ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৪ জুন ২০২৫, ৩১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

বিচার, সংস্কার ও জুলাই সনদের আগে ভোট নয়

আবদুর রহিম

প্রকাশিত: ২৩:১০, ১৩ জুন ২০২৫

বিচার, সংস্কার ও জুলাই সনদের আগে ভোট নয়

.

শিশু শহীদ জাবির ইব্রাহিম। বয়স মাত্র ৬ বছর। পড়ছিল শিশু শ্রেণিতে। টেলিভিশন এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জুলাইয়ে ছাত্র-জনতাকে গণহত্যার দৃশ্য দেখে গত ৫ আগস্ট রাস্তায় নামে এই শিশুও। তার অগ্নি স্লোগান দেখে টার্গেট করে বিপথগামী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা জাবিরকে খুন করে। শরীরের একপাশ দিয়ে গুলি ঢুকে আরেকপাশ দিয়ে ভেদ করে গুলি বেরিয়ে পড়ে। অভ্যুত্থানের গত ১০ মাসে বেশ কয়েকবার ড. ইউনূসসহ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে দেখা করেছেন জাবিরের বাবা কবির হোসেন। জাবিরসহ দুই হাজার ছাত্র-জনতার হত্যার বিচার প্রক্রিয়া শেষ করতে চেয়েছেন রোডম্যাপ। ইতোমধ্যে সকল শহীদ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে তারা গঠন করেছেন একটি সোসাইটি। যার উদ্দেশ্য জুলাই গণহত্যার বিচার নিশ্চিত করা। গতকাল লন্ডনে দেশের চলমান সংকট নিয়ে হয়ে গেল ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও তারেক রহমানের মধ্যে বৈঠক। সেখান থেকে এলো আগামী বছরের মধ্য ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচনের সম্ভাব্য রোডম্যাপ। এতে সন্তুষ্ট হতে পারেনি শহীদ পরিবার।
ক্ষোভ প্রকাশ করে জাবির ইব্রাহিমের বাবা কবির হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, আমার সন্তান জাবির ইব্রাহিমসহ দুই হাজার শহীদ পরিবারের কেউ নির্বাচনের জন্য জীবন দেয়নি। দেশের সবচাইতে বড় সংকট ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আমার সন্তানরা প্রতিবাদ তুলে জীবন দিয়েছে। দেশের চলমান সংকট নিয়ে গতকাল বিদেশের মাটিতে সব চাইতে বড় দল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠক করেছেন সেখানে আমাদের সন্তানদের স্মরণ করেছে বলে আমাদের চোখে পড়েনি। আর আমাদের সন্তানরা দেশের মাটিতে রক্ত দিয়েছে আর সংকটের সমাধান হচ্ছে বিদেশের মাটিতে তা আমাদের হতাশ করেছে। আমরা স্পষ্ট ভাষায় সরকারকে বলে দিতে চাই, আমাদের সন্তানদের রক্তের ওপর এই সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। আমাদের সন্তান হত্যার বিচার, আওয়ামী খুনিদের বিচার নিশ্চিত, জুলাই সনদপত্র বাস্তবায়ন এবং মৌলিক সংস্কারের আগে দেশে কোনো নির্বাচন হবে না। যদি আমাদের সন্তান হত্যার বিচার নিশ্চিত না করে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের দিকে হাঁটা হয় তাহলে আমরা দুই হাজার শহীদ পরিবার রাস্তায় নামব। আমাদের যে সোসাইটি রয়েছে তার ব্যানারে কর্মসূচি চালিয়ে যাব।
