এগুলোতে খুব জোরে জোরে মারত মোটা লাঠি দিয়ে। আমি মনে করতাম, আমার হাড়গুলো বুঝি ভেঙে যাবে। কিন্তু পরবর্তীতে দেখলাম যে, ফুলে অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গেছে। কিন্তু হাড় ভাঙছে এ রকম বুঝি নাই। একপর্যায়ে আমাকে বলল যে, তোর হাড় থেকে মাংস আলাদা করে ফেলব। 

র‌্যাব-১১ কর্তৃক ৪২ দিন গুম থাকা এক ব্যক্তি জানিয়েছেন, ‘হাত সম্ভবত গামছা বা কাপড় দিয়া বানছে আর কি। বাইনদা, আমার এই হাঁটুর ভেতরে দিয়া হাত ঢুকাইয়া এই দুই হাঁটুর মাঝখান দিয়া লাঠি ঢুকাইয়া একটা উঁচু কোনো স্ট্যান্ডের মধ্যে রাখছে। যেটার কারণে আমার পাগুলো উপরে ছিল। আর মাথা নিচু হয়ে গেছে। পায়ের তালুর মধ্যে এবার বাড়ি শুরু করছে। চিকন একটা লাঠি হবে সম্ভবত। আবার ওই প্রথম থেকে একই প্রশ্ন, নামগুলা বলো, তোমার সঙ্গে কে কে আছে।’ 
৫৬ বছর বয়সী এক ব্যক্তি জানিয়েছেন, নির্যাতনের একপর্যায়ে আঙ্গুলের নখ উপড়ে ফেলা হয়। র‌্যাব-১০ কর্তৃক গুমের শিকার ওই বক্তি জানিয়েছেন, গ্রিলের মধ্যে হ্যান্ডকাফ দিয়ে আমাকে দাঁড় করিয়ে রাখত। আমি যাতে বসতে না পারি। পা ফুলে গেছে আমার। আমার হাতে দাগ পড়ছে। এই যে দাগগুলো ওয়াশরুমে যেতে চাইলে, ওয়াশরুমে যেতে দিত না। এর মধ্যে একদিন এসে আঙ্গুলটাকে এভাবে প্লাস দিয়ে ধরেছে। ধরার পরে টেবিলের ওপরে হাত রেখে, প্লাস ধরে, আরেকজন সুঁচ ঢুকাইছে। এই যে সুইয়ের দাগ। কয়, তুই আব্দুল মুমিন না? স্যার, আমি আব্দুল মুমিন না, আমার নাম হলো...।
এ ছাড়াও একাধিক ভুক্তভোগী জানিয়েছেন, মুখের ভেতর গামছা দিয়ে পানি দেওয়া, ঘূর্ণায়মান চেয়ারে বসিয়ে নির্যাতন, প্রশ্রাবের সময় বৈদ্যুতিক শক, গোপনাঙ্গে বৈদ্যুতিক শক দেওয়া ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। এক তরুণ ভুক্তভোগী জানিয়েছেন, একটা যে কঠিন শাস্তি দিছে, শাস্তিটা হলো একটা অন্যরকম। আমার তো চোখ বাঁধা, আমার কিন্তু চোখ বাঁধা। আমারে ধইরা নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে ওইদিন, পিটনা দেওয়ার পরে আবার জিজ্ঞাসাবাদ করতেছে। তখন আমি বুঝি যে, আজকে আমার জীবন শেষ। জিজ্ঞাসাবাদ করার পরে কইতেছে, এখানে প্রস্রাব কর। এখন এখানে প্রস্রাব কর। প্রস্রাব করার সঙ্গে সঙ্গে আমি অনুমান করছি যে, আমি মনে হয় পাঁচ ফিট উপরে উঠছি, একটা ফাল দিয়া, ইলেকট্রিক শক সবচেয়ে বড় কোনো স্থানে।
কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মুক্তির পরও নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিরা দীর্ঘমেয়াদি মানসিক ট্রমার স্পষ্ট লক্ষণ বহন করেন। তাদের চলমান চিকিৎসা ও মনোস্বাস্থ্য সহায়তার প্রয়োজন হয়, এবং অনেকের শিক্ষা ও কর্মজীবন ব্যাহত হয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয় নিরাপত্তা বাহিনীর দায়ের করা ভুয়া মামলাগুলোর আইনি লড়াইয়ের ব্যয়। প্রতিটি মামলার জন্য একজন ভুক্তভোগীর গড়ে প্রায় ৭ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। অনেকের পারিবারিক জীবন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পরিবারগুলো এই চাপ সহ্য করতে পারে না। ফলে ভুক্তভোগীরা এক অনিশ্চয়তা ও প্রান্তিকতার জীবনে আটকে পড়েছেন। ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন।

×