ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ০৭ জুলাই ২০২৫, ২৩ আষাঢ় ১৪৩২

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে কমেছে পরিযায়ী পাখির আগমন

ওয়াজহাতুল ওয়াস্তি, জাবি সংবাদদাতা

প্রকাশিত: ১৫:৫৩, ১৪ জানুয়ারি ২০২৪; আপডেট: ১৫:৫৭, ১৪ জানুয়ারি ২০২৪

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে কমেছে পরিযায়ী পাখির আগমন

পরিযায়ী পাখি।

সবুজ গাছপালা আর আঁকা-বাকা লেকের এক অনন্য ভূমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) ক্যাম্পাস। এখানে প্রকৃতি একেক ঋতুতে একেক রূপে সাজে। শীত এলে লেকগুলোতে ফুটে লাল শাপলা। আর তাতে নতুন মাত্রা যোগ করে দেশ-বিদেশ থেকে আসা পরিযায়ী পাখিরা। দিনভর লাল শাপলার বুকে পাখির জলকেলি আর কিচির-মিচির ডাকে মুখর থাকে পুরো ক্যাম্পাস। তবে এই চিত্র এখন আর তেমন একটা চোখে পড়ে না। 

গত কয়েক বছরে লেকগুলোতে কমেছে পরিযায়ী পাখির আগমন। এবছর একটি সংরক্ষিত লেক ব্যতীত অন্যগুলোতে পাখি নেই। পাখি গবেষক ও পরিবেশবিদরা বলছেন, লেকের পাড়ে শব্দদূষণ, গাছ কর্তন, লেক অব্যবস্থাপনা, বিশৃঙ্খলার দরুন সৃষ্ট আতঙ্কে পাখির এই অভয়াশ্রমে এখন প্রতিক‚ল পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। যার দরুন কমে গেছে পাখির আগমন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের তথ্য মতে, সাধারণত নভেম্বরের মাঝামাঝি সময় থেকে লেকগুলোতে পরিযায়ী পাখি আসতে শুরু করে। মূলত এসব পাখির আবাসস্থল হিমালয়ের উত্তরের দেশ সাইবেরিয়া, চীন, মঙ্গোলিয়া ও নেপাল। বছরের এই সময়ে উক্ত স্থানগুলোতে প্রচুর তুষারপাত ঘটে। সেখানে নিজেদের মানিয়ে নিতে না পেরে খাদ্যের খোঁজে এসব পাখি শীতের শুরুতে নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে আসতে শুরু করে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চল এবং এর লেকগুলো খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ ও বসবাসের উপযোগী হওয়ায় পরিযায়ী পাখিরা এখানে অবস্থান করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতন রেজিস্ট্রার ভবনের পূর্ব ও পশ্চিম পাশের লেক, ওয়াইল্ডলাইফ রেসকিউ সেন্টারের অভ্যন্তরের লেক এবং জয়পাড়া সংলগ্ন লেকে পাখি আসে।

তবে বিগত কয়েকদিনে সরেজমিনে লেকগুলো ঘুরে দেখা যায়, ওয়াইল্ডলাইফ রেসকিউ সেন্টারের অভ্যন্তরের লেকটিতে কিছু পাখি রয়েছে। তবে সেখানে জনসাধারণের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এছাড়া অন্যান্য লেকগুলোতে এবছর কোনো পাখি আসেনি। শীতের শুরুর দিকে পুরাতন রেজিস্ট্রার ভবনের পশ্চিম পাশের লেকে কিছু পাখি অবস্থান করলেও এখন সেগুলো নেই।২০১৪ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে অতিথি পাখিদের অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করে সরকার। তবে সেই অভয়ানণ্যের তকমা হারাতে শুরু করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকগুলো। লেকগুলোর পাড়ে অতিরিক্ত দর্শনার্থীর ভিড় ও লেকগুলো বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ায় বিগত কয়েকবছর ধরে কমেছে পরিযায়ী পাখির আগমন। এই ধারাবাহিকতা বজায় রয়েছে এবছরও।

বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত বন্যপ্রাণী ও পাখির ছবি তোলেন আলোকচিত্রী ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র অরিত্র সাত্তার। তিনি বলেন, ‘বিগত বছরগুলোর তুলনায় এবার পাখির সংখ্যা প্রায় অনেক কম। লেকগুলোর পাড়ে জনসাধারণের বিশৃঙ্খলা ও লেক অব্যবস্থাপনার দরুন পাখিদের এই অভয়ারণ্যের প্রতি অনীহার জন্ম দিয়েছে। তারা শীতের শুরুর দিকে আসলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকগুলোতে উপযুক্ত পরিবেশ না পেয়ে ক্যাম্পাসের আশে-পাশের এলাকাগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছে।’

জানা যায়, ১৯৮৬ সাল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিযায়ী পাখিরা আসতে শুরু করে। এখন পর্যন্ত প্রায় ২০৬ প্রজাতির পরিযায়ী পাখি ক্যাম্পাসের লেকগুলোতে দেখা গেছে। এগুলোর ১২৬ টি দেশীয় প্রজাতির। বাকিগুলো বিদেশি প্রজাতি। এসব পাখিদের অধিকাংশই হাঁসজাতীয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য- পাতিসরালি, পান্তামুখী, মুরগ্যাধি, গার্গেনি, কোম্বডাক, পাতারি, পচার্ড, ছোট জিরিয়া, পাতারী হাঁস, জলকুক্কুট, খয়রা, ফ্লাইফেচার, কলাই, ছোট নগ, লাল গুড়গুটি, নর্দানপিনটেল, কাস্তে চাড়া, জলপিপি প্রভৃতি। তবে বিগত কয়েকবছর ধরে ক্রমেই কমছে পাখির সংখ্যা। 

