আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণেচ্ছু সবার আতঙ্ক স্বতন্ত্র প্রার্থী
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণেচ্ছু সবার আতঙ্ক স্বতন্ত্র প্রার্থী। এবার ৩০০ আসনে মনোনয়নপত্র দাখিল করা ২ হাজার ৭১৬ প্রার্থীর মধ্যে আওয়ামী লীগের ৪৪২ জনসহ স্বতন্ত্র ৭৪৭ জন। এর মধ্যে তিন শতাধিক প্রার্থী নিজ নিজ এলাকায় জনপ্রিয়। তাই আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও তৃণমূল বিএনপি, বিএনএম এবং ১৪ দলীয় জোটের শরিকসহ সব দলের প্রার্থীর মধ্যেই স্বতন্ত্র প্রার্থী নিয়ে আতঙ্ক বিরাজ করছে। নির্বাচনের আর মাত্র ২৯ দিন বাকি। তাই কীভাবে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের পেছনে ঠেলে ভোটারদের সমর্থন আদায় করে বিজয়ের ফসল ঘরে তোলা যায় সেজন্য বিভিন্ন কৌশলে দলীয় প্রার্থীদের বিরামহীন দৌড়ঝাঁপ চলছে।
সূত্র মতে, এবার অধিকাংশ আসনে জনপ্রিয় স্বতন্ত্র প্রার্থী থাকায় বড় বড় দলের প্রার্থীদের মধ্যেও আতঙ্ক বিরাজ করছে। রাজপথের বিরোধী দল এবার সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়নি। তাই প্রতিটি নির্বাচনী এলাকায় তাদের যে ভোট ব্যাংক রয়েছে তা দলীয় প্রার্থীর পক্ষে না গিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে যাবে বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করছেন। তাদের মতে, ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগসহ যে ক’টি দল নির্বাচনে অংশ নিয়েছে তাদের ওপর চরম ক্ষুব্ধ বিএনপি। তাই দলের একটি অংশ ভোট দিতে যাবে না। তবে দলের পদ-পদবি নেই এমন আরেকটি অংশ ভোট দিতে যাবে।
তবে তাদের ভোটের বেশিরভাগই পড়বে দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে। সে ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগসহ বড় বড় দলের প্রার্থীরাও ঝুঁকিতে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ প্রভাবশালী স্বতন্ত্র প্রার্থীরা নিজ ভোট ব্যাংকের পাশাপাশি বিরোধী দলের ভোট ব্যাংককে পুঁজি করে অনেক আসনে নির্বাচনী বৈতরণী পার হয়ে যেতে পারেন। মূলত এ কারণেই দলীয় প্রার্থীদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
নির্বাচন কমিশন (ইসি) থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী আসন্ন সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী ৭৪৭ জন, যা দেশের জাতীয় নির্বাচনের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রেকর্ড। আওয়ামী লীগ থেকে এবার যে ৪৪২ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন তার মধ্যে প্রায় অর্ধশত বর্তমান ও সাবেক সংসদ সদস্য। ৩০০ সংসদীয় আসনের মধ্যে মাত্র ৩২টি ছাড়া সব আসনেই স্বতন্ত্র প্রার্থী রয়েছে। অধিকাংশ আসনে আওয়ামী লীগেরই একাধিক স্বতন্ত্র প্রার্থী রয়েছে। কোনো কোনো আসনে রয়েছে ক’জন করে স্বতন্ত্র প্রার্থী। অভিজ্ঞ মহলের মতে, ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দলের নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অনুমতি দেওয়ার কারণে এবার সবচেয়ে বেশি স্বতন্ত্র প্রার্থী মনোনয়ন জমা দিয়েছেন।
ইসির তথ্যানুসারে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীর সংখ্যা ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের চেয়ে ২৫০ জন বেশি। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিল ৪৯৮ জন, তাদের মধ্যে ১২৮ জন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। আর এবার স্বতন্ত্র প্রার্থী ৭৪৭ জন। এর মধ্যে অনেকের মনোনয়নপত্র ১ শতাংশ ভোটারের স্বাক্ষর জটিলতাসহ বিভিন্ন কারণে বাছাইয়ে বাদ পড়লেও আপিলে অধিকাংশ প্রার্থীরই প্রার্থিতা ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
