ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

জোটের জটিল অঙ্কে ভোট

উত্তম চক্রবর্তী

প্রকাশিত: ২৩:৩৪, ৬ ডিসেম্বর ২০২৩

জোটের জটিল অঙ্কে ভোট

জোট ও ভোটের জটিল আবর্তে দেশের নির্বাচনী রাজনীতি

জোট ও ভোটের জটিল আবর্তে দেশের নির্বাচনী রাজনীতি। এই জোট-ভোটের অঙ্কের সমাধানের একটিই লক্ষ্য- তা হচ্ছে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠান আর ভোটারের ব্যাপক উপস্থিতি নিশ্চিত করা। আর এ প্রধান টার্গেট থেকেই নির্বাচনের রাজনীতির মাঠে স্পষ্টতই চারটি জোট বা ধারার সৃষ্টি হয়েছে। ভোটের জোট নিয়েও শুরু হয়েছে নতুন হিসাব-নিকাশ, নানা মেরুকরণ। নির্বাচনে অংশ নেওয়া নিবন্ধিত ২৯টি রাজনৈতিক দল থেকে শেষ পর্যন্ত কে, কোন দলের সঙ্গে জোট করে নির্বাচনের মাঠে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামছে তা ১৭ ডিসেম্বর মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের আগেই জাতির সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
নির্বাচনকে সামনে রেখে এই চারটি ধারার তৎপরতা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ চাইছে ১৪ দলকে নিয়েই ভোটারদের মন জয় করে চতুর্থবারের মতো ক্ষমতায় আসতে। আর প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি চাইছে সমঝোতায় না গিয়ে নিজেদের ভোটারের পাশাপাশি ‘এন্টি আওয়ামী লীগ’ ভোট তাদের পক্ষে এনে সত্যিকারের বিরোধী দল হিসেবে রাজনীতির মাঠে মাথা তুলে দাঁড়াতে। 
অন্যদিকে, নির্বাচনের মাঠে থাকা তৃণমূল বিএনপি, বিএনএমসহ আরও ছোট ছোট দলগুলোর টার্গেট সবাইকে এক প্লাটফর্মে এনে তৃতীয় একটি শক্তিশালী জোট করা এবং বর্জনকারী দলগুলোর ভোটারদের নিজ পক্ষে এনে অর্ধশতাধিক আসনে জয় নিশ্চিত করা। আর চতুর্থ একটি পক্ষ- যারা ইতোমধ্যে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনের মাঠে শক্ত অবস্থান গড়ে তুলেছে। মনোনয়নবঞ্চিত এসব স্বতন্ত্র প্রার্থীও বড় বড় দলগুলোর প্রার্থীদের হারিয়ে নিজেদের জয় নিশ্চিত করতে মরিয়া হয়ে মাঠে নেমেছে। ফলে নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে, ততই তিনশ’ আসনেই জমজমাট ও হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আভাস স্পষ্ট হয়ে উঠছে। 
বিএনপির অংশগ্রহণবিহীন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে লড়ার মতো শক্তিশালী কোনো দল নেই। সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও বিএনপি-জামায়াতসহ তাদের মিত্ররা ৩০টি আসনের বেশি জিততে পারেনি। সে কারণেই সারাদেশেই সাংগঠনিক ও সমর্থনের বিচারে শক্তিশালী অবস্থানে থাকা আওয়ামী লীগের সঙ্গ ছাড়তেও অনেকে রাজি নয়। ১৪ দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকলেও বিগত দুই সংসদে বিরোধী দলের আসনে থাকা জাতীয় পার্টির মনোভাবও একই। মুখে এককভাবে নির্বাচনের কথা বললেও ভেতরে ভেতরে তারাও আওয়ামী লীগের সঙ্গে সরাসরি বৈরী অবস্থানে যেতে চায় না। বরং মিত্রতা রেখেই আরও অধিক আসনে জিততে চায়। এ অবস্থায় ভোটের জোট নিয়ে শুরু হয়েছে নতুন হিসাব-নিকাশ। 
