
হাসিনার সরকার ক্ষমতায় থাকার সময় ১৫ বছরের মধ্যে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে দেশের বিভিন্ন শহর ও অঞ্চলে বঙ্গবন্ধুর ১০ হাজারেরও বেশি ম্যুরাল, ভাস্কর্য ও প্রতিকৃতি স্থাপন করা হয়, যার জন্য ব্যয় হয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরাল ও ভাস্কর্য নির্মাণ কার্যে সরকারের বিশাল অংকের অর্থ ব্যয়ের হয়েছে কিন্তু নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পর এগুলো ভাঙনের কাজ শুরু করেছে।
বর্তমানে বাংলাদেশের আটটি বিভাগের ১২টি সিটি করপোরেশন, ৬৪টি জেলা, ৪৯৫টি উপজেলা, ৩৩১টি পৌরসভা ও চার হাজার ৫৭৮টি ইউনিয়নের সব কটিতেই ম্যুরাল ও ভাস্কর্য নির্মাণের নির্দেশ ছিল সরকারের পক্ষ থেকে। আগামী বছরের মধ্যে সব ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভায় ম্যুরাল ও ভাস্কর্য নির্মাণের পরিকল্পনা ছিল।
সরকারি কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, এই ম্যুরাল নির্মাণে প্রাথমিকভাবে অনুমান করা হয় যে, চার হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছে। আদতে কি দরকার ছিল ? এসব ভাস্কর্য, ম্যুরাল ও প্রতিকৃতির জন্য প্রধানত স্থানীয় প্রশাসন এবং বিভিন্ন সরকারি মন্ত্রণালয় ছিল দায়ী। বিশেষ করে, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং স্থানীয় সরকার বিভাগের পাশাপাশি প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিভিন্ন দপ্তরও নিজের উদ্যোগে এই কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে। ভাস্কর্য ও প্রতিকৃতি তৈরিতে অতি উৎসাহ দেখিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। তাদের সাথে সহায়তা করেছে স্থানীয় সরকার বিভাগ।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এই অপ্রয়োজনীয় ম্যুরাল ও ভাস্কর্য তৈরিতে চার হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত ব্যয় হয়ে থাকতে পারে। এসব ম্যুরাল,
এর বাইরে প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিটি দপ্তরের প্রধানরাও পিছিয়ে ছিলেন না। তাঁরা এসব তৈরি করে আওয়ামী লীগ সরকারে আস্থাভাজন হতে চেয়েছিলেন; হয়েছিলেনও। তবে এই ভাস্কর্য ও ম্যুরাল বা প্রতিকৃতি নির্মাণে পৃথক কোনো প্রকল্প নেওয়া হয়নি। সরকারি অর্থে স্থানীয় প্রশাসন এই ভাস্কর্য ও ম্যুরাল বা প্রতিকৃতি নির্মাণ করেছে। কৌশলগত কারণেই এমনটি করা হয়েছে, যাতে এসব নির্মাণে কত ব্যয় হয়েছে তার হিসাব এককভাবে কোনো দপ্তরে না থাকে।
শুধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য নয়, ভাস্কর্য তৈরি করা হয়েছে তাঁর স্বজনদেরও। এমনকি তাঁর বইয়েরও। সিরাজগঞ্জের যমুনা নদীর পারে অসমাপ্ত আত্মজীবনী ও কারাগারের রোজনামচা বইয়ের ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়।
এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আবু সালেহ মো. হানিফ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ম্যুরাল বা ভাস্কর্য নির্মাণের জন্য পৃথক কোনো প্রকল্প গ্রহণ করা হয়নি। তবে স্থানীয় প্রশাসনের বাজেট বরাদ্দ থেকে এই খাতে ব্যয় করা হয়। এলজিইডি এতে কারিগরি সহায়তা করে। এগুলো অতিরিক্ত হয়েছে, যা উচিত হয়নি।’
এর বাইরে সরকারি-বেসরকারি মাধ্যমিক স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে বসানো হয় ম্যুরাল। বাদ যায়নি প্রাইমারি স্কুলও। স্কুলের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য দেওয়া স্লিপ ফান্ডের টাকা দিয়ে ম্যুরাল নির্মাণ করা হয়েছিল। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ৩২টি বোর্ড, অধিদপ্তর বা সংস্থার প্রতিটিতে ম্যুরাল স্থাপন করা হয়েছিল। এভাবে মন্ত্রণালয়গুলোর অধীনে অন্তত ৭০০ কার্যালয়, সংস্থা-দপ্তর রয়েছে, যার বেশির ভাগেই ম্যুরাল ছিল। এগুলোর কোনোটিতে ৩০ লাখ, আবার কোনোটিতে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ হয়েছে।
সরকারি কর্মকর্তারা জানান, কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে ২০টি সংস্থা রয়েছে, যার প্রতিটি কার্যালয়েই ম্যুরাল স্থাপন করা হয়। এমনকি কোনো কোনো আঞ্চলিক কার্যালয়েও ম্যুরাল স্থাপন করা হয়েছিল। সড়কের শুরুতে, শেষে, চৌরাস্তায়, নদীর তীরে, পুকুরপারে, প্রতিষ্ঠানের প্রবেশপথে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আঙিনায়—এমন কোনো স্থান নেই যেখানে এগুলো বসানো হয়নি।
শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ম্যুরালের নকশা ও ডিজাইন তৈরিতে খরচ হয় ৫০ লাখ টাকা। এ ছাড়া স্থাপনা এবং অন্যান্য বিষয় মিলিয়ে এর মোট ব্যয় হয় এক কোটি ২৫ লাখ টাকা।
রাজধানীতে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের (বিএআরসি) অর্থায়নে তৈরি করা ম্যুরালটির উচ্চতা ১০ ফুট ও প্রস্থ আট ফুট। নির্মাণে সময় লাগে তিন মাস। ব্যয় হয় প্রায় ২০ লাখ টাকা। বাংলাদেশ বেতার পাঁচ কোটি ৭৮ লাখ ৩৪ হাজার টাকায় মুর্যাল নির্মাণ করে।
শুধু ম্যুরাল বানানোর নামে চার হাজার কোটি টাকা খরচ করে ১০ হাজার মূর্তি বানানো হয়েছে ভাবা যায়?
জাফরান