ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

গাজীপুরে আইইউটির সমাবর্তনে প্রধানমন্ত্রী

স্থিতিশীল পরিবেশই সাফল্যের চাবিকাঠি

বিশেষ প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ২৩:০২, ৩০ মে ২০২৩

স্থিতিশীল পরিবেশই সাফল্যের চাবিকাঠি

গাজীপুরে আইইউটির সমাবর্তনে প্রধানমন্ত্রী

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের টানা তিন মেয়াদে স্থিতিশীল পরিবেশ থাকায় বাংলাদেশ সামনের দিকে এগিয়েছে উল্লেখ করে বলেছেন, এটা (অগ্রগতি) সম্ভব হয়েছে কেন? সম্ভব হয়েছে একটি কারণে ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়ে সরকার গঠন করেছে। আজকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত একটা স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক পরিবেশ বাংলাদেশে বিরাজমান। 
মঙ্গলবার গাজীপুরে ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) ৩৫তম সমাবর্তন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী এ প্রসঙ্গে আরও বলেন, এর মাঝে অনেক ঝড় ঝাপটা এসেছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। অনেক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার চেষ্টা করা হয়েছে। তারপরও আমি বলব দেশ যখন স্থিতিশীল থাকে, দেশে যখন অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারাবাহিকতা থাকে তখনই দেশ উন্নতি করতে পারে। আর তার জন্য লাগে একটা সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা। আমাদের প্রতিটি প্ল্যান-প্রোগ্রাম টার্গেটেড, টাইমবাউন্ড। স্থিতিশীল পরিবেশই হচ্ছে বাংলাদেশের সাফল্যের মূল চাবিকাঠি। আর গণতান্ত্রিক ধারা আছে বলেই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আছে। আগামী দিনে চরম দারিদ্র্য বলে বাংলাদেশে কিছু থাকবে না।
প্রধানমন্ত্রী এ সময় বিজ্ঞান ও আধুনিক প্রযুক্তির বিকাশের প্রয়োজনীয়তার ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করে মুসলিম উম্মাহকে হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে তাদের সন্তানদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষার ক্ষেত্রে আরও বেশি বিনিয়োগের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ইসলামের সোনালি যুগে বিশ্বসভ্যতা, বিজ্ঞান, সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শন, রসায়ন, গণিত, চিকিৎসা, জ্যোতির্বিদ্যা ও ভূগোলশাস্ত্রের বিভিন্ন শাখায় মুসলমানদের অবদান এক গৌরবময় ঐতিহ্যের ইতিহাস গড়ে তুলেছে। মুসলমানগণ শৌর্য-বীর্য, জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং সাহিত্য-সংস্কৃতিতে শ্রেষ্ঠত্ব দেখিয়েছে।
সরকার প্রধান বলেন, সেই গৌরবময় ঐতিহ্যের অধিকারী মুসলমানরা কেন পিছিয়ে পড়ল, তা আমাদের বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। নিজেদের মধ্যে কলহ, একে অপরের প্রতি সৌহার্দ্য এবং শ্রদ্ধার অভাব, জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় পিছিয়ে পড়াসহ নানা কারণে আজ মুসলমানরা পিছিয়ে পড়েছে। এই সম্মান ফিরে পেতে মুসলমানদের আবার শিক্ষা-গবেষণায় বিনিয়োগ করতে হবে এবং বিজ্ঞান ও আধুনিক প্রযুক্তির উন্নয়ন করতে হবে।
মুসলিম জাতি তার হারানো গৌরব ফিরে পাবে আশা প্রকাশ করে শেখ হাসিনা বলেন, আজকে মুসলিমদের দখলে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে সম্পদ রয়েছে। এই সম্পদকে বিজ্ঞান ও আধুনিক প্রযুক্তির উন্নয়নে কাজে লাগিয়ে আমাদের হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে পারি, সেটাই আমি বিশ্বাস করি। আমি যখনই যেখানে যাই আমি এ অনুরোধ করি।
ওআইসি’র মহাসচিব ও ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) চ্যান্সেলর হিসেন ব্রাহিম তাহা’র সভাপতিত্বে এতে স্বাগত বক্তব্য রাখেন আইইউটির ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম।

এছাড়াও সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন ও শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। 
সমাবর্তনে ২০২১ এবং ২০২২ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীদের স্মাতক, মাস্টার্স, পিএইচডি এবং ডিপ্লোমা ডিগ্রি প্রদান করা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের অসামান্য ফলাফলের জন্য দুই ধরনের স্বর্ণপদক আইইউটি স্বর্ণপদক এবং ওআইসি স্বর্ণপদক দেয়া হয়েছে। অনুষ্ঠানের শুরুতে আইইউটির ওপর একটি প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়। প্রধানমন্ত্রী তার অর্থায়নে আইইউটির নবনির্মিত মহিলা হলেরও উদ্বোধন করেন। 
আইইউটি বাংলাদেশের একটি শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান- যা অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কো-অপারেশন (ওআইসি) এর অর্থায়নে পরিচালিত হয়। আইইউটির মূল উদ্দেশ্য হলো ওআইসি’র সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মানবসম্পদ উন্নয়নে- বিশেষ করে প্রকৌশল, প্রযুক্তি ও কারিগরি শিক্ষার ক্ষেত্রে অবদান রাখা। আইইউটি ওআইসিভুক্ত সদস্য দেশগুলো থেকে সরাসরি অনুদান পায় এবং ছাত্রদের বিনামূল্যে শিক্ষাদান, বোর্ডিং, বাসস্থান ও চিকিৎসা প্রদান করে। 
প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুসলিমদের জ্ঞান-বিজ্ঞানে পিছিয়ে পড়ার কথা উল্লেখ করে বলেন, আধুনিক যুগে, দুঃখজনকভাবে, মুসলিম বিশ্বে মাত্র ৩টি নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে; যা বিশ্বব্যাপী গবেষণা ও উন্নয়নে তাদের অপর্যাপ্ত অবদানকে প্রতিফলিত করে। এখন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতে মুসলমানদের আরও প্রচেষ্টার প্রয়োজন, যাতে তারা বেশি করে অবদান রাখতে পারেন।
তিনি বলেন, বিশ্ব যখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবোটিক্স, ইন্টারনেট অফ থিংস, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং এবং অন্যান্য প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে প্রবেশ করছে, তখন আমাদের পিছিয়ে থাকলে চলবে না। আমাদের সরকার এ বিষয়ে সব সময় উৎসাহ দিচ্ছি।
আগামী অর্থবছরের জন্য এবার ৭ লাখ কোটি টাকার বাজেট দেওয়া হবে বলে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পহেলা জুন আমরা নতুন বাজেট দিতে যাচ্ছি। এবার আমরা ৭ লাখ কোটি টাকার বাজেট দিতে সক্ষম হবো। বিএনপি আমলের সঙ্গে বর্তমান সরকারের উন্নয়নের তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, আমাদের বাজেট ২০০৬ সালে মাত্র ৬১ হাজার কোটি টাকা ছিল। আজকে সেই (গত অর্থবছর) বাজেট আমরা ৬ লাখ কোটি টাকায় উন্নীত করেছি।
তিনি বলেন, ২০০৬ সালে দারিদ্র্যের হার ৪১ দশমিক ৫ শতাংশ হতে ২০২২ সালে ১৮ দশমিক ৬ শতাংশে এবং চরম দারিদ্যের হার ২৫ দশমিক ৫ শতাংশ হতে হ্রাস পেয়ে ৫ দশমিক ৬ শতাংশে নেমে এসেছে। ইনশাল্লাহ দেশে চরম দারিদ্র্য বলে কিছু থাকবে না। দেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বৃদ্ধির কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশের জিডিপির আকার ২০০৬ সালে যেখানে ছিল মাত্র ৬০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার; বর্তমানে তা ৪৬৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। মাথাপিছু আয় ৫৪৩ মার্কিন ডলার হতে ২০২২ সালে ২ হাজার ৮২৪ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে।
মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধির কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মানুষের গড় আয়ু বেড়ে ৭৩ বছর হয়েছে। বিগত সাড়ে ১৪ বছরে শিশু মৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ২১ এবং মাতৃ মৃত্যুর হার প্রতি লাখে ১২৩-এ নেমে এসেছে।
স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যের কথা পুনর্ব্যক্ত করে শেখ হাসিনা বলেন,  আমরা একটি জ্ঞানভিত্তিক স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে চাই। স্মার্ট বাংলাদেশে থাকবে একটি স্মার্ট সরকার, একটি স্মার্ট অর্থনীতি, একটি স্মার্ট জনসংখ্যা, একটি স্মার্ট সমাজ এবং স্মার্ট জনশক্তি। মানুষকে ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহারে দক্ষ করে তোলা হবে; যাতে তারা চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে অবদান রাখতে পারে। স্মার্ট বাংলাদেশের উদ্দেশ্য হলো পরিবর্তিত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, শিল্প উৎপাদন, ব্যবসা, বাণিজ্য সবক্ষেত্রে ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করা।
তিনি বলেন, লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য আমরা প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ডিজিটাল ল্যাব স্থাপন করছি। সারাদেশে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ ও ইনকিউবেশন সেন্টার এবং হাইটেক পার্ক গড়ে তোলা হচ্ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা হচ্ছে।
দক্ষ মানব সম্পদ গড়তে সরকার শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিয়েছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, শিক্ষা ও গবেষণায় আমরা বিশেষ জোর দিয়েছি। এ ক্ষেত্রে মেধাবী শিক্ষার্থীদের আমরা বৃত্তিসহ বিশেষ প্রণোদনা দিচ্ছি। দেশ-বিদেশের নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে গবেষণার জন্য তাদের সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে।
আর্থ-সামাজিক বিভিন্ন খাতে বাংলাদেশের অগ্রগতির কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের নিরন্তর প্রচেষ্টার ফলে বাংলাদেশ খাদ্য নিরাপত্তা, আবাসন, কমিউনিটি স্বাস্থ্যসেবা, বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন, আর্থিক অন্তর্ভুক্তি, ডিজিটাল পরিষেবা, ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ, দুর্যোগের প্রস্তুতি এবং জলবায়ু অভিযোজনসহ বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক খাতে ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে। এমনকি ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ আমাদের অগ্রগতি ব্যহত করতে পারেনি।
২০০৭ সালে ১/১১’র তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় সাব-জেলে বন্দি থাকার সময়টা স্মৃতিচারণ করেন এবং সরকার গঠন করলে কি কি করবেন সেই পরিকল্পনা নোট করে ডায়েরিতে লিখে রাখার কথা জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, আমি সময়টা নষ্ট করিনি। তখন বসে বসে লিখেছিলাম যে যদি সরকারে যাই কোন সালের মধ্যে কি কি করব। তিনি বলেন, ২০২১ সালে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছি। এই মর্যাদা কার্যকর হবে ২০২৬ সালে। এ পরিপ্রেক্ষিত পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছি। ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ হবে উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। একইসঙ্গে জাতিসংঘ ঘোষিত এসডিজি, ২০৩০ সেটা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও আমরা অনেক অগ্রগতি হয়েছে। সেই দিকে লক্ষ্য রেখে এগিয়ে যাচ্ছি।

×