শুধু শহীদ পরিবার নয় দেশের সংকট বিদেশের মাটিতে সমাধানের পথ খোঁজায় এবং শহীদ পরিবারের সঙ্গে আলোচনা না করায় ক্ষুব্ধ জুলাই অভ্যুত্থানের নায়কেরা। তারাও বলছেন, বাংলাদেশে নির্বাচনের জন্য জুলাই অভ্যুত্থান হয়নি। যে কারণে অভ্যুত্থান হয়েছে আগে তার মৌলিক সংস্কার এই সরকারকে করতে হবে। শহীদ পরিবার আহত যোদ্ধাদের সঙ্গে সরকারকে বসতে হবে। বিচারের রোডম্যাপ নিশ্চিত করতে হবে।
জুলাই অভ্যুত্থানে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সমন্ধয়ের দায়িত্ব পালন করা অন্যতম সংগঠক ও নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেছেন, একটি রাজনৈতিক দলকে খুশি করার জন্য জাতীয় সংসদ নির্বাচন এগিয়ে আনা হচ্ছে, যা জুলাইয়ের শহীদদের সঙ্গে প্রতারণা। যুক্তরাজ্যের লন্ডনে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠকে দেশবাসীর প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। তিনি বলেন, এ বৈঠকে দেশের মাটি ও মানুষের কোনো সংযোগ নেই। সংস্কার আর বিচারকে পাশ কাটিয়ে সরকার যে নির্বাচনের দিকে যাচ্ছে, তা ১৮ কোটি মানুষের নির্বাচন হবে না। এমনভাবে নির্বাচনের দিকে গেলে আরেকটা ফ্যাসিবাদের জন্ম হবে। জনগণ আবারও গণঅভ্যুত্থানে যেতে বাধ্য হবে। তিনি আরও বলেছেন, বিদেশের মাটিতে বসে যখন সরকার বিশেষ দলের সঙ্গে নির্বাচন নিয়ে বৈঠকে বসে তখন এটা হয়ে যায় গণঅভ্যুত্থানের আকাক্সক্ষার পরিপন্থি। সেখানে জুলাই ঘোষণার স্পষ্ট বার্তা দেখিনি। মৌলিক সংস্কার প্রশ্নেও বার্তা পাইনি।
জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) যুগ্ম সদস্যসচিব সালেহ উদ্দিন সিফাত বলেছেন, লন্ডন বৈঠকে নির্বাচনের তারিখ আগানো-পেছানো যতটুকু গুরুত্ব পেয়েছে, বিচার ও সংস্কার সেই গুরুত্ব পায়নি। এটা বেশ হতাশাজনক। উপরন্তু, নির্বাচন প্রশ্নে সরকার কেবল একটি রাজনৈতিক দলের কনসার্নকেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছেন বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। আমরা মনে করি, জুলাই সনদ কার্যকর করা ব্যতীত সংসদ নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না।
দলটির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব বলেছেন, শহীদ পরিবারের সঙ্গে আলাপ করে নির্বাচনের সময় দেওয়া উচিত ছিল। এক দলের সঙ্গে আলাপ করে সিদ্ধান্ত নেওয়া অশনিসংকেত।
এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার বলেছেন, কী পদ্ধতিতে সংস্কার হবে তা ঠিক হয়নি। এর আগেই প্রধান উপদেষ্টার গণভোট খারিজ করার সিদ্ধান্ত ভালো কিছু নয়।
জুলাই অভ্যুত্থানের অন্যতম নায়ক মাহিন সরকার বলেছেন, এই যে লন্ডনে বৈঠক হলো দেশের জনগণকে পাশ কাটিয়ে তাতে বিচার প্রক্রিয়ার কতদূর? গণপরিষদ নির্বাচন কতদূর? মৌলিক সংস্কারের কতদূর অগ্রগতি হয়েছে তা কী জাতিকে জানানো হবে?
জুলাই অভ্যুত্থানের আরেক সংগঠক সিনথিয়া জাহিন আয়েশা বলেন, আমরা শুরু থেকেই বলে আসছি দ্বিতীয় বিজয়ের বাংলাদেশে সবার আগে প্রয়োজন গণহত্যার বিচার। এই বিচারের আগে যদি নির্বাচন হয়। তাতে যদি ক্ষুব্ধ হয়ে শহীদ পরিবার ও ছাত্র-জনতা রাস্তায় নামে আমরা অবশ্যই শহীদ পরিবারের পাশে থাকব। প্রয়োজনে আবারও জীবন দিতে রাজপথে থাকব।

প্যানেল

আরো পড়ুন  

×