সাবেক নির্বাচন কমিশনারসহ রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচনে কতটি রাজনৈতিক দল অংশ নিয়েছে এটা বড় কথা নয়, কত শতাংশ ভোটার ভোট দিল এটাই বড় কথা। সাধারণত অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে যদি ৫৫-৬০ শতাংশ ভোটার ভোট দেয় তা হলে তাকে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন বলা হয়। এক্ষেত্রে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যদি ৫০ শতাংশের মতো ভোটারও যদি তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন, তবে সেই নির্বাচন আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য বলেই বিবেচিত হবে।
প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি ভোট বর্জন করলেও ভোটের মাঠে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন করতে এবং উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভোটারকে ভোট কেন্দ্রে আনাটাই এখন আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। আর এ কারণেই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ২৯টি রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ ছাড়াও প্রতিটি আসনেই স্বতন্ত্র প্রার্থী রেখে ভোটার উপস্থিতি বাড়িয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন করার কৌশল নিয়েছে দলটি।
দলটির সিনিয়র নেতারা বলছেন, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সিংহভাগ রাজনৈতিক দল ও ভোটার উপস্থিতির দিক থেকে ব্যাপক অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন উপহার দিতে চায় সরকার। এ কারণে সব আসনে জোটের শরিক দলগুলোর পাশাপাশি জাতীয় পার্টিসহ আওয়ামী লীগের একাধিক স্বতন্ত্র প্রার্থী ভোটের লড়াইয়ে রয়েছেন।
নির্বাচনী জোট গঠন বা সমঝোতার ব্যাপারে ১৪ দলীয় জোটের সমন্বয়ক ও মুখপাত্র এবং আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ আমির হোসেন আমুও জানিয়েছেন, জাতীয় পার্টির সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের শরিকদের সঙ্গে আসন ভাগাভাগির বিষয়টি নির্ধারিত হবে। নির্বাচন জোটগতভাবে হবে। জোটের আসন বিন্যাস ও প্রার্থী চূড়ান্ত করতে আগামী ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। 
জোট প্রসঙ্গে বুধবার জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, জোট বা মহাজোট নয়, নিজস্ব লাঙ্গল প্রতীকে নির্বাচনী যুদ্ধে নেমেছে জাতীয় পার্টি। আমাদের চাওয়া একটাই নির্বাচন কমিশনের কাছে যেন নির্বাচনটা সুষ্ঠু হয়। একটা ভালো পরিবেশ থাকে, ভোটাররা যেন আস্থা পায়। আওয়ামী লীগের সঙ্গে আমাদের নির্বাচনের পরিবেশ নিয়েই আলোচনা হবে।
জানা গেছে, আওয়ামী লীগ আদর্শিক জোট ১৪ দলকে সঙ্গে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি হিসেবে ভোটারের ভোটে টানা চতুর্থবারের মতো ক্ষমতায় যেতে চায়। অন্যদিকে প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি রয়েছে দোটানায়। দলটির একটি অংশ চাইছে এককভাবে নির্বাচন করে এন্টি আওয়ামী লীগের ভোট নিজেদের ভোট বাক্স নিয়ে সত্যিকার বিরোধী দল হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়াতে। অন্য অংশটি বলছে, এককভাবে নির্বাচন করে খুব বেশি আসন পাওয়ার সম্ভাবনা এবার কম। সেক্ষেত্রে বিগত নির্বাচনের মতো এবারও আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করে ৩০-৩৫ আসন নিশ্চিত করতে।

এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের দু’জন সভাপতিম-লীর সদস্য জানিয়েছেন, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে জাতীয় পার্টির গুরুত্ব থাকলেও হাতেগোনা কয়েকটি আসন ছাড়া বিজয়ী হওয়ার মতো তাদের অবস্থান নেই। এমন পরিস্থিতিতে আসন ছাড় না দিলে সাত-আটটার বেশি আসনে তারা বিজয়ী হয়ে আসতে পারবে না। এ জন্য কিছু আসনে তাদের ছাড় দেওয়ার চিন্তাভাবনা চলছে। প্রার্থী প্রত্যাহার না করেও কীভাবে তাদের ছাড় দেওয়া যায়, সে নিয়েও আলোচনা চলছে। 
এই প্রধান দুই দলের বাইরে আরও একটি বৃহৎ জোট আত্মপ্রকাশ করেছে নির্বাচনী রাজনীতির মাঠে। নতুন নিবন্ধন পাওয়া তৃণমূল বিএনপি, বিএনএম, বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টিসহ কয়েকটি ইসলামী দল মিলে নতুন জোট হতে পারে।

মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের আগেই এসব দল এক প্লাটফর্মে এসে ‘জাতীয়তাবাদী জোট’ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে। এসব দলেও অনেক জনপ্রিয় ও পোড় খাওয়া নেতা রয়েছেন, যাদের অধিকাংশই আগে বিএনপি ঘরানার রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এসব দল নির্বাচনের মাঠে নামলে সারাদেশেই নির্বাচন বর্জনকারী বিএনপিসহ তাদের মিত্রদের সমর্থন ও তাদের অধিকাংশ ভোট নিজেদের ভোট বাক্সে আসতে পারে। সে লক্ষ্য নিয়েই তারা সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এসব দলগুলো জোটবদ্ধ হতে পারলে তারা সব মিলিয়ে ২০ থেকে ২৫টি আসনে জয় পেতে পারেন, এমনটাই মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি কিংবা তৃণমূল বিএনপি ও বিএনএমের বাইরে নির্বাচনের মাঠে আরেকটি বৃহৎ শক্তি হিসেবে দেখা দিয়েছে আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিত বর্তমান এমপি ও সারাদেশের পোড় খাওয়া নেতাদের অংশগ্রহণে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। তিনশ’ আসনের মধ্যে প্রায় আড়াইশ’ আসনেই এসব স্বতন্ত্র প্রার্থী মনোনয়ন পাওয়া বড় বড় দলের প্রার্থীদের সামনে হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছেন। আওয়ামী লীগ ছাড়াও অন্যান্য অনেক দলেরও স্বতন্ত্র প্রার্থী রয়েছেন, যারা নিজ নিজ এলাকায় অনেক জনপ্রিয় এবং নির্বাচনে বিপুল সংখ্যক ভোটারদের ভোট কেন্দ্রে আনার ক্ষমতা রয়েছে। এমনটা হলে এবারের দ্বাদশ জাতীয় সংসদে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে থেকেও অনেক নতুন মুখ দেখা যেতে পারে।
নির্বাচনের মাঠে স্পষ্ট এই চারটি জোটের লড়াইয়ের আভাস পাওয়া গেলেও এর মধ্যে জাতীয় পার্টিসহ মিত্র দলগুলোর অনেকেই সরকারি দলের সঙ্গে একটি সমঝোতায় আসার চেষ্টা করছে। ভোটের দৌড়ে যোগ দেওয়া দলগুলোর মধ্যে কেবল জাতীয় পার্টিরই স্থানীয় পর্যায়ে সাংগঠনিক ভিত ও ভোটার রয়েছে। তবে আওয়ামী লীগকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে হারানোর ক্ষমতা কারোরই নেই। তাই একেবারে প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসতেও চায় না আওয়ামী লীগ। তাই স্বতন্ত্র প্রার্থী ছাড়াও নির্বাচনে অংশ নেওয়া সকল দল ও জোটগুলোর অবস্থান শক্তিশালী করতে উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছে তারা। 
আওয়ামী লীগের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিএনপিসহ তাদের মিত্ররা নির্বাচন বর্জন করলেও সারাদেশেই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির একটা মহামিলন ঘটে গেছে। সরকারি দল কিংবা বিরোধী দল দু’দিকেই থাকবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি। স্বাধীনতাবিরোধী ও উগ্র সাম্প্রদায়িক অপশক্তি আর কখনো যেন এদেশকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে না পারে সেজন্য সবাই চাইছে শুধু নির্বাচন নয়, নির্বাচনের পরেও নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সকল দলকে নিয়ে একটি শক্তিশালী ভিত্তি তৈরি করা, যাতে জাতীয় পার্টিসহ অন্যান্য দল বিএনপি-জামায়াতের বিকল্প শক্তি হিসেবে অবস্থান নিয়ে আগামীতে দেশে একটি শক্ত ভিত গড়ে তুলতে পারে। 
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও স্বীকার করছেন, বর্তমান সরকার যে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে চায় তা অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। অতীত নির্বাচনগুলোতে নির্বাচন কমিশন কখনো এবারের মতো কঠোর ও স্বাধীন অবস্থান নিয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেনি, যা পারছে বর্তমান নির্বাচন কমিশন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচন কমিশনের স্বাধীন ও শক্ত অবস্থানের মুখে সরকারের বাঘা বাঘা মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী, এমপি- নেতারাও রেহাই পাচ্ছেন না। কেউ নির্বাচনের আচরণবিধি লংঘন করলেই নিচ্ছে কঠোর পদক্ষেপ। নির্বাচনের এমন  পরিবেশ ৭ জানুয়ারি ভোটের দিন পর্যন্ত ধরে রাখতে পারলে দেশের মানুষ যেমন নিশ্চিন্তে ভোট কেন্দ্রে এসে ভোটাধিকার প্রয়োগের সাহস পাবে, তেমনি ভোটার উপস্থিতিও ব্যাপক বাড়বে।

×