
.
একটা সময় ছিল যখন দেশের নারীদের সম্পর্কে ভাবতে গেলেই চোখের সামনে আসত শিশুসন্তান কোলে নিয়ে চুলার পাশে বসে আছেন একজন মমতাময়ী মা। তার চারপাশে হাঁড়ি-পাতিল, চুলায় কড়াই, বঁটিতে কাটছেন তরকারি। বাজারের থলিটা পড়ে আছে কাছেই। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টেছে দৃশ্যপট। জাতিসংঘ থেকে শুরু করে নাসা, মেট্রোরেল থেকে উড়োজাহাজ দক্ষ হাতে চালাচ্ছেন দেশের নারীরা। রান্নাঘরের বৃত্ত ভেঙে আলো ছড়াচ্ছে দেশ-বিদেশের নানা কর্মক্ষেত্রে। তবে দিনগুলো এমনি এমনি পরিবর্তন হয়নি। রান্না আর ঘরগৃহস্থালীতেই যখন বন্দি ছিল নারী জীবন, তখনই আলোকবর্তিকা হাতে নিয়ে এগিয়ে এসেছিলেন একজন মহীয়সী নারী। বাংলার ঘরের এককোণায় আঁধারি জীবনকে দিয়েছিলেন পূর্ণ আলোর ছটা। যেই ধারা অব্যাহত রয়েছে আজও। তার জ্বালিয়ে দেওয়া আলোর পথের যাত্রায় আজ সাফল্যের শীর্ষে পৌঁছাতে পারছেন নারীরা। দেশের এমন কোনো খাত নেই যেখানে পড়েনি নারীদের দৃপ্ত পদচারণা। চিকিৎসা, শিক্ষা, ব্যবসা, রাজনীতি, আমলাতন্ত্রসহ খেলাধুলায়ও সমানে ছড়াচ্ছেন দক্ষতার ছাপ। আর তাদের উদ্বুদ্ধ করতে যে নারী আলোর মশালটা জ্বালিয়েছিলেন, তিনি বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন।
প্রায় দেড়শ’ বছর আগে দেশের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে জন্ম নেওয়া এই নারী বেরিয়ে এসেছিলেন নৈমিত্তিক জীবনধারা ভেঙে। দেখিয়ে দিয়ে গেছেন নারী মুক্তির দিশা। তার লেখা ‘সুলতানাস ড্রিমস’-এর মতোই যেন নারীদের আকাশছোঁয়ার স্বপ্ন আজ সত্যি। আর সেই নারীকে সম্মাননা জানাতে প্রতিবছর তার জন্ম এবং মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ৯ ডিসেম্বর পালন করা হয় বেগম রোকেয়া দিবস। প্রতিবছরের মতো এ বছরও নানা আয়োজনে আজ দিবসটি পালন করা হচ্ছে।
দিবসটি উপলক্ষে প্রতিবছরের মতো এবারও সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে দেশজুড়ে নেওয়া হয়েছে বিভিন্ন কর্মসূচি। দিবসটি উপলক্ষে বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দিবসটি উপলক্ষে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখার স্বীকৃতিস্বরূপ দেশের পাঁচ নারীর হাতে তুলে দেওয়া হবে ‘বেগম রোকেয়া পদক ২০২৩’। এ বছর বেগম রোকেয়া পদক পাচ্ছেন নারী শিক্ষায় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম নারী উপাচার্য খালেদা একরাম, মরণোত্তর (ঢাকা জেলা)। নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় ডা. হালিদা হানুম আখতার (রংপুর জেলা), নারীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে কামরুন্নেছা আশরাফ দিনা, মরণোত্তর (নেত্রকোনা জেলা), নারী জাগরণে উদ্বুদ্ধকরণে নিশাত মজুমদার (লক্ষ্মীপুর জেলা) ও পল্লী উন্নয়নে রনিতা বালা (ঠাকুরগাঁও জেলা)।
শুধু এই পাঁচ নারী নন সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রেই আলো ছড়িয়ে যাচ্ছেন নারীরা। আর এই পথের অগ্রপথিক বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন মন্তব্য করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডা. আয়েশা আক্তার জনকণ্ঠকে বলেন, একটা সময় আমাদের মেয়েরা পুরুষ চিকিৎসকের কাছে গর্ভকালীন সেবা নিতে অস্বীকৃতি জানাতেন। নারী চিকিৎসক ছিল হাতেগোনা কয়েকজন। কিন্তু আজ সেই অবস্থা থেকে বেরিয়ে এসেছি আমরা। শুধু রাজধানীই নয়, দেশের প্রত্যেক অঞ্চলেই চিকিৎসা খাতে নারীরা যে অবদান রাখছে তা দেশ-বিদেশেও প্রশংসিত হয়েছে। বিশেষ করে করোনাকালে আমাদের চিকিৎসক-নার্সরা রোগীদের যে সেবা দিয়েছেন তা আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসা লাভ করেছে। কিন্তু এসব সম্ভব হতো না যদি সেই উনবিংশ শতাব্দির শুরুতে বেগম রোকেয়া আলোর প্রদীপটা জ্বালিয়ে না যেতেন।