এর আগে ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিল ১৫০ জন। এর মধ্যে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন ১০৪ জন। ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৫১ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিলেন। ২০০১ সালে ৪৮৬ জন, ১৯৯৬ সালে ২৮৪ জন, ১৯৯১ সালে ৪২৪ জন, ১৯৮৮ সালে ২১৪ জন, ১৯৮৬ সালে ৪৫৩ জন, ১৯৭৯ সালে ৪২২ জন এবং ১৯৭৩ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিলেন ১২০ জন।
রাজপথের বিরোধী দল বিএনপির অনুপস্থিতিতে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগের সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে চাইবেন আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিতরা। তাই অনেক আসনেই আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হবেন দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। কারণ এই স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে পদত্যাগ করে নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন অর্ধশত ইউপি, উপজেলা ও জেলা চেয়ারম্যান। এ ছাড়া দল থেকে মনোনয়ন বঞ্চিত ৭১ জন সংসদ সদস্যের মধ্যে প্রায় অর্ধশত স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। তাদের প্রত্যেকের নিজ নিজ এলাকায় প্রভাব-প্রতিপত্তি ও ভোট ব্যাংক রয়েছে। তাই দুই পক্ষ জড়িয়ে পড়ছে সংঘাত-সংঘর্ষে। তাই এ নিয়ে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টিসহ বিভিন্ন দলের প্রতীকে অংশ নেওয়া প্রার্থীরা বেশি চিন্তিত।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীর বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, যারা স্বতন্ত্র নির্বাচন করবেন তাদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বাধা থাকবে না। জনগণের ভোটে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা নির্বাচিত হলে কারও কোনো আপত্তি নেই।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেছেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে আরও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক করতে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। বেশি বেশি প্রার্থী মানে ভোটার উপস্থিতিও বেশি। এটা রেখেই এবার স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নির্বাচন করার সুযোগ রাখা হয়েছে। তবে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা বিশৃঙ্খলার চেষ্টা করলে তাদের নিয়ন্ত্রণ করা হবে কঠোর হস্তে। বিশৃঙ্খলা রোধে নির্বাচন কমিশনের নির্দেশে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সদা সতর্ক রয়েছে।
ইসি সূত্র জানায়, এবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২৬৮টি আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী থাকলেও নেই মাত্র ৩২ আসনে। সস্তন্ত্র প্রার্থী থাকা ক’টি আসনেই আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট প্রার্থী রয়েছেন। তবে যে ৩২টি আসনে কোনো স্বতন্ত্র প্রার্থী মনোনয়নপত্র দাখিল করেননি তার মধ্যে রয়েছে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক যোগাযোগ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের আসন। এ ছাড়া সাবেক শিল্পমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টাম-লীর সদস্য আমির হোসেন আমু, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ, প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক সাবেক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, স্থানীয় সরকার মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম, শেখ হেলাল উদ্দিন, সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. আ ক ম রুহুল হক, সাবের হোসেন চৌধুরী, ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানের আসনেও কোনো স্বতন্ত্র প্রার্থী নেই।