আলোকচিত্রী অরিত্র সাত্তারের নিজ উদ্যোগে করা একটি পর্যবেক্ষণ থেকে জানা যায়, ২০১৮ সালে ৪ হাজার ৯৭৫, ২০১৯ সালে ৪ হাজার ৭০৯, ২০২১ সালে ৬ হাজার ৪২৭, ২০২২ সালে প্রায় ৪ হাজার ৪০৫ টি পাখি এসেছিল ক্যাম্পাসের লেকগুলোতে। করোনার কারণে লেকগুলোতে অনুক‚ল পরিবেশ তৈরি হওয়ায় ২০২০ সালে পাখির আগমনের সংখ্যা বেড়ে ৮ হাজার ১২০টি হয়েছিল। তবে তা পুনরায় কমতে শুরু করেছে। 

এ বছর এখন পর্যন্ত প্রায় ৩ হাজার ৫৯৭ টি পাখি এসেছে বলে পর্যবেক্ষণ থেকে জানা যায়। পাখির এই কমে যাওয়া রুখতে ২০০১ সাল থেকে বিশ^বিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের উদ্যোগে প্রতি বছরই আয়োজন করা হচ্ছে গণসচেতনতামূলক পাখিমেলার।

এদিকে, বিশ্ববিদ্যালয়ে চলমান উন্নয়ন প্রকল্পের কাজও পাখির চলাচলে প্রভাব ফেলেছে বলে মনে করেন অনেকে। এছাড়া বহুতল ভবন নির্মাণ পাখিদের অবাধ চলাচলের পরিবেশ ব্যাহত করতে পারে পারে বলে একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। ২০২৩ সালের জুনে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমডি) কর্তৃক ‘জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্প’ শীর্ষক নিবিড় পরিবীক্ষণ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে বিষয়টি। 

প্রতিবেদনটির চতুর্থ অধ্যায়ে প্রকল্পের সবল, দুর্বল, সুযোগ ও ঝুঁকিসমূহ পর্যালোচনায় বলা হয়, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান সড়কের নিকটে দুপাশে যথেষ্ট দূরত্ব বজায় না রেখে ৬ তলার অধিক উচ্চতার ভবন নির্মাণের ফলে পাখিদের অবাধ চলাচল বিঘিœত এবং বাস্তুসংস্থানের ভারসাম্য বিঘিœত হতে পারে।’

এছাড়াও জলবায়ু পরিবর্তন, শব্দ দূষণ, পানি দূষণ, লেকগুলোর নিয়মিত সংস্কার না হওয়া ও বহুতল ভবন নির্মাণকে পাখি কমে যাওয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে দেখছেন পরিবেশবিদরা। 

বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক জামাল উদ্দিন দৈনিক জনকণ্ঠকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ শুরুর সময়ে একটি সেন্ট্রাল সুয়ারেজ লাইনের দাবি ছিল। হলগুলোর সুয়ারেজ লাইন লেকের সঙ্গে কানেক্টেড। যার কারণে পানির গুণগত মান নষ্ট হচ্ছে। পাশাপাশি লেকগুলোতে সংস্কার নেই। অতিরিক্ত দর্শনার্থীর ভিড়, গাড়ির উচ্চ শব্দের হর্ন ও লেকগুলো খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ না হওয়ায় পাখির আগমন কমছে। এছাড়া বহুতল ভবন নির্মাণের ফলে পাখির ফ্লাইং জোন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এটিও পাখি কমে যাওয়ার অন্যতম একটি কারণ।’

এসব সমস্যার সমাধানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পাশাপাশি সকলকে উদ্যোগী হতে হবে বলে উল্লেখ করে পাখি গবেষক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কামরুল হাসান দৈনিক জনকণ্ঠকে বলেন, ‘লেকগুলোর পাড়ে অসংখ্য মানুষের আনাগোনা, গান-বাজনা, গাড়ির হর্ন, লেক পরিষ্কার না থাকা, শব্দ দূষণের দরুণ প্রতিকূল পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। এগুলো বন্ধ করতে হবে। পাখির নিরাপত্তা নিশ্চিতে সচেতনতামূলক কার্যক্রম নিয়মিত চলমান রাখতে হবে। যে লেকগুলোতে আগে পাখি বসতো সেগুলো সংস্কার করা সময়ের দাবি। লেকগুলো যথাসময়ে পরিষ্কার ও সংস্কার করা গেলে এবং অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করা গেলে পাখিগুলো হয়ত আবার ফিরে আসবে।’

লেক সংস্কার ও পাখির উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিতের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পদ বিভাগের কর্মকর্তা আব্দুর রহমান বলেন, ‘আমাদের যে বাজেট দেয়া হয় তা লেকের পাড়ে বেড়া দেয়া, সচেতনতামূলক ব্যানার-ফেস্টুন টাঙানো ও লেক পরিষ্কারের জন্য যথেষ্ট নয়। এবছর লেকগুলো পরিষ্কার করা হয়েছে। বাকি কাজগুলোর বিষয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।’
 

এসআর

×