একই কথা বলেন পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ এর সাবেক সভাপতি ড. রুবানা হক। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, একজন নারী ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার হবেন এটা যেন অবিশ্বাস্য একটা শব্দ ছিল যুগের পর যুগ। সমাজের মানুষের বদ্ধ ধারণা ছিল নারীরা শুধু রান্না-ঘর গৃহস্থালীর কাজেই পার করে দেবেন জীবন। কিন্তু এখনকার চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। নারীরা নেতৃত্ব দিচ্ছেন দেশের অন্যতম রপ্তানির খাত পোশাক শিল্পে। দেশ-বিদেশের ক্রেতাদের সঙ্গে সমান তালে প্রদর্শন করে যাচ্ছেন নিজের যোগ্যতা। যা ২০ বছর আগেও কেউ কল্পনা করতে পারত না কেউ। এই ধারার সূচনা করে গেছেন কিন্তু বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। যা এখনো অব্যাহতভাবে চলছে।
দিবসটি উপলক্ষে প্রতিমন্ত্রী বলেন, বেগম রোকেয়া দিবসে দেশের সব জেলা ও উপজেলায় নারী উন্নয়ন, ক্ষমতায়ন ও অধিকার বিষয়ে প্রচার ও সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে আলোচনাসহ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। টেলিভিশন ও রেডিওতে নারীর অধিকার ও সমতা প্রতিষ্ঠায় বিশেষ আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে। নারী শিক্ষা, নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা ও সচেতনতা বৃদ্ধি করতে ব্যানার, ফেস্টুন, পোস্টার বিতরণ করা হবে বলেও সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।
১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর রংপুরের মিঠাপুকুর থানার পায়রাবন্দ গ্রামে জন্ম নেন বেগম রোকেয়া। রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারে জন্ম নিয়েও তিনি নারী জাগরণের অগ্রদূতের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। সমাজ সংস্কারক এই নারীর মৃত্যু হয় ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর। বাবা জহির উদ্দিন মুহম্মদ আবুল আলী হায়দার সাবের, মা রাহাতুন্নেছা চৌধুরানী। বেগম রোকেয়ার ছিল দুই ভাই ও দুই বোন। বড় ভাই ইবরাহিম সাবের ছিলেন প্রগতিশীল মানুষ। অগোচরে মোমের আলোয় বেগম রোকেয়া ও আরেক বোন করিমুন্নেছাকে দিতেন বর্ণশিক্ষা। আর রোকেয়ার ছিল জানার ও শিক্ষার অদম্য আগ্রহ।
বেগম রোকেয়ার জীবনী পর্যালোচনায় জানা যায়, ১৮৯৬ সালে ১৬ বছর বয়সে বেগম রোকেয়ার বিয়ে হয় ভাগলপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট খান বাহাদূর সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে। রোকেয়া পেলেন আরেক জন প্রগতিশীল মানুষের সাহচার্য। স্বামী সাখাওয়াত হোসেন বেগম রোকেয়ার লেখাপড়ার প্রতি অকুণ্ঠ আগ্রহ দেখে তাকে সাহায্য করতে লাগলেন বাংলা ও ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে এবং তার লেখালেখিতে সাহায্য করতে লাগলেন। এই শিক্ষাই বেগম রোকেয়াকে ভাবতে শিখিয়েছিল সে সময়ের অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজ, কুসংস্কারাচ্ছন্ন জীবন, শিক্ষাহীন নারী সমাজের মুক্তির কথা। নারীদের অশিক্ষার অন্ধকার থেকে কী করে তাদের টেনে তোলা যায়, সে ভাবনা থাকত তার মাথায়। আর তাই তো তিনি স্বপ্ন দেখলেন একটি স্কুলের। যেখানে সমাজের পিছিয়ে পড়া নারীরা লেখাপড়া শিখবে। আর তার এ স্বপ্নকে আরও বড় করে তোলেন তার স্বামী সাখাওয়াত হোসেন। ১৯০২ সালে ‘পিপাসা’ নামে একটি বাংলা গল্প লিখে সাহিত্যের জগতে প্রবেশ। আর ১৯০৫ সালে রোকেয়া ইংরেজিতে লিখলেন তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘সুলতানাস ড্রিমস’। সাখাওয়াত হোসেন লেখাটি পড়ে অভিভূত হয়ে পড়েন এবং তাকে উৎসাহ দেন লেখাটি বই আকারে প্রকাশ করার জন্য। ১৯০৮ সালে সুলতানাস ড্রিমস বই আকারে প্রকাশিত হয়। পরবর্তীকালে বইটি বাংলায় ‘সুলতানার স্বপ্ন’ নামে রূপান্তরিত হয়েও প্রকাশিত হয়। এই বইটিকে বিশ্বের নারীবাদী সাহিত্যে একটি মাইলফলক হিসেবে গণ্য করা হয়। তার অন্যান্য গ্রন্থ হলো ‘অবরোধবাসিনী’, ‘মতিচুর’, ‘পদ্মরাগ’। ১৯০৯ সালে সাখাওয়াত হোসেন খান মৃত্যুবরণ করেন।
সাখাওয়াত হোসেনের মৃত্যুর পাঁচ মাস পর ১৯০৯ সালের ১ অক্টোবর ভাগলপুরের তদানীন্তন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ শাহ আব্দুল মালেকের সরকারি বাসভবন গোলকুঠিতে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস হাই স্কুল। তখন এর ছাত্রী সংখ্যা ছিল পাঁচজন। ১৯১০ সালে সম্পত্তি নিয়ে ঝামেলার কারণে স্কুল বন্ধ করে কলকাতায় চলে যান।
পরবর্তীতে ১৯১১ সালের ১৬ মার্চ স্কুলটি কলকাতায় ১৩ নম্বর ওয়ালীউল্লাহর ভাড়া বাড়িতে নতুন করে পুনরায় চালু করা হয়। বর্তমানে স্কুলটি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার পরিচালনা করছে। কলকাতায় প্রাথমিক অবস্থায় এই স্কুলের ছাত্রী সংখ্যা ছিল মাত্র আটজন। সে সময় নারী শিক্ষার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছাত্রীদের ও তাদের অভিভাবকদের বোঝাতেন শিক্ষার কথা। এতে ধীরে ধীরে ছাত্রী সংখ্যা বাড়তে লাগল। ১৯৩০ সালে এটি হাইস্কুলে পরিণত হয়। স্কুল প্রতিষ্ঠা করা ছাড়াও সে সময়ের নিগৃহীত নারী সমাজের অধিকার আদায়ের প্রতিষ্ঠাকে আরও বেগবান করার জন্য ১৯১৬ সালে ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতীনে ইসলাম’ নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। সেই সঙ্গে চলতে থাকে সমাজের নানা অসঙ্গতির বিরুদ্ধে তার ক্ষুরধার লেখনি। ১৯১৯ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘মুসলিম মহিলা ট্রেনিং স্কুল’। সেখানে নারীদের রান্না, সেলাই, সন্তান পালনসহ নানা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। ১৯৬৩ সালে প্রথম রোকেয়ার নামে একটি কলেজ স্থাপন করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৭৯ সালে এটি জাতীয়করণ করা হয়। ১৯৬৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী হলের নামকরণ করা হয় তার নামানুসারে। বর্তমান সরকার ২০০৯ সালে রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করে ‘বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়’ করে।