৩২টি আসনের অন্যগুলো হচ্ছে ঢাকা-১, ঢাকা-৯, ঢাকা ১৫, নারায়ণগঞ্জ-৫, কুমিল্লা-৯ ও কুমিল্লা-১০, বি.বাড়িয়া-৪. নোয়াখালী-৫, চট্টগ্রাম-৭, ৯ ও ১৩, কক্সবাজার-২, বগুড়া-৫ সিরাজগঞ্জ-২ এবং পাবনা-৫, পঞ্চগড়-২, মাগুরা-১, বাগেরহাট-১, পটুয়াখালী-১, শরীয়তপুর-৩, সিলেট-৪ ও ৬, কিশোরগঞ্জ-৪, মানিকগঞ্জ-৩, মাদারীপুর-১ ও ২, টাঙ্গাইল-১, টাঙ্গাইল ৮, ময়মনসিংহ-৯, ভোলা-২, বরিশাল-১ ও ঝালকাঠি-২ আসন।
এদিকে এবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীর আধিক্য থাকায় এবং এর মধ্যে অনেক প্রার্থী নিজ নিজ এলাকায় প্রভাবশালী হওয়ায় সরকার নির্বাচন কমিশনের মধ্যেও আতঙ্ক বিরাজ করছে। কারণ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করার বিষয়ে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন মহলের নানামুখী চাপ থাকায় সরকার এবং নির্বাচন কমিশনও সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যাপারে অধিকতর তৎপর রয়েছে। তাই কোনো কারণে কোনো সংসদীয় আসনে দলীয় প্রভাবশালী প্রার্থীদের সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রভাবশালী প্রার্থীদের বিরোধ সৃষ্টি হলে সুষ্ঠু নির্বাচনের সকল ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যেতে পারে। তাই নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসন স্বতন্ত্র প্রার্থীসহ সকল প্রার্থীর গতিবিধি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।
৭ জানুয়ারি সংসদ নির্বাচন। এ নির্বাচনের আর মাত্র ২৯ দিন বাকি থাকায় সারাদেশের ৩০০ আসনে ব্যস্ত সময় পার করছেন প্রার্থীরা। স্বতন্ত্র প্রার্থীরাও বসে নেই। কোনো কোনো এলাকায় দলীয় প্রার্থীর চেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের তোড়জোড় বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তবে আচরণবিধি ভঙ্গের ভয়ে প্রকাশ্যে প্রচারের পরিবর্তে চলছে নীরব গণসংযোগ। নিজ নিজ এলাকায় ভোটারদের পাশাপাশি বিভিন্ন মহলের সমর্থন পেতে বিরামহীন দৌড়ঝাঁপ চালিয়ে যাচ্ছেন তারা।
নির্বাচন কমিশন ১৫ নভেম্বর দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে। ঘোষিত তফসিল অনুসারে ৩০ নভেম্বর ছিল নির্বাচনে মনোনয়নপত্র দাখিলের সময় শেষ হয়েছে। আর মনোনয়নপত্র বাছাই শেষ হয় ৪ ডিসেম্বর। এখন চলছে বাছাইয়ে পর বাদপড়া প্রার্থীদের আপিল গ্রহণ। আপিল নিষ্পত্তি হবে ১৫ ডিসেম্বর। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ দিন ১৭ ডিসেম্বর। ১৮ ডিসেম্বর প্রতীক বরাদ্দ করা হবে। প্রার্থীরা নির্বাচনের প্রচার চালাতে পারবে ১৮ ডিসেম্বর থেকে ৫ জানুয়ারি সকাল ৮টা পর্যন্ত।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটার ১১ কোটি ৯৬ লাখ ৯১ হাজার ৬৩৩ জন। পুরুষ ভোটার ৬ কোটি ৭ লাখ ৭১ হাজার ৫৭৯ জন ও নারী ভোটার ৫ কোটি ৮৯ লাখ ১৯ হাজার ২০২ জন। আর হিজড়া ভোটারের সংখ্যা ৮৫২। নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ৪৪টি দলের মধ্যে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টিসহ ২৮টি দল নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। আর বিএনপিসহ ১৬টি দল এক দফা দাবিতে রাজপথে আন্দোলন করছে। এর আগে ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সব দল নির্বাচনে অংশ নেয়। ২০১৪ সালের নির্বাচনে অংশ নেয় ১২টি নিবন্ধিত দল। আর ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে অংশ নেয় ৩৯টি দল।
নির্বাচন কশিমন সূত্র জানিয়েছে, এবারের নির্বাচনে কোনো অবস্থাতেই কোনো প্রার্থী কিংবা তাদের সমর্থকদের বিশৃঙ্খলা করতে দেয়া হবে না। কঠোর হস্তে বিশৃঙ্খলা দমন করা হবে। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সব ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। নির্বাচন ঘিরে সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে একগুচ্ছ সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইসি।